অবৈধ নৌযানের ডাটাবেজ নেই নৌমন্ত্রণালয়ে
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এই দেশে সবচেয়ে আরামদায়ক ভ্রমণ হলো নৌভ্রমণ। অথচ সারাদেশে ছোট-বড় মিলে কত নৌযান চলাচল করে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই নৌ মন্ত্রণালয়ে। নেই অবৈধ নৌযানের ডাটাবেজও। সারাদেশের নৌযানের ডাটা তৈরির জন্য একটি প্রকল্প নেয়া হলেও পরিকল্পনা কমিশনে তা আটকে আছে। কবে নাগাদ ডাটাবেজের কাজ শুরু করা হবে তা-ও জানে না নৌ মন্ত্রণালয়।
বেসরকারি সূত্র বলছে, লঞ্চের ফিটনেসের অভাব, চালকদের অদক্ষতা, ফিটনেসের কাগজ তদারকির অভাব, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ও অদক্ষ চালকসহ ১০টি কারণে গত ২৫ বছরে প্রায় চার শতাধিক নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় চার হাজারের অধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আর অবৈধ নৌযানও দুর্ঘটনার বড় কারণ।
সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ ইনল্যান্ড সিপিং অর্ডিনেন্স (আইএসও) ১৯৭৬ এর অধীনে প্রণীত বিধি অনুযায়ী, নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ, মাস্টার ও ড্রাইভারের সনদ যাচাই এবং যাত্রীসংখ্যা গণনার পরই তা ছাড়ার অনুমতি দেয়ার (ভয়েজ ডিক্লারেশন) বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ দায়িত্ব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বন্দর এবং নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক (নৌ-নিট্রা) বিভাগের। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্দর কর্মকর্তা ও ট্রাফিক ইন্সপেক্টররা (টিআই) এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না বলে জানা গেছে। এছাড়া অবৈধ নৌযান চলাচল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, নৌপথে দিক-নির্দেশক বিকন ও বয়াবাতি না থাকা, নাব্যতা সংকট ও ডুবোচর, নৌপথে কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখা এবং আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঘটছে লঞ্চ দুর্ঘটনা।
সর্বশেষ গত সোমবার (২৯ জুন) সকাল ৯টার দিকে মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা দোতলা মর্নিং বার্ড লঞ্চটি সদরঘাট কাঠপট্টি ঘাটে ভেড়ানোর আগ মুহূর্তে চাঁদপুরগামী ময়ূর-২ লঞ্চটি ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ডুবে যায়। লঞ্চডুবির ওই ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ‘এমএল মনিং বার্ড’কে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয়ার সময় ঘাতক লঞ্চ ‘ময়ূর-২’ এর মূল মাস্টার নয় এমন একজন শিক্ষানবিশ চালাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। লঞ্চের কোনো ত্রুটি নয়; মাস্টারের ভুলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ত্রুটিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও এমভি মিরাজ-৪ ও এমভি শাতিল-১ দুটি যাত্রীবাহী নৌযানকে দেয়া হয় ফিটনেস সনদ
২০১৪ সালের ১৫ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে এমভি মিরাজ-৪ এবং এর মাত্র ১২ দিন আগে ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপায় রামদাবাদ নদীতে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এমভি শাতিল-১। দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দফতরের নথিপত্র যাচাই, লঞ্চ দুটির নকশা ও অবকঠামো পরীক্ষা এবং তদন্ত কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে জানা গেছে, যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও এ দুটি যাত্রীবাহী নৌযানকে ফিটনেস সনদ দেয়া হয়েছিল। অবকাঠামোগত মারাত্মক ত্রুটির কারণেই সামান্য কালবৈশাখী ঝড়ের আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে লঞ্চ দুটি ডুবে যায়। এছাড়া এমভি মিরাজ-৪ ও এমভি শাতিল-১ দুটি লঞ্চেই ছিলেন অদক্ষ মাস্টার। তারা আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও তাৎক্ষণিক ঘূর্ণিঝড় উপেক্ষা করে নৌযান দুটি চালাচ্ছিলেন।
পিনাক-৬ এর ফিটনেস সনদ না থাকার পরও টোকেনের মাধ্যমে চলাচলের অনুমতি
২০১৪ সালে ৪ আগস্ট। স্মরণকালের ভয়াবহ লঞ্চডুবি ঘটে পদ্মার বুকে। ঈদের পর হওয়ায় লঞ্চে ছিল ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী। ভরা বর্ষার উত্তাল পদ্মায় শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬। সরকারিভাবে ওই দুর্ঘটনায় ৪৯ জন এবং বেসরকারি হিসাবে ৮৬ জন যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। জীবিত কিছু যাত্রী উদ্ধার হন বিভিন্ন উপায়ে। নিখোঁজ থাকেন ৫৩ জন। যাদের হদিস আজও মেলেনি। ফিটনেস না থাকার পরও এই লঞ্চটিকে টোকেনের মাধ্যমে সাময়িক চলাচলের অনুমতি নেয়া হয়েছিল বলে নৌপরিবহন অধিদফতর সূত্র জানায়।
লঞ্চমালিক নিজেই বলতে পারেননি মাস্টার-ড্রাইভারের নাম
২০১২ সালের ১২ মার্চ মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে নিমজ্জিত হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি শরীয়তপুর-১। এই দুর্ঘটনার পর উদ্ধার করা হয় ১৪৭টি লাশ। ভয়াবহ এই ট্র্যাজেডির পর সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দুর্ঘটনাকবলিত দোতলা লঞ্চটির মাস্টার ও ড্রাইভারের নাম লঞ্চমালিক নিজেই বলতে পারেননি বলে তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়।
মর্নিং বার্ড, এমভি মিরাজ-৪, এমভি শাতিল-১, পিনাক-৬ ও এমভি শরীয়তপুর-১ এর মতো অধিকাংশ দুর্ঘটনার পড়া লঞ্চের অবস্থা একই ধরনের। দেখা গেছে, কোনো লঞ্চের ফিটনেস সনদ নেই, কোনোটাতে অদক্ষ চালক আবার কোনোটার মাস্টার ও ড্রাইভারের পরিচয় জানেনা মালিক।