শঙ্কা আর মলিনতায় অন্য রকম ঈদ
ঈদ দরজায় কড়া নাড়ছে। ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার দরজির দোকানগুলো এ সময় রাত–দিন সেলাই মেশিনের ঘর্ঘর শব্দে মুখর থাকে। সাধারণত শবে বরাতের পর থেকেই অর্ডার নেওয়া শুরু হয়, আর প্রতিবছরই দেখা যায় ১০-১২ রোজার পর থেকে অর্ডার নেওয়াটাও বন্ধ করে দিতে হয়। এই দেড় মাসে মালিক, কর্মচারী কারও দম ফেলার সময় থাকে না। ২৪ ঘণ্টা দোকান-কারখানা খোলা থাকে। এ সময় কারিগরেরা কারখানাতেই থাকেন। তাঁদের রাতের খাবার, সাহ্রি, ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। বছরের এই সময়টায় সবারই প্রায় দ্বিগুণ, তিন গুণ বা তারও বেশি আয় হয়। এমনই চিত্র দেখে আসছেন চাঁদনিচক মার্কেটের মহানগর টেইলার্সে ২৪ বছর ধরে কর্মরত দরজি রহমত মিয়া (ছদ্মনাম)। তাঁদের তিনজন অংশীদারের গড়া মার্কেটের মধ্যে মোটামুটি বড় তাঁদের এই টেইলার্সটি। রোজার ঈদের এ সময়টায় ২০ জনের জায়গায় প্রতিবছরই প্রায় ৩০-৩২ জন কর্মচারী রাখতে হয় তাঁদের।
স্বাভাবিক সময় তাঁদের এখানে শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, থ্রি–পিস, লেহেঙ্গা, ফ্রক, গাউন মিলে প্রতি মাসে চার শর মতো ফরমাশ আসে; ঈদের সময় একলাফে তা বেড়ে অন্তত দেড় হাজারে পৌঁছায়। আর প্রতিবছরই চাঁদরাতে সব কর্মচারীর পাওনা মজুরি পরিশোধ করে শেষ মুহূর্তে বউ–বাচ্চার ঈদের বাজার হাতে কোনো একটা বাস চেপে ঈদ জামাত ধরার জন্য নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের তাঁর বাড়ির পথ ধরেন রহমত মিয়া। পড়িমরি করে ছুটে চলা ঈদের আগমুহূর্তের সেই যাত্রায় প্রতিবছরই তাঁর সঙ্গী হতো আত্মতৃপ্তি, সফলতা ও সচ্ছলতার একটা অন্য রকম অনুভূতি। চিরাচরিত মধুময় স্মৃতির সেই হিসাবটা যেন পুরাই ওলট-পালট করে দিল এবারকার দেশের এই চলমান পরিস্থিতি। প্রায় দুই মাস হতে চলল তাঁদের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। পুরো মার্কেটটাই কেমন যেন স্তব্ধ, নীরব। সরকারের তরফ থেকে মার্কেট খুলে দিলেও তিনি দোকান খোলারও ভরসা পেলেন না। কার না কার থেকে আবার করোনার সংক্রমণ ছড়াবে, কিছু তো বলা যায় না; সব মিলে এ কয়দিনে নিজের দু–চার পয়সা লাভের আশায় এতগুলো কর্মচারীর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবেন, এত সব চিন্তা করে বিবেকের কাছে ও শেষমেশ হার মানলেন তিনি। যা হওয়ার তা–ই হলো, নিয়মিত কর্মচারীগুলোর বেতনটা পর্যন্ত দিতে পারলেন না এবার; আয় যে পুরোই বন্ধ। কর্মচারীরা যে যাঁর মতো বাড়ি চলে গেছেন আগেই। বহু বছরের স্থায়ী কর্মচারী, হাতে ধরে ধরে এক-একজনকে কাজ শিখিয়েছেন; হুট করে তাই ছেড়েও দেওয়া যায় না। সবকিছু মিলিয়ে কটা দিন ধরে সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি কেমন যেন নীরব, স্তব্ধ; গত ২৪ বছরের ক্লান্তি হঠাৎ করেই একসঙ্গে যেন পেয়ে বসেছে তাঁকে। বড়ই অন্য রকম একটা ঈদ তাঁর জীবনে এল এবার। রহমত মিয়া র মতোই এরকম লাখো দরজি, ফুটপাতের ভাসমান হকার, দোকানদার, কমলাপুর রেলস্টেশনের কুলি–মজুর থেকে শুরু করে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড আর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের টিকিট চেকার, দেশজুড়ে আরও কত কী; সবার জীবনেই সারা বছরের অপেক্ষায় থাকা ঈদ মৌসুমের এই দিনগুলো আবির্ভূত হলো আশাভঙ্গের একেকটি প্রতিচ্ছবি হয়ে। তাঁদের সবার বাস্তবতার গল্পই এক সুতোয় গাঁথা, অনেকটা অভিন্ন; হয়তো উনিশ আর বিশ। শত বছরের মধ্যে এবারের ঈদটা একেবারেই কেমন যেন ভিন্ন। অতীতের বহু ঈদ যেমন মন খুলে উৎসব-আনন্দে পার করেছি; বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতেও হয়তো আরও দ্বিগুণ আনন্দে ঈদ পালন করব, ইনশা আল্লাহ। জীবন-জীবিকার দ্বন্দ্বের নামে সরকার জীবিকাকে প্রাধান্য হয়তো দিতেই পারে কিন্তু এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে জীবন আর আড়ম্বরপূর্ণ উৎসবের মধ্যে আপনি কোনটি বেছে নেবেন, সেটি একান্তই আপনার বিবেচনা। একটি বিষয় বোধ হয়, মনে রাখাটা এখন খুব জরুরি; আর তা হলো, রাষ্ট্রের কাছে আপনি হয়তো কেবলই একটি সংখ্যামাত্র কিন্তু আপনার প্রিয়জনের কাছে আপনিই তাদের পুরো পৃথিবী।
ঈদ কেবল একটি দিনের আনন্দ নয়; রোজার প্রতিটি দিন আনন্দ, অপেক্ষা আর প্রস্তুতিতে ঈদের বার্তা নিয়ে আসে। নতুন পোশাক, বাহারি জুতো, হাল ফ্যাশনের গয়নায় মোড়ানো ঈদ হয়তো আসবে না এবার তার চিরচেনা রঙে, তারপরও; এবারের ঈদের আনন্দ হোক পরিবারের সবার সুস্থতা, একসঙ্গে মিলে বাড়িতে থেকে পরস্পরের সান্নিধ্যে নতুনভাবে, নতুন বেশের অন্য রকম একটি ঈদ। জলে ঘূর্ণিঝড় আম্পান, ডাঙায় করোনা আর ডোবা-নর্দমার ওপাশ থেকে একটু একটু করে উঁকি দিতে শুরু করেছে ডেঙ্গু; তারপরও আশায় থাকতে চাই, মহামারিমুক্ত নতুন পরিবর্তিত একটি পৃথিবী গড়ার সংকল্পে; এবারের ঈদটাও আসুক তার শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার নতুন বার্তা নিয়ে; নতুন কোনো অচেনা রঙে। আর বাকি সবার সঙ্গে আমিও তাকিয়ে রইলাম, সেই নতুন আর নিরাপদ দিনের প্রত্যাশায়...।ঈদের শুভেচ্ছা সবাইকে।