করোনাক্রান্তি মোকাবিলা: স্থানীয় বনাম বৈশ্বিক যোগাযোগ–কৌশল
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,/ বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’—এটি রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী উক্তি। আধুনিক পৃথিবীর জনস্বাস্থ্য ও যোগাযোগনীতিতে রবীন্দ্রনাথের এই স্বরের প্রতিধ্বনি দেখি আমরা ‘থিংক গ্লোবালি, অ্যাক্ট গ্লোবালি’ স্লোগানের মাধ্যমে। আজ পৃথিবী অভূতপূর্ব ঘোরলাগা সময় পার করছে। এই নিবন্ধের লেখকদ্বয় পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসে করোনাভাইরাসে কাবু দুটি অঞ্চল থেকে কলম ধরেছেন। আমাদের যূথবদ্ধ ভাবনাটি কোভিড-১৯ মহামারিকে বৈশ্বিক থেকে স্থানীয় দৃষ্টিতে দেখার প্রয়াস। এই লেখাটি একটি সংক্ষিপ্ত সামাজিক নিরীক্ষাধর্মী ভাবনার সমবায়।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে কোভিড-১৯ সংক্রমণের দুই মাস শেষে দেখা যাচ্ছে, সমাজে একটা উল্লেখযোগ্য ভীতির সঞ্চার হয়েছে। এই ভয় মহামারিকে আরও জটিল করে তুলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত তথ্যের প্রবাহ এবং যোগাযোগ সমন্বয়হীনতা। ফলে, ভয়ের উৎস, কার্যকর যোগাযোগ–কৌশল এবং সাম্প্রতিক করোনাক্রান্তি অনুসন্ধানের লক্ষ্যে একটি গবেষণার প্রচেষ্টা করেছি আমরা। শ্যাডো এথনোগ্রাফি অবলম্বনে আমরা চেষ্টা করছি একটা পূর্ণাঙ্গ ন্যারেটিভ লিখতে।
এখানে গত দুই মাসের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কেস স্টাডিভিত্তিক আমাদের নিরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরছি। লেখকদ্বয়ের একজন কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় পৃথিবীজুড়ে আলোচিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের মহামারি গবেষক, যিনি জন্মসূত্রে কলকাতার বাঙালি।
দ্বিতীয়জন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষক, যিনি শিক্ষকতার যুক্ত হওয়ার আগে সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন, গবেষণায় যাঁর আগ্রহের জায়গা সামাজিক যোগাযোগবিদ্যা। বৈশ্বিক মহামারিতেও দেশে দেশে আজ লাখো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ও অভূতপূর্ব এই অবস্থা। করোনাভাইরাসে কাবু দুটি অঞ্চল বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে বৈশ্বিক পরিস্থিতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এ চিত্র—ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) গঠিত অপারেশনস রিসার্চ গ্রুপের সমীক্ষা অবলম্বনে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে (১৫ জুন, ২০২০) জানা গেল, ‘ভারতে করোনার সংক্রমণ শীর্ষ ছুঁতে পারে মাঝ-নভেম্বরে’।
পত্রিকাটির অনলাইন পোর্টালে (১৮ জুন ২০২০) করোনা আপডেট থেকে জানা গেল, পৃথিবীতে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৮৩ লাখ ৩১ হাজার ৯৩৫, ভারতে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯৪৬ জন। ভারতের এনডিটিভি বাংলা লাইভ থেকে জানা গেল, করোনার আক্রমণে ভারতেই মারা গেছে ১১ হাজার ৯০৩ মানুষ। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য মহারাষ্ট্র। এদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর ১০২তম দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন পোর্টালের করোনা লাইভ আপডেটে পাওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট করোনা শনাক্ত ১ লাখ ৫ হাজার ৫৩৫ জন এবং করোনায় মারা গেছেন ১ হাজার ৩৮৮।
একই সূত্রে জানতে পারি, বিশ্বে করোনায় মোট মারা গেছে ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৪৩৭ জন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে কোভিড-১৯ সংক্রমণের তিন মাস শেষ হলো। মধ্য নভেম্বরে উহান থেকে যাত্রা শুরু করা এই ভাইরাসের বয়সও ডাবল সেঞ্চুরি সেরে ফেলেছে নিঃশব্দ আততায়ীর মতো। পৃথিবীজুড়ে আলোচিত কোভিড-১৯ মহামারিকে আমরা জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি যোগাযোগবিদ্যার জায়গা থেকে দেখতে আগ্রহী। কোনো সমাজ জীবন্ত আছে কি না, সেটা বোঝার উপায় হলো সেই সমাজে পারস্পরিক যোগাযোগপ্রবাহ সজীব আছে কি না, তার ওপর। পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিকেশন অর্থ ‘জ্ঞাপন’, বাংলাদেশে তা ‘যোগাযোগ’, এটা শুনলে অনেকেই ঠিক পুরোপুরি বোঝে না। কখনো তাকিয়ে থাকে, ভাবে রেল-নৌ-সড়ক যোগাযোগ নয় তো? আমরা মহামারির বৈশ্বিক দিকের আলোচনার পাশাপাশি স্থানীয় যোগাযোগপ্রবাহের স্বরূপ উন্মোচন করার প্রয়াস নিয়েছি, এই নিবন্ধ সেই প্রয়াসের ক্ষুদ্র অংশ।
এ কথা আজ সবার জানা যে কোভিড-১৯ মহামারি (এপিডেমিক) গত মার্চ মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশ অনুযায়ী অতিমারির (প্যানডেমিক) আকার নিয়েছে। কোভিড-১৯ রোগের বাহক হলো এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবকণা, যার নাম করোনাভাইরাস। অতিমারির একটি ভয়ংকর রূপ হলো মৃত্যুহারের সংখ্যা দর্শন। আজ বিশ্বে ৮৬ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
প্রতিদিন আক্রান্তের হার ঊর্ধ্বমুখী ভারত ও বাংলাদেশে। বাড়তে বাড়তে গবেষণা চলাকালে গত ১৫ এপ্রিল যখন পৃথিবীর কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যাটা ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেল, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০ এপ্রিল প্রকাশ করল ‘ইন্টারন্যাশনাল গাইডলাইনস ফর সার্টিফিকেশন অ্যান্ড ক্ল্যাসিফিকেশন অব কোভিড-১৯ অ্যাজ কজ অব ডেথ’ শীর্ষক নিবন্ধ, যেখানে খুব স্পষ্ট করে বারবার বলা হয়েছে, কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত (করোনাভাইরাস) কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর অন্তর্নিহিত কারণ চিহ্নিত করা জরুরি এবং করোনাভাইরাস পজিটিভ বা আক্রান্ত ব্যক্তির যদি অন্য কারণেও মৃত্যু হয়, তাহলেও কোনো কোনো পরিস্থিতে ব্যক্তিকে কোভিড-১৯ মৃত্যু হিসেবেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
নির্দেশিকা বা গাইডলাইন বলছে, ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময় প্রতিটা দেশে এই তালিকাভুক্তকরণ খুব সাবধানে ও নিয়ম মেনে করতে হবে, যাতে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নজরদারিতে সুবিধা হয়। মৃত্যুহার নিয়ে ভয় সঞ্চার করার কোনো উদ্দেশ্য এখানে থাকার সুযোগ নেই। কোভিড-১৯ মহামারি মৃত্যুহারসংক্রান্ত বিষয়ে সম্যক ধারণা সুস্পষ্টভাবে পাওয়ার জন্যই এই নির্দেশাবলি। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, রোগতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, যোগাযোগবিদ্যা আর চিকিৎসাশাস্ত্রের সব সমীকরণ উল্টে দিয়ে নয়া রোগের বিশ্বায়ন জারি হয়েছে পৃথিবীতে।