মাইজভাণ্ডারী গান : বাংলা সংগীতের একটি ব্যতিক্রমী ধারা

দৈনিক আজাদী প্রকাশিত: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:৪৪

.tdi_2_55b.td-a-rec-img{text-align:left}.tdi_2_55b.td-a-rec-img img{margin:0 auto 0 0} (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({}); বাংলা গানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সে ইতিহাস হাজার বছরের ইতিহাস এবং সে ইতিহাস সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। বাংলা গান আমাদের বাংলা ভাষাভাষীদের প্রাণের খোরাক। গানের বহুমাত্রিক জগতে সংগীত প্রেমিরা অবগাহন করে নিজেদের মনের ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। বাংলা গানের জগতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল অবিস্মরণীয় দুটো নাম। যাঁরা বাংলাগানে দুটো ভিন্ন ধারা বা আবহ সৃষ্টি করে আমাদের কাছে চিরকালই স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলা গানে পঞ্চকবির গান বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। এই পঞ্চকবি হলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও অতুল প্রসাদ সেন। এই পঞ্চ কবির গান বাংলা গানে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। যাঁরা গানে নিজস্ব একটা ঘরানা তৈরি করে সংগীত প্রেমিদের বিমুগ্ধ করে রেখেছেন যুগের পর যুগ। এছাড়া আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক জগতের প্রাণ পুরুষ লালন শাহের কথা জানি। তাঁর লালনগীতি মানুষকে ভাব জগতের অন্য একজগতে নিয়ে যায়, যার আবেদন ছড়িয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী। হাসন রাজার গান, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের গান কিংবা মনোমোহন দত্তের গান আমাদের চিন্তা চেতনায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সুতরাং বলা যায় বাংলা গানের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। শুধুমাত্র উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও বাংলা গানে আরো অনেক অনেক ব্যক্তির অবদানে বাংলা গান হয়েছে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর। আমাদের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানেরও আছে বিশেষ একটি আবেদন এবং এ গান আমাদের চট্টগ্রাম তথা দেশীয় সংস্কৃতির অন্যতম একটি অংশও বটে । চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে উদ্ভুত আরেক বিশেষ ধারার গানের নাম মাইজভাণ্ডারী গান। জানা যায় মাইজভাণ্ডারী গানের উদ্ভব ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মহান ধর্মসাধক হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (১৮২৬-১৯০৬) প্রবর্তিত মাইজভাণ্ডারী তরিকার অনুষঙ্গ হিসাবে মাইজভাণ্ডারী গানের প্রচলন । একজন মহান সুফী সাধক ও মাইজভাণ্ডারী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। আহমদউল্লাহ মাইজভাণ্ডারী নামেই তিনি বহুল পরিচিত। মাইজভাণ্ডারী ধারার অনুসারীদের গাওয়া এক ধরণের মরমী গানই হচ্ছে মাইজভাণ্ডারী গান। এই মাইজভাণ্ডারী গানের একটি বিশেষত্ব আছে। বাংলা গানের এই হাজার বছরের পরিক্রমায় যে সব গান সৃষ্টি হয়েছে তাদের রচয়িতার মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই তাদের সে ধারার গানের রচনা শৈলীরও যবনিপাত ঘটেছে। কিন্তু মাইজভাণ্ডারী গান যে ধারায় রচিত তা একটু ব্যতিক্রম। মাইজভাণ্ডারী তরিকার যারা প্রবর্তক তাঁরা কেউ এ ধরণের গান লিখে যান নি। বরং তাঁদের আশেক বা ভক্তগণই তাঁদের গুণগান, কীর্তি, মহিমা বর্ণনা করে গান রচনা করেছেন এবং এই ধারা আজো প্রবাহমান। মাইজভাণ্ডারী গানের এটা একটা অনন্য সাধারণ ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। মারফতি ও মুর্শিদী আমাদের লোক সংগীতে প্রধান দুই ধারা। লোকসঙ্গীতের ধারায় এই ধারার গান রচিত হয় সৃষ্টিকর্তাকে উপলক্ষ্য করে। কিন্তু মাইজভাণ্ডারী গান সাধারণত পীরের শানে রচিত হয়। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, লালনগীতি কিংবা হাসন রাজার গানের নামকরণ হয় যেহেতু তাঁরা সে গানের রচয়িতা, কিন্তু সে অর্থে নামকরণের ক্ষেত্রে মাইজভাণ্ডারী গান হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। মাইজভাণ্ডারী গানের রচয়িতা হলেন মাইজভাণ্ডারের বিভিন্ন শ্রেণির ভক্তপ্রাণ মানুষ। শত বর্ষের পথ পরিক্রমায় মাইজভাণ্ডারী গান সাধন ভজনের নির্ধারিত গণ্ডি অতিক্রম করে বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণে এখনো ভূমিকা রেখে যাচ্ছে নিরন্তর। বাংলার লোকসঙ্গীতের এক বৈচিত্রময় ধারায় মাইজভাণ্ডারী গান স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল এক নাম। অভূতপূর্ব এক আবেদন ছড়িয়ে মাইজভাণ্ডারী গান আজ অনেক সংগীত পিপাসুদের কাছে একটা স্থান করে নিয়েছে । চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডার নামক গ্রাম থেকে এই গান ছড়িয়ে গেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, দেশ থেকে বিশ্বময়। মাইজভাণ্ডার ভক্তদের কাছে মাইজভাণ্ডারী গান যেন প্রেমের এক অমিয় সুধা, যা পান করে চলে যান ভক্তরা ভাব জগতের অন্য এক ভুবনে। মাইজভাণ্ডারী গান ভালোবাসার এক যেনো এক অলৌকিক জগত। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার একটি অতি সাধারণ গ্রাম থেকে এই গান যেভাবে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে তা সত্যি বিস্ময়কর। এই গানের ছটুল তাল, লয়, ছন্দ গানে এক ধরণের দারুণ আবহ সৃষ্টি করে, যা সহজেই শ্রোতাদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম। মাইজভাণ্ডারী গানের এই ক্রমবিকাশমান ধারায় এবং সারা বিশ্বে তার আবেদন ছড়িয়ে দেবার পেছনে তিনজন অন্যতম দিকপালেরর নাম অগ্রগণ্য। তাঁরা হলেন মওলানা আব্দুল হাদী কাঞ্চনপুরী, কবিয়াল রমেশ শীল ও আব্দুল গফুর হালী । তাঁরা তিনজন মাইজভাণ্ডারী গানের তিন কালের মহান রচয়িতা। মওলানা হাদী কাঞ্চনপুরীকে মাইজভাণ্ডারী গানের উদ্ভাবক বলা যায়। জানা যায় মাওলানা হাদী ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মাইজভাণ্ডারী গান রচনা করে প্রথম আলোচনায় আসেন। কবিয়াল রমেশ শীল যে ধারার মাইজভাণ্ডারী গানের প্রবক্তা তাঁর সময়কাল বিংশ শতাব্দীর বিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত বিস্তৃত। আর আব্দুল গফুর হালী হলেন এই মাইজভাণ্ডারী গানের আধুনিক নবযুগের অন্যতম দিকপাল। যাঁর গান নিয়ে দেশে বিদেশে বহু গবেষণা হয়েছে। ষাটের দশক থেকে আমৃত্যু মাইজভাণ্ডারী গান রচনা, সুরারোপ ও সর্বোপরি গাওয়াতে নিবেদিত ছিলেন গফুর হালী। অবশ্য গাওয়ার চেয়ে মাইজভাণ্ডারী গান রচনা এবং তা প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। মাইজভাণ্ডারী গান সুফী দর্শন, মানব ধর্মের আদর্শ দ্বারা লালিত। ফলে মাইজভাণ্ডারী গান-জাতি, ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের মন জয় করে নিয়েছে সহজেই। আধ্যাত্মিক ধারার এই গান সময়ের স্রোতে লোকসঙ্গীতের এক অনন্য ধারায় রূপ লাভ করেছে বলা যায়। শতবর্ষের ইতিহাসে মাইজভাণ্ডারী গানের রূপ, রঙ আঙ্গিক অপরিবর্তিত থাকলেও কথা ও বিষয় ভাবনায় এসেছে নব নব ধারণা। মাইজভাণ্ডারী গানের রচয়িতা হিসাবে রমেশ শীলের নাম চিরস্মরণীয় এবং শিল্পী হিসাবে নাসিরের অবদানও অবিস্মরণীয়। মরমী শিল্পী ফিরোজ সাঁইয়ের কণ্ঠে রমেশ শীলের লেখা মাইজভাণ্ডারী গান ‘ইশকুল খুইলাছে রে মওলা ইশকুল খুইলাছে, গাউছুল মাইজভাণ্ডারী ইশকুল খুইলাছে’ মাইজভাণ্ডারী গানের সাড়া জাগানিয়া এক গান। এরপর আবদুল গফুর হালীর লেখায় কল্যাণী ঘোষের কণ্ঠে গাওয়া গান ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে হইতাছে নূরের খেলা, ওরে মন বসাইলো প্রেমের মেলা’ আরেক জনপ্রিয় গান। নজরুল ইসলাম সাধকপুরীর লেখা মাইজভাণ্ডারী গান ‘আমার গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী আয়নার কারিগর, আয়না বানাইয়া দেনা তলবের ভিতর’ গানটিও মাইজভাণ্ডারী গানের এক মাইলফলক। এ গানগুলো বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে পরবর্তীতে রেকর্ড হয় এবং এখনো গানগুলো সমান জনপ্রিয়। গীতিকার ও শিল্পী এম এন আখতারের লেখা সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া ‘আমি ঐ গাউছিয়া একটি নামের দিওয়ানা’ গানটিও কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়। মাইজভাণ্ডার হিন্দু মুসলিম,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান সকল জাতির অপূর্ব এক মিলনকেন্দ্র। শত বছরে পথ পরিক্রমায় মাইজভাণ্ডারী দর্শন আবহমান গ্রাম বাংলায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এবং সেই দর্শনের সাধন সংগীত আমাদের লোক সংস্কৃতির সঙ্গে রচিত করেছে চমৎকার এক মেলবন্ধন। বিশিষ্ট লোক গবেষক, ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. শামসুজ্জামান খান মাইজভাণ্ডার তরিকার এ গান সম্পর্কে বলেন ‘সমন্বয়বাদী এক সমৃদ্ধ সঙ্গীত ধারার নাম মাইজভাণ্ডারী গান।’ আন্তর্জাতিক ফোকলোর বিশেষজ্ঞ, ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের প্রফেসর ড. লাউরি হারবিলাত্তির মতে, ‘মাইজভাণ্ডারী গান বাংলার লোক সঙ্গীতের সমৃদ্ধ একটি ধারা। মাইজভাণ্ডারী গানে মাধুর্যতা আছে, তন্ময়তা আছে, গভীরতা আছে। এর পাশাপাশি লৌকিক গানের যে সৌন্দর্য,তাও আছে। এতদসঙ্গে সাধন তত্ত্‌বও আছে।’ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বনামধন্য এই দুই বিশেষজ্ঞের সুগভীর চমৎকার বিশ্লেষণে মাইজভাণ্ডারী গানের অনন্য এ বিশেষত্ব ফুটে উঠেছে, যা বেশ তাৎপর্য বহন করে। বৈষ্ণব পদাবলীতে যেমন চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতির নাম, বাউল গানের ক্ষেত্রে বাউলসম্রাট লালন ফকির,পাঞ্জুশাহ, সহ আরো অনেকের নাম উচ্চারিত হয় ঠিক তেমনি মাইজভাণ্ডারী গানের কথা সম্মুখে এলে কয়েকটি নাম সামনে আসে যেমন মাওলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরি, মাওলানা আবদুল গনি কাঞ্চনপুরি, মাওলানা বজলুল করিম, আবদুল্লাহ বাঞ্ছারামপুরি, কবিয়াল রমেশশীল, সাম্প্রতিক কালের মরহুম আবদুল গফুর হালী, সৈয়দ মহিউদ্দীন প্রমুখ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে মাইজভাণ্ডারী গানের একটি বিশেষত্ব পরিলক্ষিত হয়। যা মাইজভাণ্ডারী গানকে করেছে আরো মানবিক মূল্যবোধে ঋদ্ধ। কবিয়াল রমেশ শীলের রয়েছে এরকম কিছু গান যেমন- ‘হিন্দু মুসলিম দ্বন্‌দ্ব কোন কথার সাধনায় জাতি কুলের টান থাকিলে জাতি কুলে সময় যায়’, কিংবা হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকল ধর্মের এক কথা নীতি রদবদল মাত্র, গন্তব্য স্থান দুটি কোথা? রমেশ শীলের রয়েছে আরো কিছু বিখ্যাত গান। রমেশ শীল মাইজভাণ্ডারী গানের একটি কিংবদন্তির নাম। মাইজভাণ্ডারী গান রচনা ও তা গেয়ে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অগ্রগণ্য। মাইজভাণ্ডারীর সৈয়দ গোলামুর রহমান (১৮৬৫-১৯৩৭) তাঁর প্রায় সমসাময়িক ছিলেন। মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রবর্তক সৈয়দ আহমদউল্লাহ (১৮২৬-১৯০৬) গুণকীর্তন ও এ ধারার আধ্যাত্মিক মহিমা তুলে ধরে তিনি বহু মাইজভা-ারী গান রচনা করে গেছেন। তাঁর এ ধরণের গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশোর মত বলে জানা যায়। রমেশ শীল একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্ত মনের অধিকারী ছিলেন। তার রচিত গানগুলি আশেকমালা, শান্তিভাণ্ডার, মুক্তির দরবার, নূরে দুনিয়া জীবনসাথী, সত্যদর্পণ, ভাণ্ডারে মওলা, মানববন্ধু ও এস্কে সিরাজিয়া নামক বইগুলোতে সন্নিবেশিত হয়েছে। রমেশ শীলের কিছু বিখ্যাত মাইজভাণ্ডারী গান। ১.গাউছুল আজম বাবা নূরে আলম, তুমি ইছমে আজব বাবা তরানেওয়ালা ২.আজব কারিগর বন্ধুয়া আজব কারিগর ৩.দেখা দিও প্রাণবন্ধু আজ নিশীতে ও নিদানের বন্ধু আমার গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী ৪.মাইজভাণ্ডারী মাওলা আমার পরাণের পরাণ ৫. একলা বসে বিরহ বাসে তোমারি আশেক গাহিব গান ৬.একি চমৎকার, ভাণ্ডারেতে আজগুবি কারবার ৭.ভাণ্ডারী রহিম রহমান, কে বুঝিতে পারে তোমার কুদরতী গুলশান ৮.গাউছুল আজম মাওলা ধন । গফুর হালী রচিত মাইজভাণ্ডারী গানের জগতে আরেক কিংবদন্তীর নাম। তাঁর গান ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে দেশ বিদেশে বহু গবেষণা হয়েছে। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. হান্স হার্দার তাঁর গান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখেন ‘গফুর হালী এমন কিছু পঙক্তি রচনা করেছেন যাতে তিনি তাঁর প্রভু আল্লাহর কাছে আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধান খুঁজে বেড়ান। তার মতো অসংখ্য গায়ক ও সাধক নানা ভাবে মাইজভাণ্ডারী গান পরিবেশন করে আধ্যাত্মিক দর্শনের মাধ্যমে আল্লাহকে খুঁজে পেতে চান।’ (দিওয়ানে মাইজভাণ্ডারী রচনা-আবদুল গফুর হালী। স্বরলিপিসহ মাইজভাণ্ডারী গান) আবদুল গফুর হালীর গানের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজারের মতো। এতে রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণির গান। তার লেখা স্বরলিপিসহ মাইজভাণ্ডারী গানের বই ‘দিওয়ানে মাইজভাণ্ডারী’ তে জনপ্রিয় একশত গান সংকলিত হয়েছে। যা মাইজভাণ্ডারী গানের জগতে এক অমূল্য সম্পদ। তার লেখা কিছু জনপ্রিয় মাইজভাণ্ডারী গান- ১.দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে হইতেছে নুরের খেলা’, ২.মাইজভাণ্ডারে কী ধন আছে চামড়ার চোখে দেখবি না ৩.আর কতকাল খেলবি খেলা ৪.নতুন ঘরে যাব আমার এই ঘরে আর মন বসে না ৫.নাচ মন তালে তালে মাওলার জিকিরে ৬. তোরা ভালমন্দ যা খুশি বল, পরোয়া আমি করি না ৭. কোন সাধনে তারে পাওয়া যায় ৮.আমি আমারে বেইচা দিছি মাইজভাণ্ডারে যাই রে,আমার কিছু নাই ৯.কাষ্টের উপর চামড়া দিয়ে কে বানাইল ঢোল,এই ঢোলরে কে শিখাইল আল্লাহ আল্লাহ বোল ১০. বাজারে বাজারে তোরা মাইজভাণ্ডারী ঢোল। তাঁর লেখা অসংখ্য গান মাইজভাণ্ডারী সাধনার অনুপম অন্যতম অনুষঙ্গ, এদেশের একশ্রেণির মানুষের সাংস্কৃতিক ও মনোজগতের চাহিদা পূরণে অবদান রাখছে। সৈয়দ মহিউদ্দীন ( প্রকাশ মহি-আল ভাণ্ডারী)এরও কিছু জনপ্রিয় মাইজভাণ্ডারী গান আছে। যেমন- ১. আমার সকল ব্যবসা গুনাগারী যায় ২.চার তরিকার চৌমুহনী মাইজভাণ্ডারে যারে যা। ৩. আঁরে কন কামত বাজাই রাখিলা গাউছে মাইজভাণ্ডার ( চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়)। সেই শতবছর আগে থেকে মাইজভাণ্ডারী গান লেখা হচ্ছে বলে তথ্য জানা। এপর্যন্ত দশহাজারেরও বেশি মাইজভাণ্ডারী গান রচিত হয়েছে। মাইজভাণ্ডারী গানকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসার পিছনে আছে অনেকের অবদান। সেই শতবছর আগে থেকে যাঁরা মাইজভাণ্ডারী গান রচনায় ব্যাপৃত ছিলেন তাঁরা হলেন আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী (রঃ), আবদুস সালাম ভুজপুরী, আবদুল মালেক কাঞ্চনপুরী, হজরত মাওলানা বজলুর করিম মন্দাকিনী, হজরত মাওলানা আবদুর রহমান( প্রকাশ আবদুল্লাহ বাঞ্চারামপুরী, হজরত আবদুল জব্বার শাহ মীমনগরী, আবদুল লতিফ চন্দনাইশী, হজরত আমিনুল হক ধর্মপুরী, হজরত নসীম প্রমুখ। সে সময়ে রচিত কিছু জনপ্রিয় গান এখানে উল্লেখ করা হলো। মাইজভাণ্ডারী গানের উদ্ভাবক আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরীর গান ১. কে দিলো জ্বালাইয়ে বলো কারো নিঠুর মন ২.আমার প্রাণ হরে যায় আমার দিল হরে যায় ৩.না জানি কি গুণ আছে চরণে তোমার ৪.আমি কি পাবো তাহারে, সদা মনে প্রাণে ভালোবাসি যাহারে ৫.আমার প্রাণ ভোমরা আয়গো হৃদ বাগানে ৬. চলো গো প্রেম সাগরে। বজলুর করিম মন্দাকিনী রচিত কয়েকটি গান ১. কে তুমি হে সখা আড়ালে থাকিয়া হরিলে আমারি প্রাণ ২.এক বিনা দ্বিতীয় নাস্তি সকল ধর্মে একই তত্ত্‌ব ৩.আমি যে পাতকী পাপী মহাদোষে দোষী হই। আমিনুল হক ধর্মপুরীর ‘তোরা দেখবি যদি খোদার ঘর’ এরকম অনেক গানের কথাই বলা যায়। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা গান লিখছেন সৈয়দ মহিউদ্দীন (প্রকাশ মহি আল ভাণ্ডারী), শাহেদ আলী চৌধুরী, মাওলানা সলিমউল্লাহ, দুদু চৌধুরী, আবু সাদাত সায়েম সুমন,সৈয়দ কামরুল হাসান, শেখ নিজামউদ্দীন, সমসু মাইজভাণ্ডারী, জিকে দত্ত, স্বপন কুমার দাশ, রফিক তালুকদার প্রমুখ। ফিরোজ সাঁই,ফকির আলমগীর, ফকির সাহাবুদ্দীন, জানে আলম, মমতাজ, কল্যাণী ঘোষ, শেফালী ঘোষের মত শিল্পীরা মাইজভাণ্ডারী গান পৌঁছে দিয়েছেন গণমানুষের হৃদয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে মরমী শিল্পী শিমুল শীল মাইজভাণ্ডারী গানে অনন্য এক নাম। আবদুল গফুর হালী সাথে শিমুল সর্ম্পক ছিলো গুরু শিষ্যের। এছাড়া মফিজুর রহমান,সৈয়দ জাবেদ সরোয়ার, সৈয়দ কামরুল হাসান, সৈয়দ আদিল মাহবুব আকবরী, মুসলিম আলী জনি, আহমদ নূর আমিরী, নয়ন শীল, বাবুল শীল, সেলিম নিজামী, আবদুল মন্নান কাওয়াল প্রমুখরা মাইজভাণ্ডারী গান গেয়ে এই মাইজভাণ্ডারী গানের ভুবনকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এছাড়া প্রয়াত সৈয়দ নিজামউদ্দীন মন্টু, জুনু পাগলা, আবু ইউসুফ টুনু কাওয়াল মাইজভাণ্ডারী গান গেয়ে সমাদৃত হয়েছেন। বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের মত মাইজভাণ্ডারী গানেরও একটি বিভাগ আছে, অডিশনে পাস করেই বেতারে মাইভাণ্ডারী গানের শিল্পী নির্বাচিত করা হয়। উল্লেখিত শিল্পীগণের অনেকেই মাইজভাণ্ডারী গানের তালিকাভুক্ত শিল্পী। টেলিভিশনে মাইজভাণ্ডারী গানের অনুষ্ঠান এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। মাইজভাণ্ডারের ওরশের সময় বেতার ও টেলিভিশন মাইজভাণ্ডারী গানের বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। অভিনেতা ও নির্দেশক তৌকির আহমেদ পরিচালিত আলোচিত ‘হালদা’ চলচ্চিত্রে শিল্পী সৈয়দ জাবের সরোয়ার ও তাঁর সহশিল্পীদের কণ্ঠে রমেশ শীল রচিত জনপ্রিয় গান ‘গাউছুল আজম বাবা নুরে আলম, তুমি ইছমে আজম বাবা তরানেওয়ালা’ গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। এটিও মাইজভাণ্ডারী গানের অনন্য একটি দিক। মাইজভাণ্ডারী গান আমাদের চট্টগ্রাম তথা দেশীয় সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। মাইজভাণ্ডারী গান পীর আউলিয়ার শানে রচিত হলেও এর সুফি দর্শন ও আধ্যাত্মিকতাবাদ সব ছাপিয়ে আমাদের লোক সংস্কৃতির ভাণ্ডারকেই সমৃদ্ধ করেছে।লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক; সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ চট্টগ্রাম।.tdi_3_f5b.td-a-rec-img{text-align:left}.tdi_3_f5b.td-a-rec-img img{margin:0 auto 0 0} (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে