প্লাজমা থেরাপিতে এগিয়ে আসতে এন্টিবডি টাইটার মেপে দেখতে দিন
তখন বোধ হয় সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাঠটা ছোট। আমরা আড্ডা দেই। মন ভরে না।বুয়েটের মাঠটা কি বিশাল। আমরা মাঝে মধ্যে বুয়েটের মাঠে যাই। কি সুন্দর মাঠ! গল্প করি, দল বেঁধে হাঁটি,অকারণ হাসি। বয়সটাই তখন অমন ছিল। আনন্দ খুঁজে নেই পৃথিবী আর প্রকৃতি থেকে।লেখাপড়ার ভীষণ চাপ। আইটেম, কার্ড ফাইনাল,প্রফ.... আমাদের জীবনকে বাঁধতে চায়। আমরা আলগা করি বাঁধন। সম্পর্কিত খবর করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে ইউরোপে ফিরল ফুটবলহাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় চিকিৎসক পাঠাবে ছাত্রলীগএকটু পরিবর্তিত হই সেইদিনও আমরা বুয়েটের মাঠে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। আমাদের হোষ্টেলে ফিরতে মন চায় না। রুমে গেলেই আবার সেই গ্রে আর গাইটন! বইগুলো আমাদের শান্তি কেড়ে নিতে চায়। আমরা পালিয়ে থাকি কিছুটা সময়।সবে বন্ধুত্ব হয়েছে আমাদের বন্ধুদের সাথে। কথার ফুলঝুরি ফুরোয় না। বিকট একটা শব্দ শুনে দৌড়ে আসি হোষ্টেলে। কিসের শব্দ তখনও জানি না। ভয়ে আধমরা হই। বুয়েটের বিশাল মাঠ পাড় হয়ে ছুটছি আমরা কয়জন।
সন্ধানী তখন আমাদের ধ্যান। সন্ধানী অফিসে আমাদের অনেক সময় কাটে। আমরা তড়িঘড়ি করে কলেজের গেট দিয়ে সন্ধানী অফিসে যাই। ততক্ষণে জেনে গেছি জগন্নাথ হলের ছাদ ভেঙে পড়েছে। অনেকে আহত। ছোটাছুটি শুরু হয়। আমাদের আর রুমে যাওয়া হয় না। আহত সবাইকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। কি হৃদয়বিদারক দৃশ্য! রক্ত লাগবে। চিকিৎসার জন্য প্রচুর রক্ত প্রয়োজন। দলে দলে সবাই আসে রক্ত দিতে। আমরা হিমশিম খাই। ডোনারদের বোঝানো যায় না, থামানো যায় না। রক্ত নিয়ে যায় হাসপাতালে। এত ডোনারের চাপ সামলানো দায় হয়। সারারাত চলে রক্ত সংগ্রহ। রানা প্লাজার কথা আমরা সবাই জানি। মানুষের ঢল নেমেছিল রক্ত দেবার জন্য। ২৪ এপ্রিল এলেই আমার মনে পড়ে সেইদিনের কথা। কি কষ্টকর স্মৃতি থেকে পালিয়ে যেতে চাই,পারি না। নিমতলীর আগুনের কথা জানি। জানি মৃত্যু কেমন করে কেড়ে নেয় জীবন। তখনও ছুটে এসেছে মানুষ কাতারে কাতারে। কোভিড১৯ আমাদের দাঁড় করিয়েছে এমনই এক সময়ে।কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয়নি। কোনো ভ্যাকসিন এখনো পাওয়া যায়নি। বিশ্ব জুড়ে চলছে গবেষণা। একবার আশার আলো দেখি, আবার নেই হয়ে যায় আলো! কি ভীষণ অন্ধকার ছেয়ে আছে পৃথিবীর চোখে। বাংলাদেশের মানুষ সচেতন নয় কথাটা বলা কিন্তু সহজ নয়। জীবিকার জন্য মানুষকে বের হতে হয়। পেটে ক্ষুধা নিয়ে করোনার ভয়ে ঘরে থাকার সুযোগ নেই। আর কারো কারো আবার ঘরে মন নেই। সচেতনতা আসবে এটাও আর আশা করা যায় না। মানুষ ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এর মধ্যে চিকিৎসা চলছে। নতুন নতুন কোভিড হাসপাতাল চালু হচ্ছে। আক্রান্ত ডাক্তার, নার্স সুস্থ হয়ে কাজে ফিরছেন।আমরা হারিয়েছি অনেককে ইতিমধ্যে। সংক্রমণ বাড়ছেই। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এটা আশা জাগানিয়া কথা। আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হবার পর নিজস্ব এন্টিবডি তৈরী হয় তাঁর শরীরে। রক্তের জলীয় সাদা অংশে থাকে এই এন্টিবডি, এটাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। তার থেকে এই এন্টিবডি নিয়ে মারাত্মক ঝুঁকি পূর্ণ আক্রান্ত রোগীকে দিলে তিনি ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করতে পারেন, পারেন হতে সুস্থ। উপসর্গ কমতে শুরু করে। তাঁকে আইসিইউ আর ভেন্টিলেটর থেকে বের করে আনা যেতে পারে। বাঙালী বীরের জাতি। এবারও জানি আক্রান্ত হবার পর সুস্থ জনেরা এগিয়ে আসবেন জীবন বাঁচাতে। ফিরিয়ে আনবেন ঝুঁকি পূর্ণ আক্রান্ত রোগীকে জীবনে। কিন্তু এখানেই সব কথা শেষ নয়! আপনার এন্টিবডি কতটুকু তৈরী হয়েছে, সেটা না জেনে রোগীকে দিলে আশানুরূপ সাফল্য আসবে না চিকিৎসায়। আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিমাপ করতে হবে আগে। এন্টিবডি টাইটার মেপে তবেই নিতে হবে সাদা জলীয় অংশ রক্ত থেকে। ১ঃ১৬০ টাইটার না হলে আপনার থেকে রক্ত নিয়ে আরেকজনের শরীরে দিলেই হবে না। কিউর স্মাইল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন এই টাইটার করার কাজটা করছেন,ঢাকা মেডিকেল কলেজের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের জন্য। শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান এতগুলো কাজ করতে কতটা সফল হবেন জানি না। আর রোগী তো বাড়বেই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এলাইজা পদ্ধতিতে একসাথে ৯৬ টা স্যাম্পলের টাইটার দেখা যায় একবারে। সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। এই কাজের জন্য প্রয়োজন স্যাম্পেল। যারা সহমর্মিতা আর ভালবাসার হাত বাড়িয়েছেন প্লাজমা থেরাপির জন্য, তাদের কাছে অনুরোধ জানাই। আগে আপনার এন্টিবডি টাইটার মেপে দেখার সুযোগ দিন। আপনারা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে আসুন। সামান্য রক্ত নিয়ে আগে টাইটার করার কাজটা করতে দিন। আপনার টাইটার ১:১৬০ বা ততোধিক হলেই কেবল আমরা আপনাদের রক্তের জলীয় সাদা অংশ নেবো। এর কম হলে নেবো না। যেহেতু শুধু মাত্র সাদা জলীয় অংশ নেওয়া হবে, তাই এটা রক্তদানের চাইতেও সহজ প্রক্রিয়া। আপনার থেকে মাত্র ৪০০ মিলি প্লাজমা নেওয়া হবে যদি এন্টিবডি টাইটার ১:১৬০ থাকে। প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ হোক তারপর। অনেকেই ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছেন। প্লাজমা দান করেছেন। ডাক্তাররা বেশী এসেছেন। আজ এটিএন নিউজের কর্মী এসেছেন। সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে আসুন। আপনাদের এন্টিবডি টাইটার মেপে দেখার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ প্রস্তুত হয়ে আছে। ডাক্তার, টেকনোলজিস্ট সবাই আপনাদের অপেক্ষায় আছেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনার এই সাদা জলীয় অংশ পূরণ হতে বড় জোর ৪৮ ঘন্টা সময় লাগবে। আর আপনার শরীর থেকে সংগ্রহ করতে সময় লাগবে আনুমানিক ৩০ মিনিট। জীবনের জন্য আপনার এই দান ইতিহাস হোক। জীবনকে ফিরিয়ে আনুন জীবনে আপনার সদিচ্ছার আলোকে। "মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য "----- আমরা যেন ভুলে না যাই। আপনার নিকটজনেরও লাগতে পারে প্লাজমা, আপনার পরিবারের কারো লাগতে পারে, আপনার বন্ধু কারো লাগতে পারে..... আপনার প্রস্তুতি শুরু হোক। রক্তের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিমাপটা জেনে রাখুন অন্তত! কখন, কার প্রয়োজন হবে, তখন হয়তো সময় আমাদের দেবে না এতটা সময়!