যেভাবে শ্রেষ্ঠ মা হলেন নার্গিস সুলতানা
নার্গিস সুলতানা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের ‘জয়িতা অন্বেষণ কার্যক্রম’র আওতায় ২০১৭ সালে রাজশাহী বিভাগের সফল জননী ক্যাটাগরিতে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া একই কার্যক্রমের আওতায়ও ২০১৬ সালে গুরুদাসপুর উপজেলা এবং নাটোর জেলার ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’ মনোনীত হয়েছিলেন। এমনকি ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক মা দিবসে ‘নাটোর জেলা গার্লস গাইড’ তাকে ‘সফল জননী’ সম্মানে ভূষিত করে। সম্প্রতি তিনি র্যাপিড পিআরের ‘রত্নগর্ভা মা-২০২০’ মনোনীত হয়েছেন। সফল এই মায়ের জন্ম ১৯৫৮ সালে নাটোরের সিংড়া উপজেলার কালীনগর গ্রামে। দশম শ্রেণিতে থাকতেই তার বিয়ে হয় বেসরকারি কলেজের শিক্ষকের সাথে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তার স্বামী হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তখন নার্গিস সুলতানা তিন সন্তানের মা। বয়স মাত্র ৩৫ বছর।
এরপর প্রতিকূল পরিবেশে তিন সন্তানকে বড় করেছেন। তার অসীম ধৈর্য, সাহস, দৃঢ় মনোবল, চৌকস বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমের ফসল এই তিন সন্তান। তারা আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তার প্রথম সন্তান জান্নাতুন ফেরদৌস লীনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। দ্বিতীয় সন্তান ডা. নাদিরা পারভীন রুনা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করেছেন। তিনি ২৪তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডার হন। ২০০৮ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে স্বামীর সাথে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। বর্তমানে ওই দেশের সরকারি চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত তিনি।
কনিষ্ঠ সন্তান ফাত্তাহ তানভীর মো. ফয়সাল রানা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম শেষ করেন। বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের ল’ ডিভিশনে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত। আজ সফল জননী নার্গিস সুলতানা তার দুঃসহ দিন ও সফলতার গল্প শোনাবেন জাগো নিউজের পাঠকদের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ— আপনি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সফল জননী, এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই— নার্গিস সুলতানা: আসলে এ পুরস্কারে ভূষিত হবো কখনোই ভাবিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালনের চেষ্টা করেছি মাত্র। ফলাফল হিসেবে পেয়েছি সন্তানদের সফলতা। যার স্বীকৃতি হিসেবে ‘সফল জননী’ সম্মাননা পেয়ে ভালো লেগেছে। ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পর আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। আপনার দুঃসহ দিনগুলোর কথা জানতে চাই। দিনগুলোতে কারা আপনার পাশে ছিলেন? নার্গিস সুলতানা: আমার দিনগুলো অনেক সংগ্রামের ছিল। অল্প কিছু জমি ছিল, সেই সময় ধানের দাম খুব কম। অন্য আয়ের উৎস ছিল না। আমি বাসায় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াতাম। মেয়েদের কাপড় তৈরি করতাম। স্বামীর রেখে যাওয়া জমিজমা দেখাশোনা করতাম। এতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ত। স্বামীর গচ্ছিত টাকাগুলো দেবররা নিয়েছিল ব্যবসা করতে! ১৯৯০ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর আমাদের সাথে দুই দেবর থাকত। আমাদের খরচ বেড়ে যায়। তারা এক বছর পর চলে যায়। আমরা যে বাসায় থাকতাম; সেই বাসা ভাড়া দিলাম। পাশের ফাঁকা জায়গায় ছনের ঘর তৈরি করে থাকা শুরু করলাম। এভাবেই চলতে থাকে। আমার যে টাকা তারা ব্যবসার জন্য নিয়েছিল, তার কোনো হদিস পেলাম না। আমার শ্বশুর আমাদের আলাদা করে দিলেন। বড় মেয়ে তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ত। একদিন শুনলাম, তার চাকরি হয়েছে প্রাইমারি স্কুলে। মেয়েটি লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুলেও শিক্ষকতা করত। আমার ছেলে তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। বড় মেয়েই ছেলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এরমধ্যেই ছোট মেয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। খুশি হয়েছিলাম আবার চিন্তায়ও পড়ি, এত খরচ মেটাবো কিভাবে? তবে কোনোকিছুই থেমে থাকেনি। জমিতে ভালো ফসল হচ্ছিল। আমার ভাইরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। একসময় বড় মেয়ের বিয়ে হলো। ততদিনে ছোট মেয়েও মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করার পথে। ২০০৩ সালে ছেলেটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে ভর্তি হয়েছে। ছোট মেয়ে তখন ডাক্তারি পাস করেছে এবং বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে পোস্টিংয়ের অপেক্ষায়।
এমন দিনগুলোতে আমার ভাইয়েরা পাশে ছিলেন। তারা ছাড়াও আত্মীয়-স্বজনরা বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছে। আপনি যখন জানলেন সরকারিভাবে আপনাকে উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে সম্মানিত করা হবে; তখন কেমন লেগেছিল? নার্গিস সুলতানা: আমরা গ্রামের মানুষ বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত ছিলাম না। প্রথমে বুঝতেই পারিনি কী হচ্ছে? আসলে এ ধারণাই তো বাংলাদেশে নতুন। এটা সরকারের খুব ভালো উদ্যোগ। যখন জানলাম আমাকে সম্মানিত করা হবে; তখন মনে হয়েছিল, জীবনে আরও একটি বিজয় অর্জিত হলো! এ স্বীকৃতি শুধু আমার নয়, সব মায়ের; যারা কঠোর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলেন। এ স্বীকৃতি অর্জনে সহযোগিতা করেন গুরুদাসপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নীলুফা ইয়াছমিন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বিচারকের আসনে থেকে আপনাকে সেরা জয়িতা নির্বাচিত করেন। ঠিক সেই সময়ের অনুভূতি বলুন— নার্গিস সুলতানা: আমি ভাবতেই পারিনি, ভাগ্য আমাকে এতদূর নিয়ে যাবে। আমার জীবন-সংগ্রামের ভিডিওচিত্র নিতে এসেছিলেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিস থেকে একজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং গুরুদাসপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এতেই ধারণা করেছিলাম কিছু একটা হবে। ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পর আমাকে কিছু বলার জন্য ডাকা হলো। আমি বলেছিলাম, এই রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অডিটোরিয়ামে আমি আগেও এসেছি, এখানে আমার মেয়ে পড়ত। আজ এখানে আমাকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। এর চেয়ে বড় অর্জন কী হতে পারে?
- ট্যাগ:
- লাইফ
- মায়ের ভালোবাসা