তাঁরা এখন ‘লাখপতি’ নারী উদ্যোক্তা
সকাল থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জান্নাতুল ফেরদৌস (মহুয়া) বন্দী থাকেন হুইলচেয়ারে। একা দাঁড়াতেও পারেন না। সেই ৯ মাস বয়স থেকেই মহুয়ার দৈনন্দিন কাজগুলো করে দেন তাঁর মা সাহেরা খানম। তবে হুইলচেয়ারে বসেই মহুয়া জামার নকশা আঁকছেন। জামায় সুঁই-সুতা দিয়ে নকশা করছেন। কারিগরদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত ঘরে বসে অনলাইনে দেশীয় পণ্য দিয়ে তৈরি করা থ্রি পিছসহ বিভিন্ন পোশাক বানিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন।
পণ্য তৈরি করাচ্ছেন ৩০ জন কারিগরকে দিয়ে। পাবনার মেয়ে মহুয়ার বাবা মারা গেছেন গত বছর। বাবা, দুই ভাই আর মায়ের সহায়তায় মহুয়া হুইলচেয়ারে বসেই ইংরেজিতে মাস্টার্স করছেন। অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমেই তাঁর তৈরি পণ্য লন্ডন, ইতালি, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। মহুয়া আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত করানোর স্বপ্ন দেখছেন। কুমিল্লার সীমান্তবর্তী একটি গ্রামের মেয়ে জান্নাতুল মুক্তা। অনার্স পড়ুয়া জান্নাতুল ‘খাদি রানি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। করোনাভাইরাসের বিস্তারের কারণে ১০০ গজ খাদি কাপড়ের অর্ডার আটকে আছে। তার পরও গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত অনলাইনে পাঁচ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন।
রমজানের ঈদে খাদি কাপড় দিয়ে বানানো অন্যান্য পণ্যের মধ্যে ১০০টি পাঞ্জাবি বিক্রি করেছেন। জান্নাতুল মুক্তা যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তাঁর বাবা মারা যান। ৪ ভাই ৩ বোনের বিশাল সংসারে সংগ্রাম করেই বড় হতে হয়েছে জান্নাতুলকে। বললেন, ‘আগে নিজের খরচ চালানোই কঠিন ছিল। এখন নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ দিতে পারছি। করোনার সময় জরুরি প্রয়োজনে ভাইকে এক লাখ টাকা দিয়ে সহায়তা করতে পেরেছি। মায়ের জন্য এক সপ্তাহেই পছন্দমতো ১০ হাজার টাকার কেনাকাটা করেছি।’
জান্নাতুল ফেরদৌস, জান্নাতুল মুক্তা অনলাইনে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) সঙ্গে যুক্ত। অনলাইনে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, পণ্য বিক্রির কৌশল শেখানোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম এটি। উইর সদস্য প্রায় পৌনে তিন লাখ। এতে ৮০ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। উইতে সদস্য হিসেবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ক্রেতাও আছেন। ফোরামের জান্নাতুল ফেরদৌস বা জান্নাতুল মুক্তার গল্পগুলো অন্য নারীদের উৎসাহিত করছে। অন্যদিকে এই উদ্যোক্তারাই অন্য উদ্যোক্তাদের পণ্য কিনছেন। জান্নাতুল মুক্তা জানালেন, অন্য নারী উদ্যোক্তারাই তাঁর খাদি গজ কাপড়ের ক্রেতা। ঢাকা বা অন্য জায়গায় বসেই তাঁরা কুমিল্লার এ কাপড় হাতে পাচ্ছেন। তারপর তাঁরা ওই কাপড় দিয়েই অন্য পণ্য বানিয়ে বিক্রি করছেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি মায়ের জন্য যে কেনাকাটা করেছি, তা উই থেকেই করেছি।’ উই থেকে করোনাভাইরাস বিস্তারের পর গত কয়েক মাসে ব্যবসা করে ‘লাখপতি’ হওয়া উদ্যোক্তাদের একটি তালিকা করো হয়েছে।
সে তালিকায় প্রায় ১০০ জন নারী উদ্যোক্তা আছেন। দিন দিন এ তালিকা বড় হচ্ছে। কাকলী রাসেল তালুকদারের বাচ্চার বয়স দুই বছর। মূলত সন্তানের কথা চিন্তা করে চাকরি ছেড়ে দেন। তবে যেকোনো প্রয়োজনে স্বামীর কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেওয়ার বিষয়টিও ঠিক মানতে পারছিলেন না। সাত বছর ধরে জামদানি শাড়ি নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। তাই এক বছর ধরে জামদানি নিয়েই অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন কাকলী। সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকার জামদানিও বিক্রি করেছেন ঘরে বসেই। করোনাভাইরাসের বিস্তারের মধ্যেও রাজধানীতে গত ঈদুল ফিতরে ছয় লাখ টাকার জামদানি বিক্রি করেছেন। আর বছর হিসাবে তা ১৪ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ভাইয়ের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন এই উদ্যোক্তা।
করোনার এই সময়ে তাঁতি শাড়ি বানিয়ে কুরিয়ারে পাঠান। হাসতে হাসতে কাকলী বলেন, ‘আমার তাঁতি এতটাই খুশি যে ঈদে আমাকে না জানিয়ে আমার জন্য র্যাপিং করা একটি জামদানি শাড়ি গিফট হিসেবে পাঠিয়েছেন। এতে আমি খুবই অভিভূত।’ কাকলী জানান, একজন একটা শাড়ি নেওয়ার পর তিনি নিজে বারবার অর্ডার করেন বা তাঁর পরিচিত লোকজনকে এ শাড়ির খোঁজ দেন। তাই বিক্রি একেবারে বন্ধ, সে ধরনের অবস্থা হয় না কখনো। কাকলী বর্তমানে উইতে অন্য নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। লাখপতির খেতাব পাওয়া প্রথম নামটাই কাকলী রাসেল তালুকদারের। লাখপতিদের আরেকজন উইয়ের কার্যকরী কমিটির পরিচালক নিগার ফাতেমা। উইয়ের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছেন এখনো এক বছর হয়নি। তিনি পরিচিতি পেয়েছেন টাঙ্গাইলের খেস শাড়ি নিয়ে কাজ করে। পুরোনো কাপড় ছিঁড়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাঁতিরা এ শাড়ি বানান। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী তিনি।
ঘরে চকলেট বানিয়ে তা বিক্রি করে লাখপতির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ফাতেমা রেজা। জানালেন, প্রথমে নিজেদের জন্য বানাতেন, ফেসবুকে ছবি দিলে তাতে ব্যাপক সাড়া পান। তারপর ফেসবুকে পেজ খোলেন। মাত্র ১৯ মাস বয়সী সন্তান নিয়ে প্রতিদিন ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে চকলেট বানাচ্ছেন তিনি। আরেক লাখপতি সালমা নেহা। শ্বশুরবাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের ১৫০ বছরের পুরোনো আদি চমচম ঢাকায় এনে বিক্রি করেই তিনি বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি এখন পর্যন্ত ফেসবুকে কোনো পেজ খোলেননি।
হাসতে হাসতে বললেন, ‘আদি চমচম বললেই উইয়ের সদস্যরা আমার কথা মনে করেন।’ মিষ্টির পাশাপাশি তিনি আম ও লিচুও বিক্রি করছেন অনলাইনে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত তিনি মিষ্টি, আম আর লিচু বিক্রি করে আয় করেছেন ১০ লাখ টাকার বেশি। উইয়ের প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার (নিশা) বলেন, ‘উই দেশীয় পণ্যের একটা প্ল্যাটফর্ম। বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত জিনিস বা যে পণ্যগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে, সেসব পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়েই ব্যবসা করছেন উদ্যোক্তারা। করোনাভাইরাসের বিস্তারের মধ্যেও গত কয়েক মাসেই উইয়ের সদস্যদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি লাখপতি খেতাব পেয়েছেন। এই লাখপতি উদ্যোক্তারা কখনোই মনোবল হারাননি। লকডাউনেও থেমে থাকেননি। বাসায় থেকেই আমাদের গাইডলাইন মেনে নিয়মিত ছিলেন উই গ্রুপে।’ নাসিমা আক্তার জানালেন, উইর সঙ্গে যুক্ত বিদেশে থাকা উদ্যোক্তারাও ব্যবসা করছেন। এ ছাড়া বিদেশে থাকা সদস্যরা অন্য উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে কেনাকাটাও করছেন। করোনাভাইরাসের সময় নিজেরা দেশে আসতে না পারলেও আত্মীয়দের মাধ্যমে কেনাকাটা করেছেন।