স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জমি দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান!
দখলদারদের করাল গ্রাসে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সরকারি এই প্রতিষ্ঠাটির চারিদিকের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বসতবাড়ি। এদিকে সরকারি জায়গা উদ্ধারসহ দখলদার উচ্ছেদে তিন বছর ধরে ১৬ বার জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে পত্র চালাচালি করেও সফল হয়নি উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
অবৈধ দখলদারদের কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দৈনিন্দন কাজকর্ম এবং করোনাকালীন চিকিৎসা সেবায় বিঘ্ন ঘটছে। একইসঙ্গে বাধাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উন্নয়ন কাজ।
জলঢাকা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সূত্রমতে, ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জলঢাকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। মোট ৬ দশমিক ৪০ একর জমির মধ্যে ২ দশমিক ৫৮ একর জমিতে নির্মাণ করা হয় হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
অবশিষ্ট ৩ দশমিক ৮২ একর জমি অবৈধভাবে দখলদাররা নিজেদের কব্জায় নিয়ে কেউ কেউ কাঁচাপাকা দোকান ঘর নির্মাণ করে ব্যবসা করছেন। অনেকে আবার বসতবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছেন। একই সাথে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রবেশের প্রধান ফটকসহ আশপাশ এলাকায় অবৈধভাবে দোকান-রেস্তোরাঁ গড়ে তুলে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে জরুরি রোগী পরিবহণে, বিনষ্ট করা হচ্ছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবেশ।
সূত্রটি আরো জানায়, সরকারি জমি থেকে এসব অবৈধ স্থাপনা এবং দখলদার উচ্ছেদে গত তিন বছরে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কাছে অনন্ত ১৬ বার পত্র চালাচালি করেও কোন ফল হয়নি।
সরকারি জমি থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে জেলা প্রশাসন বরাবরে ২০১৭ সালের ২৯ মে প্রথম পত্র পাঠায় উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এরপর একই সালের ২১ জুন, ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, একই সালের ১৬ জুলাই, ২১ নভেম্বর পত্র পাঠানো হয়।
এসবের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তর থেকে ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বরের এক পত্রে দখলদারের তালিকা চাওয়া হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ওই মাসের ৩১ ডিসেম্বর মোট ৮৩ জন দখলদারের তালিকা পাঠায় ওই দপ্তরে।
একই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরেও পাঠানো হয়েছেন একাধিক পত্র। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর, ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি ও ৯ জানুয়ারি উল্লেখযোগ্য।
এ সময়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন ডা. জেড. এ ছিদ্দিকী। তিনি চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
তিন বছরের ওই চিঠি চালাচালির ফলে ২০১৭ সালের ২৯ মে প্রথম দফা ও ২০২০ সালের সালের ১ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় দখল উচ্ছেদের নোটিশ দেয় প্রশাসন। ১৫ দিনের মধ্যে অবৈধ এসব স্থাপনা সরানোর নোটিশ প্রদান করা হলেও আজ অবধি সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
এ বিষয়ে রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. জেড.এ. ছিদ্দিকী বলেন, ওই উপজেলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা দায়িত্বে থাকাকালে বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক চিঠি চালাচালি করেছি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির ভবনগুলো অনেক পুরনো। আমি চেয়েছিলাম সেখানে নূতন স্থাপনা তৈরি করে মানুষের চিকিৎসা সেবার সুন্দর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করার। এতে এলাকার মানুষ উপকৃত হতো। কিন্তু দখলদার উচ্ছেদের দীর্ঘসূত্রিতায় সেটি সম্ভব হয়ে উঠেনি।
জলঢাকা উপজেলা বর্তমান স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হাসান মোহাম্মদ রেজওয়ানুল কবীর বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চতুর্দিকের জায়গায় অবৈধভাবে ঘর নির্মাণ করে ব্যবসা করছেন অনেকে। কেউ আবার বসতবাড়ি তৈরি করে শুরু করেছেন বসবাস। তারা নোংরা আবর্জনা ভেতরে ফেলছেন, দোকানের কর্মচারীরা যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করছেন।
দখলদার এবং দোকানের লোকজনের প্রধান ফটকের সামনে সর্বদা বিচরণ হওয়ায় হাসপাতালে আসা মাতৃত্ব কালীন রোগী ও জরুরি রোগী প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। আর প্রধান ফটকের সামনে অবৈধ দোকান পাট থাকায় সর্বদা লোকজনের জটলায় জরুরি রোগী পরিবহনেও বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবেশ ও রোগীদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ২৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। চলতি জুনে মেয়াদ শেষ হবে প্রকল্পটির। কিন্তু দখলদার উচ্ছেদ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় এবং জায়গা বুঝি না পাওয়া কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।
হাসপাতালের ওই জায়গায় দোকান করে ব্যবসা করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, আমি ১৯৯০ সাল থেকে ওষুধের দোকান করছি। সরকারি জায়গা পড়ে থাকায় অনেকে সেখানে ব্যবসা করছেন। অনেক ভূমিহীন ঘরবাড়ি করে বসবাস করছেন। এ অবস্থায় ২০০১ সালে তৎকালীন পৌর মেয়র একবার ভাঙচুর করেন। এর পর ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় দ্বিতীয়বার উচ্ছেদ অভিযান চলে।
ওই সময় স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা স্বজনপ্রীতি করে কয়েকজনকে উচ্ছেদ করেননি। একারণে পরবর্তী সময়ে পুনরায় দখল হয়। আমাদের দাবি জায়গার প্রয়োজন হলে সরকার উচ্ছেদ করে আমাদের একটা বিকল্প ব্যবস্থা করে দিক। না হলে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫টি পরিবার পথে বসবে।
দখলদারের কারণে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির উন্নয়ন কাজ বন্ধ আছে উল্লেখ করে সিভিল সার্জন রনজিৎ কুমার বর্মন বলেন, দখলদার উচ্ছেদের ক্ষমতা তো আমাদের নেই। লোকাল পৌরসভার মেয়র, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসককে বিষটি জানানো হয়েছে। তারা সচেষ্ট হলে দখলদার উচ্ছেদ সম্ভব।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, জলঢাকা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের চিঠি পেয়েছি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাউন্ডারি ওয়ালের বাইরে কিছু জায়গা আছে, যেটি দখলদারেরা ধরে আছে। সেটি জরিপ করে তারা (স্বাস্থ্য বিভাগ) ওই জায়গায় কিছু কাজ করতে চায়। আমার কাছে চিঠি দিয়েছেন তারা। সেটা বিবেচনার মধ্যে আছে। কারণ করোনা ঝুঁকির কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিক রুটিন কাজগুলো বন্ধ আছে। যেহেতু এখন রাস্তা খুলেছে আমরা বিষয়টা দেখছি।
তিনি বলেন, এটির জন্য একটি উচ্ছেদ মামলা রুজু করতে হবে। উচ্ছেদ মামলা রুজু করে এগুতে হবে। সে বিষয়টা আমাদের নলেজে আছে, এটি নিয়ে কাজ চলছে। কাজটি করে তারপরে আমরা উচ্ছেদে যাবো। যাতে আইনকানুনের ফাঁকফোকরে পড়ে অবৈধ দখলদার আমাদের সরকারী সম্পত্তি ভোগ করতে না পারে