ইমন একাই এক শো
গায়ে, হাতে, পায়ে নানা কিছু বাঁধা। পিঠে ঝোলানো ড্রামস। কাঁধে গিটার। এক পা ওঠালেই ঘাড়ের কাছে থাকা ড্রামসের স্টিক নড়ে উঠছে, বেরিয়ে আসছে সুর। চিরকুট ব্যান্ডের ইমন চৌধুরীর ফেসবুক পেজে দেওয়া ভিডিওতে এমনই দেখা গেল। আপাদমস্তক কাজে লাগিয়ে ওয়ান-ম্যান ব্যান্ডের দায়িত্ব সফলভাবেই পালন করলেন তিনি। অনেক দিনরাত পরিশ্রমের ফসল এটি। লিখেছেন আদর রহমান। স্বপ্নের শুরু বছর দুই ধরে একটু একটু করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন ইমন চৌধুরী।
স্বপ্নটা এমন, যেটা আগে আশপাশের কাউকে কখনো করতে দেখেননি। কীভাবে, কবে, কোত্থেকে কী আসবে কিছুই জানা ছিল না। তবু ওয়ান-ম্যান ব্যান্ডের (এক সদস্যের ব্যান্ড) স্বপ্ন ইমন মনের কোণে পুষে গেছেন। একেক জায়গা থেকে স্বপ্নের একেক টুকরো কুড়িয়ে এনেছেন, জড়ো করেছেন নিজের স্টুডিওতে। টুকরোগুলো জুড়তে জুড়তে এতটা সময় লেগে গেছে। কিন্তু দেরিতে হলেও দারুণভাবেই স্বপ্নটা সত্যি করলেন ইমন। প্রথমে এল ড্রামস দেড় বছর আগের কথা। মাথার ভেতর ওয়ান–ম্যান ব্যান্ডের নকশাটা এঁকে নিয়েছিলেন। কারিগরি কাজ শুরুর জন্য দরকার বাদ্যযন্ত্র। মাথায় অনেক অনেক প্রশ্ন আর দ্বিধা। সব নিয়েই ইমন চলে গেলেন আর্বোভাইরাস ব্যান্ডের সদস্য নাফিজের কাছে। নাফিজের ড্রামস বানানোর একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখান থেকে আন্তর্জাতিক মানের ড্রামস তৈরি হয়। ইমন তাই কাঁধে ঝোলানোর উপযোগী একটা ড্রামস বানাতে নাফিজের শরণাপন্ন হন।
শুরুতে সংকোচ ছিল, ওয়ান–ম্যান ব্যান্ডের কথা শুনে না জানি লোকে উন্মাদ ভেবে বসে তাঁকে! তাই শুরুতে নাফিজকে জানিয়েছিলেন, নিজের মেয়ের জন্য ছোট্ট একটা ড্রামস বানাতে চান। নাফিস মাস দেড়েকের মধ্যে সেটা বানিয়ে দেন। এরপর শুরু পরের ধাপ। কারিগরি নকশা আর সাউন্ড ড্রামস জোগাড়ের পর অনেক দিনের জন্য স্বপ্নকে শীতনিদ্রায় পাঠান ইমন। কারণ, তাঁকে নিজের বিভিন্ন সুর ও সংগীতায়োজনের কাজ করতে হয়। ব্যস্ততা থাকে নিজের ব্যান্ড চিরকুটের গান, অ্যালবাম ও কনসার্ট নিয়ে। তাই ওয়ান–ম্যান ব্যান্ড ওই এক ইমনের মন ও মগজেই ডালপালা ছড়ায়। এর মধ্যে পরিচয় হয় মানিক জসিম নামের একজনের সঙ্গে। তিনি গান করেন ও লেখেন। ইমনকে একদিন মানিক জসিম একটি গিটারের বেল্ট উপহার দেন। ইমন জানতে পারেন, বেল্টটা মানিক জসিমের বানানো। ইমনের মাথায় আবার ওয়ান–ম্যান ব্যান্ডের রোমাঞ্চ জেগে ওঠে। মানিক জসিমকে এবার সাহস করে বলেই ফেলেন নিজের স্বপ্নের কথা। জানান, একটা ড্রামস পিঠে বাঁধতে হবে, কাঁধে ঝোলাতে হবে গিটার, পায়ের সঙ্গে বাঁধা থাকবে ড্রামসের স্টিক—এসবের জন্য নিখুঁত কারিগরি সাহায্য লাগবে। ঠিক যেমন নিঁখুত গিটারের বেল্টটা।
ইমনের স্বপ্নের কথা শুনে পরিকল্পনার অংশ হয়ে গেলেন মানিক জসিম। করোনাকালে যখন সবাই নিরাপদ থাকার জন্য ঘরবন্দী হয়ে গেলেন, তখন ওয়ান–ম্যান ব্যান্ডের কাঠামো তৈরির জন ১৫ দিন মানিক জসিম ইমনের স্টুডিওতে গিয়ে ওঠেন। দুজনে মিলে রাতদিন কাজ করেন ছোট ছোট প্রতিটা অংশ নিয়ে। লকডাউন থেকে ভালো কিছু করোনাকালে ঘরে থাকা আশীর্বাদের মতো কাজ করেছে ইমনের জন্য। তা না হলে সব সময় কনসার্ট, অনুষ্ঠান আর পেশাগত কাজের বাইরে নিজের পাগলামোর জন্য সময় করে ওঠা কঠিন হতো। ইমন বললেন, ‘দুই বছর ধরে পরিকল্পনাগুলো যে গতিতে এগিয়েছে, গত ২-৩ মাসে সেটা পূর্ণতা পেয়েছে। বেশির ভাগ বাস্তবায়নের কাজ এই সময়টাতেই করেছি।’ সবচেয়ে কঠিন ছিল... অনেক অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। গায়ে বাঁধা ইনস্ট্রুমেন্টগুলোর ওজন বেশি হয়ে যাচ্ছিল, ঠিকমতো নড়াচড়া করা যাচ্ছিল না। অনেক ভাঙচুর আর জোড়াতালির পর ওটা ঠিক করা হয়।
ড্রামসের প্যাডেল সমস্যা করছিল, অনেক গবেষণার পর ওটারও সমাধান হয়। এরপর সাউন্ড নিয়ে টেনশন শুরু হয়। কারণ একটু নড়াচড়ায় শব্দ অন্য রকম হয়ে যেতে পারে। সুরের সঙ্গে চলে আসতে পারে অন্য নয়েজ। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক সময় লেগে যায়। এভাবেই বলে যান ইমন। জটিলতা এখনো শেষ হয়নি। ইমন জানান, এই ওয়ান–ম্যান ব্যান্ড নিয়ে আরও অনেক কাজ করতে হবে। আপাতত মাত্র পাঁচটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ব্যান্ডের শুরু হলো। ইমনের ইচ্ছা, বাড়াবেন বাদ্যযন্ত্রের সংখ্যা। কাজ করবেন দেশের লোকগানের সুর ও দেশি বাদ্যযন্ত্র নিয়েও। একজনের দল, অনেকের পরিশ্রম আর্বোভাইরাসের নাফিজ থেকে শুরু করে মানিক জসিমের কথা তো বললেনই। ইমন কৃতজ্ঞ আরও অনেকের প্রতি। বললেন, ওয়ান–ম্যান ব্যান্ড আদতে একজনের চেষ্টাতেই হয় না। এর পেছনে বিশাল এক দল লাগে। ১৮ জুন নিজের ফেসবুক পাতায় ইমন ওয়ান-ম্যান ব্যান্ডের প্রথম ভিডিওটি দেন।
ভিডিওর নিচে ধন্যবাদ জানান একদল বন্ধু ও স্বজনকে, যাঁরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে এই এক সদস্যের ব্যান্ডের অংশ হয়েছেন। ইমন ধন্যবাদ দিতে ভোলেন না তাঁর জন্য রাতদিন পরিশ্রম করে যাওয়া গাড়িচালক আফজালকেও। কঠোর লকডাউনের মধ্যেও আফজাল ওয়ান–ম্যান ব্যান্ডের জন্য দূরদূরান্ত থেকে নানা ধরনের সরঞ্জাম জোগাড় করে আনতেন। ১৫ জুন তিনিই ভিডিও শুট করার জন্য পুরো দলকে নিরাপদে ঢাকা থেকে মাওনা নিয়ে যান। সেখানে হয় ভিডিওর শুটিং। চিত্রগ্রাহক ছিলেন খায়ের খন্দকার। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ ছিল এই ভিডিও শুট করা। এক হাতে একই সময়ে পাঁচটি বাদ্যযন্ত্রে সুর তোলা তো চাট্টিখানি কথা নয়। ইমনের পরিবেশনার ভিডিওর শেষ দৃশ্যে বোঝা যায় কাজটা কত কঠিন ছিল।
পরিবেশনা শেষে ইমন যখন থপ থপ করে হেঁটে ফ্রেমের বাইরে যেতে থাকেন, তখনই বোঝা যায়, একা এক হাতে কী এক তোলপাড়ই না তোলা যায়, যদি সৃষ্টির নেশা একবার মাথায় চেপে বসে। ৪ দেশের ৪ ওয়ান ম্যান ব্যান্ড১. জুজি স্মিথ, অস্ট্রেলিয়া। একসঙ্গে বাজান ৬টি বাদ্যযন্ত্র।২. ফানি টমবো, জাপান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজিয়েছে ফানি টমবো দলটি। এই দলের একমাত্র সদস্যের নাম তামায়ো কোবায়েশি। তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে গেলেই দেখা যাবে ফানি টমবোর পরিবেশনা।