করোনায় ‘ঘরবন্দী’ থাকতে ঢাকার আবাসন কতটা স্বস্তিকর
নিশ্চিত না হলেও গবেষকদের মধ্যে এমন একটা আলোচনা আছে, উচ্চ তাপমাত্রার পরিবেশে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি কিছুটা কমায়। এতে আশা দেখছিল বাংলাদেশের মানুষ। কারণ, কদিন ধরেই তাপমাত্রা বাড়ছে। সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা, কোথাও কোথাও লকডাউন। এর ফলে ঘরবন্দী সারা দেশের মানুষ। গ্রামে যা-ই হোক, রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর মানুষ কেমন আছে? এমনিতে ঢাকা বসবাসের নগরী হিসেবে সবচেয়ে খারাপ শহরের তালিকায় শীর্ষে। আবাসন সংকট সর্বত্র। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ, বস্তিবাসীদের বাসস্থানের অবস্থা তো আরও খারাপ। কেউ কেউ একটা ঘরে গাদাগাদি করে ৮-১০ জন থাকছেন। চৈত্রের খরতাপে এমনিতেই কিছুটা নাভিশ্বাস উঠে। এবার লকডাউনের কারণে পরিবারের সব সদস্যই ঘরে। ফলে এই থাকাটা কোনোভাবেই আরামদায়ক নয়। তার পরও দাতে দাঁত চেপে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন ঢাকাবাসী। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ঢাকাসহ সারা দেশে তাপ প্রবাহ চলছে। সেটা আগামী কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে। এর মধ্যে কোথাও কোথাও দমকা ও ঝেড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। গত শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্র ছিল রাজশাহীতে ৩৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন তেঁতুলিয়ায় ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৪.৫ ডিগ্রি। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে এসেছে। রাজধানীর ছলমাইদ এলাকার পরিবহনশ্রমিক মামুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দুই কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। পরিবারের সদস্য ছয়জন। স্বাভাবিক সময়ে সব সদস্য একসঙ্গে ঘরে থাকেন না। শুধু ঘুমের সময় সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যায়। এখন লকডাউনের সময় সবাই ঘরেই থাকছেন। স্কুলপড়ুয়া দুটি মেয়ে সবচেয়ে বেশি হাঁসফাঁস করে। কারণ, স্কুলও বন্ধ। বাইরেও যাওয়া যাচ্ছে না। তার পরও পরিবারের সদস্যদের ঘরেই রাখছেন। তিনি বলেন, একটু কষ্ট হলেও বাসায় থাকলে তো জীবনের ঝুঁকি কিছুটা কম থাকে। রাজধানীর আবাসন চিত্র নিয়ে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয় ২০১৮ সালে। এতে দেখা যায়, ঢাকায় বসবাসরত ৫৬ শতাংশ মানুষের ঢাকায় কোনো নিজস্ব জমি বা বাড়ি নেই। বস্তিবাসী যোগ করলে হিসাব ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ঢাকায় বসবাস করা অধিবাসীদের ৩২ শতাংশ নিজেদের বাড়িতে থাকে, বাকি ৬৮ শতাংশ থাকে ভাড়া বাড়িতে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ এক হাজার বর্গফুটের চেয়ে ছোট বাসায় থাকে। ৫ ভাগ মানুষ বাস করছে দুই হাজার বর্গফুটের ঘরে। এই চিত্র থেকে এটা পরিষ্কার, ঢাকার বেশির ভাগ মানুষই স্বল্প জায়গায় বসবাস করে। অবশ্য এই লকডাউনের সময়টায় যাতে হাঁসফাঁসের সৃষ্টি না হয়, সে জন্য নিজেদের মতো করে সময় কাটানোর উপায় বাতলে নিচ্ছেন অনেকে। কেউ সিনেমা দেখে, বই পড়ে, অনলাইনে নানা কোর্স করে সময় কাটাচ্ছেন। লকডাউনের সময়টাকে পরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি থাকার ভালো দিকই দেখছেন বেশির ভাগ মানুষ। সরকারি কর্মকর্তা আজমল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী। এ জন্যে দুই সন্তানকে আগে সময় দিতে পারতেন না। লকডাউনের সময়টাতে তিনি নিয়ম করে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছেন, গল্প করছেন, সময় দিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে সন্তানের পড়াশোনাতেও সহায়তা করছেন। তিনি জানান, সময় কাটানোর পাশাপাশি পেশাগত উৎকর্ষের জন্য তিনি একটা অনলাইন কোর্স করছেন। তবে রাজধানীর ফ্ল্যাটবাড়িগুলো চলে ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে। বাসায় আসা-যাওয়াসহ সবকিছুই নিয়মের মধ্যে করতে হয়। এ জন্যে ছাদের চাবিও থাকে কমিটির নেতাদের হাতে। তাই চাইলেই একটু ছাদে গিয়ে সময় কাটানোর সুযোগ হয় না। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী ফোজায়েল আহমেদ বলেন, বাচ্চাদের নিয়ে ছাদে একটু বেড়াতে পারলে দমবন্ধ পরিবেশ কিছুটা কাটে। তিনি ছাদে যানও। তবে তাঁর ইচ্ছেমতো হয়ে ওঠে না। কারণ, ফ্ল্যাট মালিক সমিতি ভাড়াটিয়াদের হাতে চাবি দেয় না। তাদের অনুরোধ করে নির্দিষ্ট সময়ে ছাদে যেতে হয়। আতঙ্কে এসির ব্যবহার কমে গেছে করোনাভাইরাস এমন একটি গোত্রের সদস্য, যাদের বলা হয় ‘এনভেলপড ভাইরাস’। এর মানে হলো, এই ভাইরাসের চারপাশে প্রোটিনের তৈরি একটা তৈলাক্ত আস্তরণ থাকে, যাকে বলা হয় লিপিড বাইলেয়ার। গবেষকেরা বলছেন, ঠান্ডা আবহাওয়ায় সেটি আরও টেকসই হয়ে ওঠে। রান্না করা মাংস ঠান্ডা করা হলে যেমন চর্বির একটা আস্তর তৈরি হয়, অনেকটা তেমন। এ জন্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (এসি) বা ঠান্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলার একটা প্রবণতা নগরবাসীর মধ্যে আছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই বাসাবাড়িতে এখন এসির ব্যবহার ব্যাপক বেড়েছে। চৈত্রের খরতাপে এসির ব্যবহার শুরু হয়। তবে রাজধানীর অনেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের ভয়ে তাঁরা এসির ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন। পুরান ঢাকার মালিটোলার বাসিন্দা ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবসায়ী আবদুল করিম জানান, এসি চালু রাখলে করোনার ঝুঁকি বাড়ে, এমন একটা কথা তিনি শুনেছেন। সত্য-মিথ্যা জানেন না। এ জন্যেই এখন পারতপক্ষে এসি চালান না।