বাবা হিসেবে কেমন ছিলেন ‘পাপা’ হেমিংওয়ে?
গতকাল ছিল বাবা দিবস। বাবা হিসেবে কেমন ছিলেন কালজয়ী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে? হেমিংওয়ের চিঠিপত্র, সাহিত্য ও বিভিন্ন সূত্র—সবটা মিলিয়ে খুঁজে ফেরা যাক প্রশ্নটির উত্তর। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে—ভালোবেসে যাঁকে ‘পাপা’ বলে ডাকা হয়, তিনি একজন বাবা হিসেবে কেমন ছিলেন?হেমিংওয়ের ৬০০০ চিঠিপত্রের মধ্যে ৮৫ শতাংশ চিঠি ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, যার সর্বশেষ খণ্ডের সময়কাল জানুয়ারি ১৯৩২ থেকে মে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের চিঠিগুলোর দিকে নজর বোলালে উঠে আসে হেমিংওয়ের প্রাত্যহিক জীবনের অধিকাংশ চিত্র—যে চিত্র হেমিংওয়েকে কেবল লেখক বা খেলোয়াড় হিসেবেই নয়, একজন বাবার ভূমিকা সম্পর্কেও অনেক কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য দেয়।এই সময়কালের মধ্যে হেমিংওয়ের সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই গল্পগুলোতে রয়েছে পিতৃত্ববোধের গভীরতা, আবেগ ও পারিবারিক ছাপ। কিন্তু তাঁর চিঠিগুলো বলছে ভিন্নকথা।
পিতৃত্বের দায়বোধ একজন লেখকের জন্য যে বাধা, অভিভাবকত্বের দায়িত্ব তাঁর জন্য বোঝাস্বরূপ, এসব কথা হেমিংওয়ে স্পষ্টই স্বীকার করেছেন। লেখালেখির কাজে কোনো অজুহাত চলে নাহেমিংওয়ের ছিল তিন পুত্র। বড় ছেলে জন—ডাকনাম ‘বামবি’—হেমিংওয়ের প্রথম স্ত্রী হ্যাডলির গর্ভে তার জন্ম। হেমিংওয়ের আরও দুই ছেলে ছিল—প্যাট্রিক ও গ্রেগরি—দ্বিতীয় স্ত্রী পলিনের গর্ভে এদের জন্ম।প্রথমত, বাবা হিসেবে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছিলেন একটা দোটানার ভেতর, যার চিত্র পাওয়া যায় বিভিন্ন বইপুস্তকে। ১৯৩৩ সালে গারট্রুড স্টেইন তাঁর স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ 'এলিস বি. টোক্লাসের আত্মজীবনী’তে উল্লেখ করেন, ‘এক সন্ধ্যায় হেমিংওয়ে তাঁর বাসায় বেড়াতে আসেন, তখন ভরাট ও তিক্ত কণ্ঠে হেমিংওয়ে জানান, ‘বাবা হয়ে বসে আছি অথচ সে বয়সই আমার হয়নি!’
র চিঠিপত্রের পঞ্চম খণ্ডের সময়কাল জানুয়ারি ১৯৩২ থেকে শুরু। হেমিংওয়ে একদিকে তখন ‘ডেথ ইন দ্য আফটারনুন’—বুল ফাইটিং নিয়ে তাঁর অমর নন-ফিকশন গ্রন্থটি লেখা শেষ করছেন। অন্যদিকে হরেক সমস্যা: ঘরে ছয় সপ্তাহ বয়সী সদ্যোজাত শিশু, শিশুর মা সিজারিয়ান অপারেশন থেকে সেরে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন, ওদিকে তিন বছর বয়সী ছেলেটা পিঁপড়া মারার বিষ খেয়ে একদিন প্রায় মরতেই বসল। এত সবের পাশাপাশি প্রাত্যহিক আরও সমস্যা তো ছিলই; যেমন ঘরের ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে, বৈদ্যুতিক তারের গোলযোগ—ইত্যাদি।
হেমিংওয়ে এ প্রসঙ্গে তাঁর শাশুড়ি ম্যারি পাইফারকে স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘দেখুন, আমার নতুন বইটা যদি ভালোমতো লিখতে না পারি, তবে অজুহাত হিসেবে পাঠকদের ডেকে ডেকে নিশ্চয়ই বলতে পারব না যে মশাই, বইয়ের কথা ছাড়ুন! আগে দেখুন আমার ছেলে গ্রেগরি কত্ত বড় হয়ে গেছে! আমাদের বাড়ির পানির ব্যবস্থা সারানোর পর এখন কত্ত ভালো! কিংবা আমি প্রতি রোববার চার্চে যাই, আমার পরিবারের কাছে বাবা হিসেবে আমি দুর্দান্ত, মশাই!’ হেমিংওয়ের জন্য, লেখালেখি কেবল তো টেবিলের সামনে বসে লিখে যাওয়াই নয়। এর মধ্যে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ রয়েছে।
যেমন তাঁর অ্যাডভেঞ্চারগুলো—মাছ ধরা, শিকার, ভ্রমণ এবং এর মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন প্রকার মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা। ফলে তিনি তো এ কথা বলতেই পারেন যে ‘লেখালেখির কাজে কোনো অজুহাত চলে না’। শুধু এটুকু নয়, এসব নিয়ে আরও বলেছেন হেমিংওয়ে, ‘একজন লেখক নিতান্তই বোকা থেকে যাবে, যদি সে নিজের লেখালেখিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে করে এমন কিছুকে, এমনকি পরিবারকেও প্রশ্রয় দেয়! ঘরোয়া কাজে সফল হতে চাওয়া আসলে নিজের কর্মের হাল ছাড়ারই নামান্তর।’
হেমিংওয়ে তাঁর ছেলেদের একেবারেই অবজ্ঞা করেছেন, এমনটা ভাবলেও ভুল হবে। ছেলেরা যখন বড় হচ্ছিল, হেমিংওয়ে তাঁদের মাছ ধরা শেখাতে নিয়ে যেতেন, বন্দুক চালনা শেখাতেন। তবে এ-ও ঠিক যে বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, সে সময় তাদের দেখভালের ব্যাপারটা পরিচারিকার হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। এ সময় তিনি দিনের পর দিন পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকতেন। অবশ্য হেমিংওয়ে তাঁর ছেলেদের একেবারেই অবজ্ঞা করেছেন, এমনটা ভাবলেও ভুল হবে। ছেলেরা যখন বড় হচ্ছিল, হেমিংওয়ে তাদের মাছ ধরা শেখাতে নিয়ে যেতেন, বন্দুক চালনা শেখাতেন। তবে এ-ও ঠিক যে বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, সে সময় তাদের দেখভালের ব্যাপারটা পরিচারিকার হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন।
এ সময় তিনি দিনের পর দিন পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকতেন। এর প্রভাব তাঁর সন্তানদের ওপরেও পড়ত। সর্বকনিষ্ঠ ছেলে গ্রেগরির জন্য পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়াটা ছিল কষ্টকর। গ্রেগরি খুব অল্প বয়স থেকেই মাসের পর মাস আদা স্টার্ন নামে এক পরিচারিকার কাছে লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে ওঠে। আর মেজ ছেলে প্যাট্রিক কখনো কখনো বাবা-মায়ের ভ্রমণসঙ্গী হতে পারত বটে, নচেৎ তাকে তখন থাকতে হতো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। এ ছাড়া হ্যাডলির গর্ভজাত হেমিংওয়ের বড় ছেলে বামবি বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ির ফলে কিছুকাল বাবার সঙ্গে, কিছুকাল মায়ের সঙ্গে প্যারিসে থেকে বড় হয়। এককথায় বলতে গেলে, হেমিংওয়ের সন্তানদের শৈশব-কৈশোর খানিকটা ভবঘুরের মতোই কেটেছে।
হেমিংওয়ের লেখালেখিতে পিতা-পুত্রের খোঁজকিন্তু হেমিংওয়েকে ‘পাষণ্ড পিতা’ও বললে অনেকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে। সন্তানদের জন্য মায়া ও ভালোবাসার ছাপ পাওয়া যায় তাঁর চিঠিপত্রের সর্বশেষ খণ্ডে। হেমিংওয়ে তিনটি চিঠি লিখেছিলেন মেজ ছেলে প্যাট্রিককে, যার দুটো চিঠিতে গোল কিছু বৃত্তের ভেতর বিন্দু আঁকা ছিল। চিহ্নগুলোকে হেমিংওয়ের পারিবারিক সংস্কৃতিতে বলা হয় ‘টুসি’। এই চিহ্নগুলো দিয়ে তাঁরা চুমু বোঝাতেন। আগেই বলা হয়েছে, হেমিংওয়ে রচিত গল্পগুলোতেও পিতৃত্বের গভীর বোধ ও আবেগ দেখতে পাওয়া যায়। তৎকালীন পারিবারিক চিঠি ও পরিবারের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোই যে তাঁকে এসব গল্প লিখতে উৎসাহ জুগিয়েছে, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
১৯৩২ সালের নভেম্বরে তাঁর দুই ছেলের হুপিংকাশি হয়। তখন এই দুই ছেলেই মা পলিনের সঙ্গে ছিল আরকানসাসে, তাঁদের নানাবাড়িতে। সেখানেই থেকেই চলছিল সব সেবাযত্ন। তবে হেমিংওয়েকে তখন নিউইউর্ক ভ্রমণ স্থগিত রেখে থাকতে হয়েছিল কী ওয়েস্টে তাঁর নিজের বাড়িতেই, বড় ছেলে বামবির দেখভালের জন্য। এ সময় নিউইয়র্কে যেতে না পারার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে হেমিংওয়ে তাঁর সম্পাদক ম্যাক্সওয়েল পারকিনসকে একটি চিঠি লেখেন।
বড় ছেলে বামবির কথা বলতে গিয়ে তিনি সেখানে লেখেন, ‘ও খুব ভালো ছেলে, সঙ্গী হিসেবেও দারুণ, তবে এযাত্রায় আমি ওকে পানশালার পরিবেশে আনতে চাইছি না।’ ওই ১৯৩২-এর নভেম্বরে যখন হেমিংওয়ের দ্বিতীয় ঘরের দুই ছেলে হুপিংকাশিতে আক্রান্ত এবং হেমিংওয়ে তাঁর বাড়িতে রয়েছেন প্রথম পক্ষের ছেলে বামবিকে দেখাশোনার জন্য, সেই মাসেই তিনি লিখেছিলেন পিতা ও পুত্রের একত্রে ভ্রমণ নিয়ে একটি গল্প ‘পিতা ও পুত্রগণ’। এটি তাঁর ‘উইনার টেক নাথিং’ গল্পগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ সংগ্রহে নিক এডামসের চরিত্রে সেমি-অটোবায়োগ্রাফি ধাঁচের চব্বিশটি গল্প আছে, ‘পিতা ও পুত্রগণ’ও তার একটি। এ গল্পে নিক এডামসকে একজন পিতা হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়। গল্পটি লেখা হয় হেমিংওয়ের বাবা আত্মহত্যা (১৯২৮) করার তিন বছর পর।
গল্পটিতে নিক গ্রামাঞ্চলের কোনো প্রশস্ত হাইওয়ে ধরে ড্রাইভ করে চলেছে, সঙ্গে তার ছেলে পাশের সিটে ঘুমিয়ে আছে, আর তখনই নিকের মনে পড়ে যাচ্ছে নিজের বাবার কথা। নিক অনেকগুলো খুঁটিনাটি তথ্য স্মরণ করে বাবাকে নিয়ে: বাবার দৃষ্টিশক্তি—ভালো; বাবার শরীরের গন্ধ—বাজে; শিকার নিয়ে বাবার পরামর্শ—বিচক্ষণ; যৌনতা নিয়ে বাবার পরামর্শ—অগভীর। এসব ভাবতে ভাবতে নিকের ঘুমন্ত ছেলে পাশের সিট থেকে জেগে উঠে কথা বললে চমকে ওঠে নিক।
কেননা, নিক এতক্ষণ খুব একা বোধ করছিল, নিজের বাবাকে মিস করছিল। ‘পিতা ও পুত্রগণ’ গল্পটিতে একজন পিতার চিন্তাভাবনা পড়তে পড়তে পাঠক হিসেবে তাই প্রশ্ন জেগে উঠতেই পারে, পাপা, আপনি নিজে যখন ছোট বালক ছিলেন, শৈশবে যখন ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে শিকারে যেতেন, তখন ব্যাপারটা কেমন ছিল? বলা ভালো, হেমিংওয়ের ‘পিতা ও পুত্রগণ’ নামে যে গল্পের কথা এতক্ষণ বলা হলো, সেটি লেখার প্রেক্ষাপট, বৃত্তান্ত ও উৎস সম্পর্কে জানা যায় তাঁর আত্মজীবনী ও চিঠি থেকে।
হেমিংওয়ের চিঠিগুলো থেকে আরেকটি গল্পের উৎসও খুঁজে পাওয়া যায়, এ গল্পের নাম ‘একটি দিনের অপেক্ষা’। গল্পটির উৎসে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৩২ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয় বামবি। সেই প্রেক্ষাপটেই গল্পটি লেখা। গল্পটি নিছকই মজার, যেখানে এক বাচ্চা ছেলে ভুলবশত তাপমাত্রার দুটো আলাদা একক সেন্টিগ্রেড ও ফারেনহাইটের পার্থক্য গুলিয়ে ফেলে। গল্পের ছেলেটির নাম ‘স্কাজ’—যেটা ছিল বামবির আরেকটি ডাকনাম, ফ্রান্সের একটি স্কুলে পড়াশোনাকালীন বামবি ছিল বাবার সঙ্গে এবং তখন সে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়। সেই বামবিই হলো এ গল্পে স্কাজের প্রতিমূর্তি। গল্পে দেখা যায়, স্কুলে স্কাজ শিখেছে যে ৪৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।