দোষটা মধ্যবিত্তের ছিল না
ঢাকা শহরের বাড়িগুলোতে ঝুলছে টু-লেট বিজ্ঞাপন৷ সড়কে দেখা যাচ্ছে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ার ঢল৷ আলোচনা চলছে, মাত্র তিন মাস টিকতে না পারার দোষটা মধ্যবিত্তের ছিল কিনা৷ না, দোষটা মধ্যবিত্তের ছিল না৷
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি লেখা বেশ ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে মাত্র তিন মাস সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে ঢাকায় টিকতে না পারার পেছনে মধ্যবিত্তের দোষ খোঁজা হচ্ছে৷ মধ্যবিত্তের দখলে থাকা ফেসবুকে সেগুলো আবার শেয়ার দিচ্ছেন মধ্যবিত্তরাই৷ দোষগুলোর মধ্যে যেসব উদাহরণ দেয়া হয়েছে, আপাত দৃষ্টিতে সঠিক মনে হলেও আসলে কি তাই?
মধ্যবিত্তের লাইফস্টাইল, আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদিকে সবসময়ই একটু জটিল বলে ধরে নেয়া হয়৷ মনস্তত্ত্ববিদ থেকে শুরু করে অর্থনীতিবীদরাও একথা একবাক্যে স্বীকার করেন৷ যে-কোনো দুর্যোগে সবচেয়ে সংকটে ভোগেন মধ্যবিত্তরাই৷ তারা যেমন একটি রাষ্ট্রকে নানা দিক থেকে এগিয়ে নেন, তারাই আবার নিজেদের শ্রেণিকে বাঁচাতে যে-কোনো দুরবস্থার সৃষ্টিও করতে পারেন৷ কিভাবে? একটু ব্যাখ্যা করে বলছি৷
মধ্যবিত্ত এমন একটি শ্রেণি যাদেরকে মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদরা পেটি-বুর্জোয়া বলে উল্লেখ করে থাকেন৷ তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক দিক দিয়ে শ্রমিক বা নিম্নবিত্তের কাছাকাছি থাকলেও লাইফস্টাইল বা চিন্তাচেতনার দিক দিয়ে সবসময় উচ্চবিত্তের আসনে যেতে চান৷ কিন্তু সেজন্য যে ঝুঁকি নেয়া প্রয়োজন, সেটি তারা কখনোই নিতে চান না৷ অর্থাৎ, সবসময়ই এক ধরনের নিশ্চয়তার বোধ তারা খুঁজে ফেরেন, যাতে কখনোই উচ্চবিত্তের আসনে যেতে না পারলেও আবার নিম্নবিত্তে ফিরে যেতে না হয়৷ এই মানসিক সংকট নিম্নবিত্ত বা উচ্চবিত্তের তুলনামূলক অনেক অনেক কম৷
এক মুঠো চাল জমানো, প্রয়োজনে না খেয়ে, না পরে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করা, বিসিএস দেয়ার মাধ্যমে ‘কখনো চাকরি যাবে না' ব্যাপারটা নিশ্চিত করা ইত্যাদি হচ্ছে একেবারেই মধ্যবিত্তের চিরাচরিত আচরণ৷
আগে আমাদের বাবা-মায়েরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করতেন না৷ বাইরে কম খেতে যেতেন, টাকা জমিয়ে জমি কিনতেন৷ কথা খুবই সত্য৷ এখনকার শহুরে মধ্যবিত্তের সঙ্গে এ আচরণ একেবারেই মানানসই নয়৷ কিন্তু এই লাইফস্টাইলে কেন পরিবর্তন এসেছে, সেটিই হচ্ছে মূল ব্যাখ্যার বিষয়৷ আগে আমাদের বাবা-মায়ের সব মিলিয়ে আয় কত ছিল? তখন বিদ্যুৎ থাকতো কয় ঘণ্টা? মোবাইল ফোন ছিল? ইন্টারনেট, এত এত টিভি চ্যানেল কি তখন ছিল? সামগ্রিক হিসেবে পুরো দেশের জীবনমানেই উল্লম্ফন ঘটেছে৷ কিন্তু খরচ বাঁচাতে নিশ্চয়ই আমরা এখন আবার হারিকেনের আলোয় পড়াশোনার যুগে ফেরত যাবো না৷