আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে কভিড-১৯ অভিঘাত
জাহাজ শিল্পের ওপর কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তবে বেড়ে চলা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অধোগতির মানে হলো আন্তর্জাতিক জাহাজ শিল্পে চলতি সংকটের প্রভাব আরো বেশি ভয়াবহ হবে। আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে ক্রুজ লাইনার ও ফেরিসহ যাত্রীবাহী জাহাজ ডেডওয়েট টনেজ মানদণ্ডের শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ মাত্র।
আলোচ্য শিল্পে বাল্ক ক্যারিয়ারই সবচেয়ে বৃহৎ অংশ ( ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ)। এর মধ্যে অয়েল ট্যাংকার ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ, কনটেইনার শিপ ১১ দশমিক ১ শতাংশ এবং অন্য ধরনের জাহাজ (কেমিক্যাল ট্যাংকার ও গ্যাস ক্যারিয়ার) ১১ দশমিক ১ শতংশ।কার্গো-বহনকারী এসব জাহাজ খুব ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে কাজ করে। কনটেইনার শিপগুলো সাধারণত স্থির সময়সীমা, ট্যাংকারগুলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং বাল্ক ক্যারিয়ারগুলো প্রায়ই ক্ষেত্রে সিঙ্গেল-ভয়েজ চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে।
যাত্রীবাহী জাহাজগুলো সাধারণত বেশ ছোট। অন্যদিকে অয়েল ট্যাংকার এবং বাল্ক ক্যারিয়াগুলো অনেক বড় হতে পারে। এমনকি সেগুলো ৩ লাখ ডিডব্লিউটি সমান ওজনের হতে পারে। তবে এখন যেসব বড় ক্রুজ লাইনার নির্মিত হচ্ছে, সেগুলো আকারের দিক থেকে বেশ তুলনাযোগ্য। এর মধ্যে কিছু কিছুর গ্রস টনেজ ২ লাখের অধিক এবং সেগুলো প্রায় ২০০ নাবিক নিয়োজনের মাধ্যমে ৫ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারে। এসব বড় জাহাজ কভিড-১৯ মহামারী শেষে তখনো কর্মসংস্থানের উল্লেখযোগ্য উৎস হিসেবে থাকবে কিনা, সেটি দেখার বিষয়।
এদিকে সমুদ্রবাহিত বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক শিপিং এখনো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হিসেবে অব্যাহত আছে। আঙ্কটাডের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ, একই সময়ে পণ্য বাণিজ্যে ৩ দশমিক ১ শতাংশ এবং সমুদ্রবাহিত বাণিজ্যে ২ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। বিশ্ব পণ্য বাণিজ্যের চার-পঞ্চমাংশই পরিচালিত হয় সমুদ্রপথে। আগের বছরের ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ২০১৮-১৯ সালে সমুদ্রবাহিত বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধিতে পতন মূলত হয়েছিল ট্যাংকার বাণিজ্যে কেবল যৎসামান্য বৃদ্ধির কারণে।
আন্তর্জাতিক শিপিং শিল্পের ওপর কভিড-১৯ মহামারীসৃষ্ট বৈশ্বিক বাণিজ্যে মন্দা এবং তেলের দামে চলমান পতনের গভীরতর প্রভাব পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্লোটিং স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিজ হিসেবে বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানিগুলো বড় জাহাজ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সেগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে আগ্রহী হওয়ায় ট্যাংকারের চাহিদা বাড়ছে। অন্যদিকে কনটেইনার এবং বাল্ক ক্যারিয়ার শিপিংয়ে বড় ধরনের চাহিদার পতন ঘটছে। কনটেইনার শিপ অপারেটররা লোকসান কমাতে সমুদ্রযাত্রা (সেইলিং) বাতিল করছে।
ফলে আলোচ্য শিল্পের সেবার নির্ভরযোগ্যতা-বিশ্বাসযোগ্যতায় চিড় ধরছে। বাজারের পতন ঘটায় বৈশ্বিক কনটেইনার ফ্লিটের ১০ শতাংশেরও অধিক এখন বিভিন্ন পোতাশ্রয়ে নোঙ্গর করে অলস পড়ে আছে। ভোগ্যপণ্য সরবরাহ ব্যাহত হওয়া এবং প্রধান প্রধান গন্তব্যে অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় ড্রাই বাল্ক শিপিংয়ের চাহিদাও নিম্নমুখী। বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ এর দ্রুত বিস্তারের কারণে ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে বাল্ক শিপিংয়ের প্রধান নির্দেশক দ্য বাল্টিক ড্রাই ইনডেক্স ৪৩ শতাংশ পড়ে গেছে। বর্তমানে অলস পড়ে থাকা জাহাজগুলোর নাবিকদের আরেকটি চুক্তির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিপিং শিল্পে অধোগতি নাবিকদের জীবন-জীবিকারও ওপর সাংঘাতিক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রতি মাসে লক্ষাধিক নাবিক বিশ্বব্যাপী অন ও অফ থাকা জাহাজগুলোয় পরিভ্রমণ করে থাকে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও কয়েক হাজার নাবিক জাহাজে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া নাবিকরা ঘরে যাওয়ার জনে উদগ্রীব হয়ে আছেন। কিন্তু চলে গেলে নতুন চুক্তির জন্য তারা আর উপযুক্ত বিবেচিত নাও হতে পারে, এমন শঙ্কাও তাদের মধ্যে কাজ করছে। এটি অনেক উন্নয়নশীল দেশে বড় প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে, ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ সমুদ্রগামী ৪ লাখ মানুষের মজুরি দেশটির বৈদেশিক আয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসব মানুষ ২০১৮ সালে দেশটিতে ৬ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল।