করোনা শনাক্তের ৩ মাস: প্রয়োজনে কারফিউ দেওয়ার পরামর্শ ডা. আবদুল্লাহর
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় বলে জানায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, তিন মাসে দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৬৮ হাজার ছাড়িয়েছে। আজ সোমবার জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টার ও ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী সংক্রমণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২০ নম্বরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ১০ হাজার ৯৩১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। মোট শনাক্ত হয়েছেন ৬৮ হাজার ৫০৪ জন। সেই হিসাবে, মোট পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯৩০ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ১৪ হাজার ৫৬০ জন। মোট শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ ও সুস্থতার হার ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রতিদিনই আমাদের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। আসলে আমাদের এখানে যে লকডাউন বাতিল করা হলো, এর আগে মাঝে গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হলো, লোকজন আসলো, আবার তাদের ফেরত পাঠানো হলো, ঈদে মানুষ বাড়ি গেলো, আবার আসলো— এভাবেই তো সংক্রমণ বাড়লো। যখন লকডাউন ছিল, তখনও তো সেটি ঠিকভাবে কার্যকর করা হয়নি। মানুষও সেভাবে মানেনি। সাধারণ মানুষ, অসতর্ক ছিল, তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব ছিল। মানুষ ঘরে থাকেনি, বের হলে ঠিকমতো মাস্ক পরেনি, দূরত্ব বজায় রাখেনি। এসব মিলিয়েই সংক্রমণ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষকে বুঝতে হবে, নিজের জীবন নিজেকেই রক্ষা করতে হবে। নিজে যদি সতর্ক না হয়, লকডাউন না মানে, তাহলে তো প্রশাসন একা এটি মোকাবিলা করতে পারবে না। সবাইকে বুঝতে হবে, যাতে তার মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি না হয়। মানুষ এগুলো মানছে না বলেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দিনকে দিন বাড়ছে। এভাবে যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তাহলে দ্রুত আবারো লকডাউন দিতে হবে। শুধু লকডাউন দিলেই হবে না, মানুষ যাতে মানে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে।’
‘সরকার যদিও জোন হিসেবে ভাগ করে লকডাউন দিচ্ছে। তবে আরও কঠোর হতে হবে। যেখানেই লকডাউন দেওয়া হবে, যাতে এটি মানা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঢিলেঢালা লকডাউন দিয়ে কোনো লাভ হবে না’, বলেন তিনি।
আমরা যদি মার্চের দিকে ফিরে যাই, সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো। এটা ওই অর্থে কি লকডাউন ঘোষণা?— জানতে চাইলে ডা. আবদুল্লাহ বলেন, ‘আসলে ওই অর্থে লকডাউন আমাদের হয়নি। আবার মানুষও মানেনি। ছুটি মনে করে, বিনোদনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছে, বেড়াতে গিয়েছে। আসলে তো এটা ছুটি ছিল না। লকডাউন ছিল। মানুষকে ঘরে থাকার কথা বলা হয়েছিল। ছুটি পেয়ে অনেকে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। আবার ঢাকায় এসেছে।’
এক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে আরও স্পষ্ট ঘোষণা আসা দরকার ছিল বলে মনে করেন কি না?— প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, এক্ষেত্রে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল। তবে, লকডাউনের কথা সরকার বলেছিল। মানুষ ওইভাবে মানেনি। শুরুর দিকে নিরাপত্তাকর্মীরাও অনেক চেষ্টা করেছেন। এতে করে অনেক পুলিশ সদস্যও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন। সেক্ষেত্রে তারাও হয়তো ভয় পেয়ে গেছে, উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। সব মিলিয়ে লকডাউন তো পুরোপুরি সফল হয়নি। তাই সংক্রমণের হারও বেড়ে গেছে।’
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ বলেন, ‘এখন যে হারে বাড়ছে, সেই হারে বাড়তে থাকলে আমার তো মনে হয়, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আবারও লকডাউন দিতে হবে। প্রতিদিন যদি সংক্রমণের হার এভাবেই বাড়তে থাকে বা মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে, তাহলে সরকারকে লকডাউনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোরভাবে লকডাউন দিতে হবে। যাতে মানুষ এটি মানতে বাধ্য হয়। মূল কথা মানুষকে লকডাউন মানাতে যা যা করা দরকার, তাই করতে হবে। প্রয়োজনে কারফিউ যেন দেওয়া হয়, এরকম ব্যবস্থা লাগতে পারে।’
বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এটি কি আমাদের জনগণের সংখ্যার তুলনায় যথেষ্ট?— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। পরীক্ষার হার আরও বাড়ানো উচিত। এখন দেশে ৫০টির মতো ল্যাবে পরীক্ষা হয়। মানুষের তো ভোগান্তি হয়। বৃদ্ধ, নারী, শিশুসহ সবাইকে লম্বা লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এক্ষেত্রে ঠিকভাবে দূরত্বও বজায় থাকে না। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে। তাই পরীক্ষা ব্যবস্থা আরও দ্রুত হওয়া উচিত। পরীক্ষার আওতাও বাড়ানো উচিত। তাহলে আমরা আক্রান্তের প্রকৃত হারও জানতে পারবো। একইসঙ্গে জনগণের কষ্টও লাঘব করা যাবে।’
এক্ষেত্রে আমাদের জন্য র্যাপিড টেস্টিং কিটের দরকার আছে কি না?— প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে কার্যকর র্যাপিড টেস্টিং কিট হলে ভালো হয়। র্যাপিড টেস্টিং কিটের ক্ষেত্রে ফলস রিপোর্ট আসার একটা ব্যাপার রয়েছে। দেখা গেছে ফলস পজিটিভ বা ফলস নেগেটিভ আসে। তাই যদি কার্যকর কিট পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে। পরীক্ষা ব্যবস্থা আরও দ্রুত করা হবে। মানুষকে দীর্ঘ সময় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। তাই আমাদের এখানে দ্রুত ও কার্যকরী র্যাপিড টেস্টের ব্যবস্থা করা উচিত।’