ভিটামাটিহারা পাঁচ শতাধিক পরিবার
লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষিত আসনের এমপি সেলিনা ইসলাম ও শ্যালিকা ইয়াসমিনের থাবায় কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার পাঁচ শতাধিক পরিবার এখন ভিটামাটি হারা। সেলিনা ও তাঁর স্বজনদের ড্রেজারের হানায় কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার দুটি ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের এক হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত, যার মধ্যে ভিটামাটি বিলীন হয়েছে পাঁচ শতাধিক পরিবারের। একইভাবে শত বছরের পুরনো স্কুল, মসজিদ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানও মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে।
ভিটামাটি হারানো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো প্রতিকার চেয়ে এমপি সেলিনা ইসলাম ও তাঁর ক্যাডারদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট মামলাসহ জেলা প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বিভিন্ন দপ্তরে বারবার অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পায়নি। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এমপি সেলিনা ও তাঁর স্বজনদের ক্যাডার বাহিনী দিনের পর দিন এভাবে ফসলি জমি ড্রেজিং করে সাবাড় করেছে। এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় সেলিনার লোকজন উল্টো মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলা দিয়ে হয়রানি করছে ক্ষতিগ্রস্তদের।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে গিয়েছিলেন একসময়ের হতদরিদ্র সেলিনা। সেখানে কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে বিয়ে হয়। পরবর্তী সময়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে মানবপাচার ও ভিসা ট্রেডিংসহ বিভিন্ন জালিয়াতির মাধ্যমে হয়ে যান হাজার কোটি টাকার মালিক। ২০০৭ সালে সেই সেলিনার চোখ পড়ে মেঘনা উপজেলার বালুমহালের দিকে। এরপর এমপি হয়ে বালুমহাল লুটে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। এমপি সেলিনার নির্দেশে অবৈধভাবে মেঘনা উপজেলার ছয়টি গ্রামের চরের মাটি কাটা শুরু হয়। প্রথম দিকে কোনো ইজারা ছাড়াই মাটি কাটা শুরু করলেও ২০১১ সালে সেলিনা তাঁর মালিকানাধীন ফোর পয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের লাইসেন্সে সরকার থেকে কয়েকটি বালুমহাল ইজারা নেন। কিন্তু ইজারাকৃত মহাল ছেড়ে সাধারণ মানুষের ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার মহোৎসব শুরু করে দেয় সেলিনার বোন ইয়াসমিন প্রধানের ক্যাডার বাহিনী।
শুধু সেলিনার ঠিকাদারি লাইসেন্সই নয়, তাঁর পিএস বশিরের নামে থাকা ফাহাদ ট্রেডার্স ও ভাতিজা জাকির হোসেনের নামে করা জালাল এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমেও মেঘনা উপজেলায় শত শত বিঘা জমি কেটে নেওয়া হয়। এভাবে বালুমহালের নামে সেলিনার সিন্ডিকেট প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ফসলি জমির মাটি কেটে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করে ক্ষতিগ্রস্তরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের রামপ্রসাদের চর গ্রামের মৃত মোন্তাজ উদ্দিনের ছেলে হোসেন মোহাম্মদ মোহসিন এমপি সেলিনার থাবায় হারিয়েছেন সাড়ে তিন বিঘা জমি। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে দুদক, জেলা প্রশাসন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ দেওয়াসহ উচ্চ আদালতে তিনটি রিট মামলাও করেছিলেন মোহসিন। এতে চরম ক্ষুব্ধ হয়ে সেলিনার লোকজন মোহসিনসহ তাঁর ছয় ভাইয়ের বিরুদ্ধে উল্টো ছয়টি মামলা দিয়ে হয়রানি শুরু করেন। চুরি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলাগুলো করা হয় জমি হারানো ওই ছয় ভাইয়ের বিরুদ্ধে। ক্ষতিগ্রস্ত মোহসিন বলেন, ‘এমপি সেলিনা ইসলাম ও তাঁর বোন, ভাতিজা, ভাগ্নে এবং পিএসের লাইসেন্স দিয়ে নামমাত্র কিছু বালুমহাল ইজারা নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে কেটে নিয়েছে আমাদের ফসলি জমি। বাধা দেওয়ায় উল্টো মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের হয়রানি করছেন। এই সেলিনা সিন্ডিকেটের কারণে উপজেলার পাঁচ শতাধিক পরিবার ভিটামাটি হারিয়েছে।’ গত ২৪ জুন কুমিল্লা জেলা প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনেও এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে একটি আবেদন করেছেন মোহসিন।
ক্ষুব্ধকণ্ঠে তিনি বলেন, ‘গত ১২ বছরে এই অবৈধ মাটি কাটার বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন, থানা, জেলা প্রশাসন, দুদক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু সেলিনার মাটি কাটা কেউ বন্ধ করতে পারেনি।’ চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের আব্দুল বারীর মালিকানাধীন রামপ্রসাদের চরের পশ্চিম পার ও পূর্ব পারের ২৫ বিঘা জমির মাটি অবৈধভাবে কেটে নিয়েছেন এমপি সেলিনা ও তাঁর স্বজনরা। মাটিখেকোদের কারণে পশ্চিমপাড়ায় রামপ্রসাদের চরের শুধু জমিই বিলীন হয়নি, মেঘনাগর্ভে চিরতরে হারিয়ে গেছে পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ ও পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও।
স্থানীয় হবীবুল্লাহ মাস্টার, ডা. শরিয়াতুল্লাহ, ডা. আব্দুস সালাম, ইমাম হোসেন, আ. লতিফ দোকানদার, নুরুল আমিন, শাহাবুদ্দিন আমিন, শাহজাহান, সেন্টু, মুকবুল, মোন্নাফ, আ. মজিদ, আলেক, ফালু, আ. আউয়াল, মানিক মিয়া, সোলেমান, জামাল, কামাল, মোস্তফা, সাখাওয়াত, কুদ্দুস সরকার, নজরুল সরকার, বারু সরকারসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অভিযোগ, তৎকালীন মেঘনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা পারভিনসহ ভূমি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করেই সেলিনা ইসলাম ইজারার নামে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন এবং জোরপূর্বক মাটি কাটার উৎসব জারি রেখেছেন। সেলিনার কাছ থেকে প্রতি মাসে মাসোহারা পায় প্রশাসনের ওই সিন্ডিকেট। শুধু তা-ই নয়, উচ্চ আদালতে রিট মামলা চলমান থাকার পরও কুমিল্লা জেলা প্রশাসন মেঘনা উপজেলার বালুমহালের দরপত্র আহ্বান করেছে, যা আইনত কোনোভাবেই করতে পারে না।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে মেঘনা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভিযোগ সত্য। একটি সিন্ডিকেটের কারণে কয়েক শ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে ওদের এমন অন্যায় কাজ করতে দিইনি। সরকারের উচিত এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন এমপি সেলিনা ইসলামের ছোট বোন ইয়াসমিন প্রধান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বালুমহাল ইজারা নিইনি, আমার লাইসেন্সে অন্য কাজ করি।’ কিন্তু এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অভিযোগ, বোনের পক্ষ হয়ে আপনিই এসব দেখভাল করেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘বোনের কাজ বোনই করেন। আর আমার বোন আগে এটা করেছেন, এখন করেন না।’