
বন্ধ থাকা কর্মস্থলের পানি নিরাপদ তো, নইলে নতুন বিপদ
ফকিরাপুলে বাংলার বাণী মোড় থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের দিকে যেতে পেট্রলপাম্পের আগে ব্যক্তিমালিকানাধীন দুটি বহুতল ভবন। সেখানে অনেক অফিস। গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারের টানা সাধারণ ছুটির মধ্যে এই দুটি ভবনের বেশির ভাগ অফিসই বন্ধ রয়েছে বা কোনো কোনোটি খুব সীমিত পরিসরে মাঝেমধ্যে খুলেছে। সাধারণ ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় আগামীকাল রোববার থেকে ভবন দুটির প্রায় সব অফিসই খুলে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে কর্মস্থলে যেতে হবে, এ নিয়ে ভয় যেমন আছে, তেমনি এত দিন বন্ধ থাকা অফিসের পানির সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েও চিন্তায় আছেন ওই ভবনের ব্যবহারকারীরা। এমনই একজন পেশায় আইনজীবী ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবনটি এত দিন প্রায় লকডাউন ছিল। পানির ট্যাংকি ও সরবরাহ লাইনের কী অবস্থা, এত দিন পানির প্রবাহ ছিল না ফলে সেখানে জীবাণু, পোকামাকড় জন্মেছে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’ এই আইনজীবী বলেন, ‘দেখা গেল করোনা থেকে বাঁচলাম। কিন্তু পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হলাম।’
ওই আইনজীবী জানালেন, তাঁর সেক্রেটারি (ব্যক্তিগত সহকারী) এ নিয়ে ভবনটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই ভবনের এক তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল ইসলাম জানালেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরাও উদ্বিগ্ন ছিলেন। ইতিমধ্যে জমে থাকা পানি বের করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পাইপলাইন খুলে দিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে (ফোর্স) পানি ছেড়ে লাইন পরিষ্কার করা হয়েছে। কয়েক দিন আগে ট্যাংকিতে ক্লোরিন ছিটিয়ে পরিষ্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তিনি বলেন, একেবারে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ট্যাংকি বা সরবরাহ লাইন পরিষ্কার সম্ভব হয়নি। কেননা এ কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের সময়মতো পাওয়া যায়নি। দু-এক দিনের মধ্যে করা চেষ্টা হচ্ছে।
অপর ভবনের কেয়ারটেকার আবু তাহের সুজন বললেন, পানির ট্যাংকি বা সরবরাহ লাইনের এই বিষয়টি নিয়ে সেভাবে ভাবা হয়নি। তাঁরা নিচের ট্যাংকি থেকে ওপরে তুলে জমা পানি ফেলে দিচ্ছেন। তবে প্রতিটি ফ্লোরের ভেতরের লাইনগুলো পরিষ্কার হচ্ছে না।
সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ৩০ মের পর ছুটি আর বাড়ছে না। এর ফলে বন্ধ থাকা বেশির ভাগ অফিস-আদালত ৩১ মে রোববার থেকে চালু হচ্ছে। দুই মাসের বেশি সময় ধরে বেশির ভাগ ব্যবসায়িক ভবন ও অফিসপাড়ার ভবনগুলো বন্ধ আছে। করোনার দুশ্চিন্তার মধ্যে এই বন্ধ বড় ভবনগুলো জীবাণুমুক্ত করা, বিশেষ করে ভবনের ট্যাংক, পানির পাইপলাইনে জমে থাকা পানি ও লাইন জীবাণুমুক্ত করা বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্য দেশগুলোরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) হিসাব অনুযায়ী, তাদের আওতাধীন এলাকার মধ্যে মোট ভবনের সংখ্যা ২১ লাখ ৪৫ হাজার। এর ৮৪ শতাংশই একতলা। ৬ তলা বা এর বেশি উচ্চতার ভবনের সংখ্যা ৬৩ হাজার ২৮৯টি। আর ১০ তলা বা এর চেয়ে বেশি উঁচু ভবনের সংখ্যা ৩ হাজার ৪১০টি। সুউচ্চ ভবনের বেশি অংশ বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা এই লকডাউনের সময় বন্ধ ছিল। লকডাউনে বন্ধ থাকা সুউচ্চ ভবনগুলোর পানির ট্যাংকি ও লাইন বেশি ঝুঁকিতে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা এসব ভবন বা স্থাপনার পানির ট্যাংকি বা পাইপে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ নানা ধরনের জীবাণু জন্ম নিতে পারে। মরিচাও ধরে। এ নিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’-এ বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। ‘নেচার’ বলছে, বিভিন্ন ভবনের পানির পাইপে দীর্ঘদিন জমে থাকা পানিতে নানা ধরনের ক্ষতিকর জীবাণু জন্ম নিতে পারে। তাই ব্যবহারের আগে অবশ্যই তা জীবাণুমুক্ত কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় ব্যবহারকারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বেন।
কোভিড-১৯-এর কারণে লকডাউনের সময় বিভিন্ন স্থাপনায় জমে থাকা পানি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর কী ধরনের হুমকি তৈরি করেছে, তা নিয়ে গত ২৮ এপ্রিল প্রকাশিত প্রতিবেদনে ‘নেচার’ বলছে, লকডাউনের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এসব স্থাপনার ট্যাংকিতে দীর্ঘদিন জমে থাকা পানিতে ক্ষতিকারক নানা ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিয়েছে। এর মধ্যে বড় হুমকি লেজিওনেলা নামের ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া মানুষের শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমিত হয়। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিভিন্ন স্থাপনায় জমে থাকা পানির ব্যাপারে বন্ধ প্রতিষ্ঠান খোলার আগেই সতর্ক হওয়া জরুরি।