কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ঢাকার উত্থানের কৌশলগত ফলাফল

মানবজমিন প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৪৮

গত সপ্তাহে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড- আইএমএফ’র সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশিত হবার বিষয়টি ভারতে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। উস্কানি হলো, আইএমএফের একটি পূর্বাভাস, যাতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি চলতি বছরে ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রদর্শিত পরিসংখ্যানে পার্থক্য সামান্য । ১৮৮৮ মার্কিন ডলার থেকে ১৮৭৭ মার্কিন ডলার এবং সেটা চলতি বছরের চেয়ে বেশি সময় টিকে থাকবে, তেমনটা মনে করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু সেটাকেই এনডিএ সরকারের অর্থনৈতিক রেকর্ড বিষয়ে একটি রাজনৈতিক আক্রমণ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট গোলাবারুদ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের অর্থনৈতিক মন্থরগতি বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এর অনেকগুলো কারণ। কিন্তু ঢাকার সন্তোষজনক অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়টি দিয়ে দিল্লিকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে ভারত যে বিষয়টি লক্ষ্য করছে না, এই পরিবর্তনের পেছনের বৃহত্তর গল্প। আর সেটা হলো, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থানের কৌশলগত ফলাফল।আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো সন্তুষ্ট যে, উপমহাদেশের অবশিষ্ট দেশ এবং বিশ্বের উন্নয়ন দেশগুলোর জন্য ঢাকার অভিজ্ঞতা অসামান্য। ঢাকার থেকে তাদের অনেক কিছুই শেখার রয়েছে। এর নাম দেয়া হয়েছে তথাকথিত ‘বাংলাদেশ মডেল’। এখানে আমাদের ফোকাস অবশ্যই ভিন্ন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের আঞ্চলিক তাৎপর্য থেকে আমরা দেখতে পাই- পাঁচটি দেশকে সে ছাড়িয়ে গেছে।প্রথমত. উপমহাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের এতদিনকার মানসিক মানচিত্র বাংলাদেশের দ্রুত এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বদলাতে শুরু করেছে। গত পাঁচ দশক কিংবা তারও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল বলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বোঝাতো ভারত এবং পাকিস্তান। অন্যান্য দেশগুলোকে সাধারণভাবে বলা হতো এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। বাংলাদেশ অবশ্য কখনোই প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্র ছিল না। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র।কিন্তু প্রতীয়মান হয় যে, এ বিষয়টি ম্যাটার করেনি। বিশ্বের মনোযোগ পাকিস্তানের ওপরেই থেকেছে। কারণ, তার রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। কাশ্মিরের প্রতি তার দাবি। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ। আফগানিস্তানে তার ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তার উষ্ণ সম্পর্ক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থান তাদের সেই ধারণাকে কিছুটা বদলাতে শুরু করেছে। যদি পাকিস্তান থেকে খারাপ সংবাদ আসাটা কখনও শেষ না হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমূর্তি নিয়ে হাজির হচ্ছে।দ্বিতীয়ত. দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের পরিবর্তিত অর্থনৈতিক শক্তির তাৎপর্য। চলতি বছরে বাংলাদেশের জিডিপি আশা করা হচ্ছে প্রায় ৩২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। পাকিস্তান সম্পর্কে ২০২০ সালের পরিসংখ্যান যদিও আইএমএফ-এর কাছে নেই। কিন্তু ২০১৯ সালে পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল ২৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। আর যেটা অধিকতর লক্ষ্যণীয়, সেটা হলো বাংলাদেশ যখন অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিকভাবে ক্রমবর্ধিষ্ণু, তখন আইএমএফ বলছে, চলতি বছরে পাকিস্তানের অর্থনীতি আরো হ্রাস পাবে। অথচ এক দশক আগে পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। যা ছিল বাংলাদেশের থেকে বেশি। আজ বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকে বড় অর্থনীতি হয়েছে একই অংকের ব্যবধানে। এক মার্কিন ডলারে এখন আপনি পাবেন বাংলাদেশি ৮৫ টাকা। আর পাকিস্তানি রুপি পাবেন ১৬২ রুপি। এই যে ধারা এটা নিকট ভবিষ্যতে বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। পাকিস্তান পারেনি। ঢাকার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। ইসলামাবাদের সেটা নেই।এ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই যে, বিশ্বমঞ্চে পাকিস্তানের নেতিবাচক ভূ–রাজনৈতিক ভাবমূর্তি টিকে রইবে। এজন্য সেনাবাহিনী পরিচালিত পেশীশক্তি নির্ভর বিদেশনীতিকেই দায়ী করতে হবে।বাংলাদেশের অবশ্য পাকিস্তানের মতো কোনো আণবিক বোমা নেই। নেই সশস্ত্র ও সহিংস ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা। কিন্তু ঢাকা ক্রমবর্ধিষ্ণু অর্থনৈতিক শক্তি। এটা ধীরে ধীরে সামনের বছরগুলোতে তাকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে আরো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলতে সহায়তা করবে।তৃতীয়ত. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে আঞ্চলিক সংহতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। কেউ পছন্দ করুক, আর নাই করুক, এটাই সত্য যে, এই অঞ্চলটি যে একটি সমষ্টিগত অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে, তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিরোধিতা করে যাচ্ছে। আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসে তার সমর্থন রয়েছে। আর উপমহাদেশের প্রধান আঞ্চলিক ফোরাম সার্ক বর্তমানে কোমায় রয়েছে।প্রথাগতভাবে সার্ক পুনরুজ্জীবনের আশায় না থেকে, দিল্লি কার্যকরভাবেই এখন বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত এবং নেপালের মধ্যে আঞ্চলিকতাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে। উপ-আঞ্চলিক জোট হিসেবে বিবিআইএন চারটি দেশকে যুক্ত করেছে। গত দশকের মাঝামাঝি এটিকে চাঙ্গা করা হয়। কিন্তু এটা যেমনভাবে বেড়ে ওঠার কথা ছিল, তা হয়নি। এখন দিল্লি এবং ঢাকার পক্ষে এটাই উপযুক্ত সময় এই ফোরামটির দিকে নতুন করে তাকানো এবং তার কার্যক্রমের পরিধিকে আরো প্রশস্ত করার দিকে মনোযোগ দেয়া। এবং এটাও লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভুটান এবং নেপালের আকাঙ্ক্ষা ক্রমবর্ধমান।চতুর্থত. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ। যার মধ্যে রয়েছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে এতদিন ঐতিহ্যগতভাবে ভারত এবং পাকিস্তানের দিকেই মনোযোগ রেখেছে, সে এখন বাংলাদেশের সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে জেগে ওঠেছে। মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান গত সপ্তাহে দিল্লি থেকে সফর শুরু করেন। তিনি সেখান থেকে রাওয়ালপিন্ডি না গিয়ে ঢাকায় পৌঁছান। আর এটাই ওয়াশিংটনের পরিবর্তনশীল দক্ষিণ এশীয়নীতির দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশ নিজকে বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মধ্যকার লড়াইয়ে যুক্ত রাখতে চায় না। কিন্তু পরাশক্তি যখন ঢাকাকে তোয়াজ করতে শুরু করেছে, তখন তা ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলের নতুন ভূ-রাজনীতিতে গতি আনবে, সেটাই স্বাভাবিক।চূড়ান্ত কথা হলো, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থান ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক বিকাশে নেয়া ভারতের জাতীয় পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করতে পারে। এটি বিবেচনা করুন: বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে দেড়গুণ বড়; উভয়ের মধ্যে আরও ভাল সম্পর্ক পূর্ব ভারতের জন্য এক বিরাট উৎসাহের উৎস হবে। সুতরাং ভূ-বেষ্টিত উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ বা কানেকটিভিটি ত্বরান্বিত হবে।নিঃসন্দেহে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ জোরদারে বেশ কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে আরও অনেক কিছু সম্ভব- এই সম্ভাবনাগুলো ভারতের নেতিবাচক রাজনীতির দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাঞ্জাবে কংগ্রেস এবং আকালি দলের মুখ্যমন্ত্রীগণ প্রায়শই পশ্চিম পাঞ্জাবের সাথে পাঞ্জাবের মধ্যে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দাবি করছেন। এই ভাবাবেগ লাহোরের শরীফ ভাইদের দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল, কিন্তু রাওয়ালপিন্ডির তীব্র প্রতিরোধের মুখে তা চূর্ণ হয়েছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে দিল্লি এবং ঢাকার মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতা দেখতে বেশ আগ্রহ; তবে কলকাতায় সেবিষয়ে খুব একটা রাজনৈতিক উৎসাহ নেই। আসামে, অভিবাসনের বিষয়টি বড় ধরণের রাজনৈতিক বাধা তৈরি করে চলেছে।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার নিজের দলে বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০১৫ সালে স্থল সীমান্ত বন্দোবস্তের বিষয়ে সংসদীয় অনুমোদন পেয়েছিলেন। তিনি নিজেই এজন্য অনেক রাজনৈতিক কৃতিত্বের দাবিদার। ২০১১ সালে সীমান্ত চুক্তি নিয়ে আলোচনাকারী ইউপিএ সরকার অবশ্য ওই চুক্তির সমর্থনে পর্যাপ্ত রাজনৈতিক সমর্থন জোগাতে পারেনি। মোদি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধের বিষয়ে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিশি পুরষ্কারও গ্রহণ করেছিলেন। মোদির প্রথম মেয়াদে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আশেপাশে অত্যন্ত ইতিবাচক গতিময়তা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে ভারতের বিভিন্ন মহলের বিষাক্ত বক্তব্য তার দ্বিতীয় মেয়াদে নেতিবাচক বাতাবারণ তৈরি করেছে। দিল্লির তরফে এই ধারাটিকে সংশোধন করার জন্য বিরাট সুযোগ খোলা আছে। একইসঙ্গে অতীতের ক্লেদ মুছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকে মনোযোগ স্থানান্তরেরও অনেক সুযোগ রয়েছে।বাংলাদেশ আগামী বছরের মার্চে পাকিস্তান থেকে তার মুক্তির সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মোদি- যিনি এই উদযাপনে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করছেন। তাকে অবশ্যই বিশেষ অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে উদযাপনের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ঢাকাকে বলতে হবে দু’দেশ তাদের সমৃদ্ধ অংশীদারিত্বের বিষয়াবলীর জন্য একটি উচ্চাভিলাষী কাঠামো তৈরি করতে পারে। আর সেটা করা সম্ভব হলে ভারত-বাংলাদেশের সোনালী অধ্যায়টি সংহত হবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি শেখ হাসিনার সঙ্গে তেমন সম্পর্কই গড়ে তুলতে চাইছেন। সি. রাজামোহন: পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ন্যাশনাল স্টাডিজ অব সিঙ্গাপুর এবং প্রদায়ক সম্পাদক, আন্তর্জাতিক বিষয়, দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। নিবন্ধটি ২০ অক্টোবর ‘রাজা মান্দালা : দি গুড নেইবার’ শীর্ষক শিরোনামে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মুদ্রণ সংস্করণে ছাপা হয়েছে। ইংরেজি থেকে হুবহু তরজমা।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত