লিগ্যাল এইড অফিস বগুড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনি সেবা
আইনি সহায়তা নিতে প্রতিদিন সাধারণ মানুষ দ্বারস্থ হচ্ছে লিগ্যাল এইডের বগুড়া কার্যালয়ে। বাদী বিবাদীর সঙ্গে কাউন্সিলিং করে সফলভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে অসংখ্য মামলা। এতে আদালতের উপর মামলার চাপ কমার পাশাপাশি হয়রানি থেকে রক্ষা পাচ্ছে শ’ শ’ পরিবার। বগুড়া লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে প্রতিদিন আসছে বিচার প্রার্থীরা। কেউ আসছেন বিচার চাইতে আবার কেউ আসছেন অফিসের ডাকে হাজিরা দিতে। দ্বন্দ্বের প্রকৃতি নানাবিধ। পারিবারিক, জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ, স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব নির্ধারণ থেকে নিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন, আর্থিক বিবাদসহ অন্যান্য দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিষয়। বাদী বিবাদীদের অফিসের মাধ্যমে নোটিস দিয়ে দিন তারিখ নির্ধারণ করে ডাকা হয়। যারা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে উপস্থিত হন তাদের নিয়ে কখনো আলাদা ভাবে আবার কখনো মুখোমুখি বসিয়ে কাউন্সিলিং করেন সিনিয়র সহকারী জজ ও বগুড়া জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার শরিফুল ইসলাম। বাদী বিবাদীকে মামলার খারাপ দিকগুলো ভালোভাবে বুঝিয়ে স্বাভাবিক জীবনের গতি ফিরে আনতে এই কাউন্সিলিং জোরালো ভূমিকা রেখে চলছে। এতে শ’ শ’ পরিবার মামলার ঝামেলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে। রোধ হচ্ছে অর্থের অপচয়ও। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে আইনি সুবিধা প্রাপ্তদের উল্লেখযোগ্য অংশই নারী। নারী ভিকটিমদের তাৎক্ষণিক সহায়তা দিতে এখানে আছে একটি নারী সহায়তা ডেস্ক। ডেস্কে জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক তহবিল (ইউএনএফপিএ)-র সহায়তায় নিযুক্ত আছেন সার্বক্ষণিক একজন মহিলা আইনজীবী। আছে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার এবং শিশুদের জন্য খেলাধুলার সামগ্রী সমৃদ্ধ একটি কিডস জোন। ফলে বাস্তবিক অর্থেই অফিসটি নারী ও শিশু বান্ধব। আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে যারা নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করা, তাদেরকে আইনী পরামর্শ দেয়াই হচ্ছে লিগ্যাল এইডের মূল সেবা। তবে পরামর্শ সেবা আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং অসচ্ছল সবার জন্যেই উন্মুক্ত। এছাড়াও বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের বিধানমতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাও লিগ্যাল এইড অফিস করে থাকে। ঘরোয়া এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যস্থতায় মিটমাট করা হয় জটিল মামলাও। এতে প্রায় ভেঙে যাওয়া অনেক সংসার রক্ষা পাচ্ছে। আদালতের মাধ্যমে মামলার ফয়সালা হলেও দুই পক্ষের মধ্যে শত্রুতা চলতে থাকে বংশপরম্পরায়। সেক্ষেত্রে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মীমাংসা হলে দুই পক্ষের হাতে হাত মিলিয়ে তাদের মনোভাবের পরিবর্তন করার মাধ্যমে শত্রুতাও দূর হয়ে যায়। ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে এই পন্থা প্রশংসার দাবীদার হয়ে উঠেছে। এদিকে লিগ্যাল এইড বগুড়া কার্যালয় ইতোমধ্যেই সফল বিচারিক কার্যক্রমে মডেল হয়ে উঠেছে। প্রচার প্রচারণা আরো বেশি হলে প্রত্যন্ত গ্রামের অসহায় অনেক মানুষ এই সেবা নিতে পারবে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিস বগুড়ায় যৌতুক সংক্রান্ত মামলা দায়ের করেছিলেন পিংকি আক্তার। তিনি মানবজমিনকে জানান, তার স্বামী মাঝেমধ্যেই যৌতুকের জন্য তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো। অনেক সহ্য করার পর অত্যাচারের মাত্রা চরমে পৌঁছালে তিনি লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে বিচার প্রার্থনা করেন। তার অভিযোগ আমলে নিয়ে লিগ্যাল এইড অফিস তার স্বামীকে নোটিস দিয়ে ডেকে মামলার জটিলতা সম্পর্কে বুঝিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করতে উদ্বুদ্ধ করে। পরে সফলভাবে তাদের মামলার সমাপ্তি ঘটে। বিচার পেয়ে স্বামী স্ত্রী উভয়ই খুশি। অপর এক নারী মোর্শেদা বেগম জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে বিচার চাইতে আসেন বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা থেকে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্যের মাধ্যমে লিগ্যাল এইডে অফিস সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন। এখানে অভিযোগ করলে দুই পক্ষকেই যথারীতি নোটিসের মাধ্যমে ডাকা হয়। মোর্শেদা আশা করেন তিনি এখানে সহজেই ন্যায় বিচার পাবেন। এদিকে লিগ্যাল এইড অফিস বগুড়ার একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এখানে ২৮৯ অভিযোগ দাখিল হয় (কেস, প্রি-কেসসহ)। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ২৪৯টি। আর নিস্পত্তিকৃত অভিযোগের মধ্যে সফল হয় ১২২টি। উপকার ভোগীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। এই কার্যালয়ের মাধ্যমে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে অর্থ আদায় হয়েছে প্রায় ৮০ লাখ টাকা। সিনিয়র সহকারী জজ ও বগুড়া জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার শরিফুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, বিধিবদ্ধ বিচার প্রক্রিয়ার একটু বাইরে ঘরোয়া পরিবেশে এখানে সুষ্ঠুভাবে বিচার প্রক্রিয়া চালানো হয়। ফলে আগের তুলনায় বেশি বিচার প্রার্থীরা এখানে আসছেন। তিনি আরো বলেন, লিগ্যাল এইড সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ। এই উদ্যোগের প্রচার যদি তথ্য অফিসের মাধ্যমে আরো বেশি করার উদ্যোগ সরকার নেয় তাহলে লিগ্যাল এইড আরো বেশি গণমুখী হবে এবং সামাজ থেকে মামলার মত ঝামেলাপূর্ণ কাজ থেকে সাধারণ মানুষ ক্রমশ মুক্তি পাবে। তিনি লিগ্যাল এইড অফিসে জনবল সংকট নিরসনের দিকেও নজর দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।