হারিয়ে যাওয়া ভাইরাস, প্যানডেমিক ১৯১৮
বলা হয়ে থাকে, এ পর্যন্ত মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর মহামারি ছিল ১৯১৮ সালের ফ্লু (Flu) প্যানডেমিক। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে সম্মিলিতভাবে যত মানুষ মারা যায়, তার চেয়েও বেশি মৃত্যু হয়েছিল এই মহামারিতে। তখন বিজ্ঞান এতটা উন্নত ছিল না, মানুষ জানত এই ফ্লু ছিল ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফল। তারও অনেক পরে ১৯৩০ সালে আবিষ্কার হয় যে ফ্লু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। কিন্তু কেনই বা ১৯১৮ সালের ফ্লু ভাইরাস এত শক্তিশালী ছিল এবং দ্রুততম সময়ে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে মৃত্যুহার বাড়িয়ে তুলেছিল? এর উৎস কি ছিল পাখি নাকি কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী? পরবর্তী যেকোন মহামারি থেকে প্রতিরোধের উপায় জানার জন্য এই ভাইরাস সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা খুব প্রয়োজন ছিল। ১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির ছাত্র জোহান হালটিন ১৯১৮ সালের ভাইরাসটি পুনরুদ্ধারের আশা ব্যক্ত করেন এবং তাঁর দলসহ আলাস্কায় অভিযান চালায়। ব্রেভিগ মিশন আলাস্কার ছোট্ট একটি গ্রাম। ১৯১৮ সালের মহামারিতে এই গ্রামের ৮০ জন অধিবাসীর মধ্যে ৭২ জনই মারা যান, আর তাঁদের শেষ শয্যা হয় সেখানকার একটি গণকবরে। পার্মাফ্রস্টে (চিরহিমায়িত স্থান) মৃতদেহগুলো এত বছর পরও সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় ছিল। হালটিন আর তাঁর দল স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করে। এই পুরু বরফের স্তর ভেদ করে মৃতদেহ থেকে ফুসফুস নমুনা সংগ্রহ করতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। ৫টি নমুনাসহ তাঁরা ফিরে যান এবং ল্যাবরেটরিতে ভাইরাসটি পৃথক করার চেষ্টা চালান। কিন্তু হালটিন সে সময় সফলতা পাননি। এরপর ৪৬ বছর কেটে যায়। ১৯৯৭ সালের সায়েন্স জার্নালে ১৯১৮ সালের ফ্লু ভাইরাসের আরএনএর আংশিক জেনেটিক গঠনের ওপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। পত্রের মুখ্য লেখক তরুণ বিজ্ঞানী জেফরি টবেনবার্জার তখন ওয়াশিংটন ডিসির আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজিতে কর্মরত ছিলেন। টবেনবার্জার আর তাঁর টিম ১৯১৮ সালের ফ্লুতে মারা যাওয়া ২১ বছরের এক সৈনিকের সংরক্ষিত ফুসফুস নমুনা থেকে ভাইরাসটি পৃথক করতে সক্ষম হন, তবে তাঁরা এর সম্পূর্ণ জেনেটিক গঠন বের করতে পারেননি। আক্রান্ত সৈনিকটি সাউথ ক্যারোলাইনার ক্যাম্প হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর ফুসফুস সংরক্ষণ করে রাখা হয়। আর্টিকেলটি পড়ার পর হালটিন টবেনবার্জারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন আর তাঁর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। হালটিন আবারও ব্রেভিগ মিশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন, তখন তাঁর বয়স ৭২ বছর। অভিযানের পুরো খরচ তিনি একাই বহন করেন। তাঁর স্ত্রীর বাগান করার যন্ত্রপাতি এই অভিযানে খুব কাজে দিয়েছিল। ৭ ফুট পুরু বরফের স্তরের নিচে এক ইনুইট যুবতীর (যার নাম হালটিন দিয়েছিলেন লুসি) অবিকৃত ফুসফুস তিনি উদ্ধার করে পাঠিয়ে দেন টবেনবার্জারের ল্যাবরেটরির ঠিকানায়। হালটিন এবার আর ব্যার্থ হননি; ১০ দিন পরে ফোন আসে সম্পূর্ণ ফ্লু ভাইরাসটি লুসির ফুসফুস টিস্যু থেকে পৃথক করা গেছে এবং এর পূর্ণ জেনেটিক গঠনও উদ্ধার করা গেছে (ফ্লু ভাইরাসে ৮টি জিন থাকে)। পরবর্তী বছরগুলোতে প্রতিটা জিন নিয়ে বিশদ গবেষণা হয় ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য ভালোভাবে জানার জন্য। ১৯১৮ সালের ভাইরাসের ক্ষেত্রে ঠিক কোন প্রোটিন বা জিন এই ভয়াবহ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিল, তা জানার জন্য তৎকালীন সরকার এবং সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়, ল্যাবের কালচার মিডিয়াতে আবার সেই ভাইরাস গ্রো করা। একজন মাত্র সিডিসি মাইক্রোবায়োলজিস্টকে এই কঠিন দায়িত্ব দেওয়া হয়, ড. টেরেন্স টাম্পেই। বায়োসিকিউরিটি লেভেল-৩ ল্যাবরেটরিতে (সবচেয়ে উচ্চতর নিরাপত্তা বায়োসিকিউরিটি লেভেল-৪) তিনি কাজ শুরু করেন। নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য তিনি শুরু থেকে অ্যান্টিভাইরাল নিতেন। সবার অফিস শেষ হয়ে যাওয়ার পর অফ-আওয়ারে তিনি ল্যাবে কাজ করতেন, যাতে সহকর্মীদের কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি না থাকে। তার ওপর নির্দেশ ছিল যদি কোনো প্রকার রোগলক্ষণ দেখা দেয়, তবে তিনি হোম কোয়ারেন্টিনে চলে যাবেন। সব শর্ত মেনে এবং সাবধানতার সঙ্গে ড. টাম্পেই দিনের পর দিন কালচার মিডিয়াতে ভাইরাস গ্রো করার চেষ্টা করতে থাকেন।
- ট্যাগ:
- আন্তর্জাতিক
- ভাইরাস
- ইতিহাস
- স্প্যানিশ ফ্লু