টর্চার সেলে নির্যাতন নয় ওদের কথায় ‘আশীর্বাদ’
২০১১ নম্বর রুম থেকে ফেরাআবরার ফাহাদ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ২০১১ নম্বর কক্ষে। শেরে বাংলা হলের সেই টর্চার সেল থেকে ফেরা একজন শিক্ষার্থী বলেন, এই মাসের ২ তারিখ রাত ১২টার সময় আমার রুমে পড়ছিলাম। এই সময় ২০১১ নম্বর রুমে ডেকে নেয়া হয়। প্রথমে আমাদের ১০ মিনিট ধরে সালাম-আদাব দিতে হয়। সেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ৬ জনকে। এরপর বলা হয় জিহ্বা দিয়ে কলম প্যাঁচিয়ে ধরে রাখতে। কলম পড়লেই স্ট্যাম্প দিয়ে মারতে থাকে ১৮ ব্যাচের ভাইয়েরা। মারের চোটে চিৎকার করলে ফের মারা হতো। আমাদের পুরো শরীরে লাল দাগ হয়ে যায়। এত জোড়ে আঘাত করতো তার পরেও চিৎকার করা বারণ। চিৎকার করলেই দ্বিগুণ নির্যাতন। তারা মারার সময় রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে কে কার থেকে বেশি আঘাত করতে পারে।চড় মেরে আশীর্বাদআরমান খান। সদ্য প্রাক্তন এক বুয়েট শিক্ষার্থী ভয়াবহ র্যাগের মধ্যে দিয়ে পাড়ি দিয়েছেন প্রথম বর্ষ। তিনি বলেন, আমি আহসান উল্লাহ হলে থাকতাম। আমাদের প্রথম বর্ষের থেকে রোল নম্বর লটারি করে ৫ জনকে নিয়ে যায় বড় ভাইয়েরা। হলের ছাদে আসার সঙ্গেই ১২ জন বড় ভাই একটা করে চড় দেয়। এটাকে তারা বলে আশীর্বাদ দিয়ে দিলাম। এরপর আমাদের ৫ জনকে একপায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ৩০ মিনিট এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেই রাতে ৫ ঘণ্টা ধরে চলে র্যাগ। এরপর অশ্লীল গান, নাচ, অভিনয়ের পর রাত ৩টায় ছাড়ে। আমি একবার হেসে ফেলেছিলাম। এই অপরাধে আমাকে চারজন পালা করে মারতে থাকে। মারতে মারতে আমার পা ভেঙ্গে দেয়।টয়লেট থেকে বের হতে দেরি হওয়ায়১৮তম ব্যাচের কাজী নজরুল ইসলাম হলের এক ছাত্র বলেন, রাত তখন আনুমানিক ৩টা। আমি টয়লেটে ছিলাম। সেসময় এক বড় ভাই দরজায় টোকা দেয়। কিন্তু আমার বের হবার মতো অবস্থা ছিল না। আমি বের হই প্রায় ৫ মিনিট পর। এই কারণে আমাকে ডেকে নিয়ে ১২ জন ভাই পেটাতে থাকে। আমাকে ২ হাত বেঁধে স্ট্যাম্প দিয়ে পেটোনো হয়। প্রায় ১৫ মিনিট পেটায় এক বড় ভাই। একেকটা মার বজ্রপাতের মতো শরীরে পীড়া দিচ্ছিল। এরপর সেখানে ২ ঘণ্টা চালোনো হয় নানা মানসিক নির্যাতন। এরপর রাত ২টা থেকে ভোর পর্যন্ত শীতের রাতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় ছাদে।প্রেমিকাকে ক্যাম্পাস নিয়ে আসায়আমার বাড়ি জামালপুরে। আমার প্রেমিকা থাকে সেখানে। সে ঢাকায় এসেছিল। তাকে আমার ক্যাম্পাস ঘুরে দেখাই। এই সময় বড় ভাইয়েরা আমাকে দেখে ফেলে। এরপর সেই রাতেই আমাকে ডাকা হয়। আমি তিতুমীর হলে থাকি। বড়ভাইদের রুমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয়। আমি পেট চেপে ধরেছিলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এরপর শুরু হয় বিচার। ক্যাম্পাস কী প্রেম করার জায়গা? এর জবাবে সন্তুষ্ট হয় না তারা। এরপর আমার ব্যাচের ৪ জনকে নিয়ে আসা হয়। তাদের নির্দেশ দেয়া হয় আমার গালে থাপড়ানোর জন্য। এক বন্ধু আমার গায়ে হাত তুলতে অস্বীকৃতি জানালে, তাকেও করা হয় নির্যাতন। এরপর ৪ জন বন্ধু তাদের নির্দেশে আমার গালে থাপড়াতে শুরু করে। মাঝে লাঠি দিয়েও পেটানো হয় আমাকে। প্রায় ২০ থেকে ২৫টি থাপ্পড়ের পর তাদের চলে যেতে বলা হয়। কিন্তু এরপরেও শেষ হয় না নির্যাতন। আমাকে এই অবস্থায় দিতে হয় ২০টি বুক ডাউন। এরপর তারা খেলায় মেতে উঠে আমাকে নিয়ে। একেকজন আমাকে থাপ্পড় দিতে শুরু করে। কে থাপ্পড় দিয়েছে বলতে হবে আমাকে। না বলতে পারলে মারা হয় লাঠি দিয়ে। এভাবে প্রায় ৪ ঘণ্টা নির্যাতন শেষে ছাড়া হয় আমাকে।