অনাগত সন্তানকে নিয়ে করোনাযুদ্ধ
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার কথা। এরই মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অতি সাবধানতা মেনে জীবন চলছিল তিন মাস ধরেই। স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ সব রকমের সতর্কতা ছিল বাসায়। যেহেতু বাসার তিন সদস্যের মধ্যে আমার স্বামী সম্রাট (বোরহানুল হক) পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। সে একাই শুধু বাইরে যায়, তাই সতর্কতার কারণে ও শুরু থেকেই গেস্টরুমে থাকে। আমি আর আমাদের মেয়ে রাজকন্যা আলাদা থাকি। নিয়মমাফিক জীবনে ছন্দপতন ঘটল হঠাৎই। জুনের প্রথম সপ্তাহে। ছন্দপতনের দিন ৭ জুন সকালে সম্রাটের জ্বর এল। সঙ্গে গা ব্যথা, হালকা শ্বাসকষ্ট। সঙ্গে সঙ্গে সে আইসোলেশনে চলে গেল, আর ১১ জুন করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিল।
ফল এল ১৫ জুন, কোভিড–১৯ পজিটিভ। একটু বিচলিত হলেও সামলে নিলাম। ওর চিকিৎসাসেবা নিয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, পপুলার হাসপাতালের অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ তারিকুল ইসলাম এবং হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শহিদুল কবিরের কাছ থেকে। এর আগের দুই দিন সব নিয়ম মেনে সম্রাটকে সেবা–শুশ্রূষার মধ্যেই ১০ জুন রাতে আমার শরীর খারাপ লাগল। সেদিন আমার প্রেগনেন্সির ৩৩ সপ্তাহ। ভাবলাম গর্ভকালীন ক্লান্তি হয়তো। পরদিন ১১ জুন সকালে ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড গলাব্যথা নিয়ে। এর মধ্যে গলাব্যথা খুব তীব্র হওয়ায় গরম পানি, লবণ দিয়ে গার্গল করতে শুরু করলাম। নাশতার পর খেলাম একটা প্যারাসিটামল। সারা দিনে ব্যথা আর কমল না।
জ্বর উঠে গেল ১০১ ডিগ্রি। বিকেলে আমার গাইনোকলজিস্ট ডা. জাকিউর রহমানকে ফোন দিলাম, বিস্তারিত জানালাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ দিনের ওষুধের একটা তালিকা এসএমএস করলেন। পাশাপাশি জরুরি কিছু নির্দেশনা। এরপর মেয়েকে আলাদা করে দিয়ে আমিও পুরো আইসোলেশনে চলে গেলাম। ১৩ জুন সন্ধ্যায় হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমি কোনো কিছুর স্বাদ–গন্ধ পাচ্ছি না।
আর ডান হাতে লাল ফুসকুড়ি, সঙ্গে চুলকানি। তবে দুই দিনে গলাব্যথা কমে এসেছে অনেকটা। সঙ্গে সঙ্গে জাকিউর রহমানকে ফোন দিয়ে জানালাম। তিনি পরামর্শ দিলেন কোভিড পরীক্ষা করানোর। ১৬ জুন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন সেন্টার থেকে আমার আর রাজকন্যার নমুনা নিয়ে গেল। লক্ষণ দেখে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। তবে মেয়ের জন্য খুব দোয়া করেছি, ওর যেন নেগেটিভ আসে। পরদিন সকাল ১০টার দিকে ফোন এল। আমার কোভিড পজিটিভ আর মেয়ের নেগেটিভ। মানসিকভাবে তো প্রস্তুত ছিলাম, তাই প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গেই। কাউকে আর তখন জানালাম না বিষয়টি। চুপচাপ নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে পরবর্তী করণীয়গুলো ভাবছিলাম। ১২টার দিকে সম্রাটকে ফোনে জানালাম।
এরপর আমার ভাশুর রাজা দাদাকে (রেজোয়ান হক)। এরপর রাজকন্যাকে আমার ঘরের দরজায় তার নির্ধারিত জায়গার দাঁড় করিয়ে ওকে বুঝিয়ে বললাম। মেয়েটা কেঁদে ফেলল। বুকটা তখন মোচড় দিয়ে উঠল কিসের আশঙ্কায় জানি না। দুপুরে একই ভবনের পাঁচতলায় ওর চাচার বাসায় চলে গেল মেয়েটা। মুহূর্তে পুরো বাড়িতে নিস্তব্ধতা নেমে এল। এত বড় বাড়িতে আমরা দুজন কোভিড পজিটিভ মানুষ দুই মাথার দুই ঘরে।
মনকে শক্ত করলাম। দুপুরে খেয়ে ঘুমালাম একটু। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে মনটা বিষণ্ন হলো। সারা দিনের কোলাহল শেষে কেমন এক নীরব চারপাশ। প্রায় ১৫–১৬ দিনের এই সময়টায় প্রথম ১০ দিন আমার রক্তচাপ বেশি ছিল। অক্সিজেন মাত্রা ৯৩–৯৪ থাকত। কিন্তু রক্তচাপ ১১০। মনে হতো বুকের মধ্যে কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। এ ছাড়া রাতে ঘুমের মধ্যে প্রায়ই আমার শরীর খুব ঝাঁকুনি দিত। ঘুম ভেঙে তখন অস্থির লাগত। মনে হতো কলিজাটা কেউ খামচে ধরেছে। তবে ওই এক দিন (১১ জুন) ছাড়া আমার আর জ্বর আসেনি। আর বড় ধরনের কোনো জটিলতার মধ্যেও পড়িনি। আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব মনোবল ধরে রাখতে। যখন খুব অসহায় লাগত, তখন পেটে হাত রাখতাম আর অনাগত সন্তানের কথা ভাবতাম।
সে সময় ও নড়েচড়ে আমাকে সাহস দিত। আর মনে হয়, ও বলত, মা, ভয় পেয়ো না। দেখ, আমি তো আছি তোমার সঙ্গে! কোনো ভয় নেই! আল্লাহর অশেষ রহমত, মনোবল এবং পরিবারের সমর্থন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে এ সময়। আমরা একই অ্যাপার্টমেন্টে সবাই থাকার কারণে এই সুবিধা আমি পেয়েছি শতভাগ। কোনো কিছুর ঘাটতি ছিল না। এ ছাড়া আমার চিকিৎসক জাকিউর রহমানের কথা না বললেই নয়। ফোন করে আমার খবর নিতেন। সাহস জোগাতেন। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন। যেখানে শুনতে পাই গাইনির চিকিৎসকেরা চেম্বার, ফোন বন্ধ করে দিয়েছেন, সেখানে তিনি ফোন করে রোগীর খবর পর্যন্ত নিতেন। সুস্থ হতে বেশি সময় তো লাগার কথা নয়! ধীরে ধীরে ৮–৯ দিনের মাথায় স্বাদ পাওয়া শুরু করি আর এর দুদিন পর থেকে হালকাভাবে গন্ধটা পেতেও শুরু করি। ২৩ জুন সম্রাটের দ্বিতীয় নমুনার ফল নেগেটিভ এল। আর আমি ২৭ জুন আবার নমুনা দিলাম। এ যাত্রায় যেন ফলটা নেগেটিভ আসে।