বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি সংগৃহীত।

চৈতন্যে দোল তোলা নজরুলের কিছু কবিতা

শিবলী আহমেদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২৫ মে ২০১৭, ২২:১৬
আপডেট: ২৫ মে ২০১৭, ২২:১৬

(প্রিয়.কম) কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় অত্যাচারী ও নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ভাব স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। তেমনি কিছু কবিতা এখানে দেওয়া হলো। কবিতা ও ছবিসমূহ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

বিদ্রোহী কবিতা

বল বীর-

বল উন্নত মম শির!

শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!

বল বীর-

বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'

চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'

ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া

খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!

মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!

বল বীর-

আমি চির-উন্নত শির! আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,

মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!

আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,

আমি দূর্বার,

আমি ভেঙে করি সব চুরমার!

আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,

আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!

আমি মানি না কো কোন আইন,

আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!

আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর

আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!

বল বীর-

চির-উন্নত মম শির! আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,

আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।

আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,

আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।

আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,

আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’

পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’

ফিং দিয়া দেই তিন দোল্‌;

আমি চপোলা-চপোল হিন্দোল।

আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,

করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,

আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!

আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরীত্রির;

আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর।

বল বীর-

আমি চির-উন্নত শির! আমি চির-দূরন্ত দুর্মদ

আমি দূর্দম মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্‌ হ্যায় হর্দম্‌ ভরপুর্‌ মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,

আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।

আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,

আমি অবসান, নিশাবসান। আমি ঈন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য; আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।

আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।

বল বীর-

চির-উন্নত মম শির! আমি সন্ন্যাসী, সুর সৈনিক,

আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।

আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,

আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ।

আমি বজ্র, আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,

আমি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার,

আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশুল, ধর্মরাজের দন্ড,

আমি চক্র-মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!

আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,

আমি দাবানল-দাহ, দহন করিব বিশ্ব।

আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, -আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস

আমি মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!

আমি কভু প্রশান্ত, -কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,

আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!

আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,

আমি উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল,

আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল ঊর্মির হিন্দোল-দোল! আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী, তন্বী নয়নে বহ্নি,

আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি! আমি উন্মন, মন-উদাসীর,

আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।

আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,

আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের

আমি অভিমানী চির ক্ষূব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যাথা সূনিবিড়,

চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর!

আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,

আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তাঁর কাঁকণ-চুড়ির কন্‌-কন্‌।

আমি চির শিশু, চির কিশোর,

আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাচুলি নিচোর!

আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,

আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।

আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি

আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি!

আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!

আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ! আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন,

আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।

ছুটি ঝড়ের মতন করতালী দিয়া

স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,

তাজী বোর্‌রাক্‌ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার

হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে! আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রী, বাড়ব বহ্নি, কালানল,

আমি পাতালে মাতাল, অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!

আমি তড়িতে চড়িয়া, উড়ে চলি জোড় তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,

আমি ত্রাস সঞ্চারি’ ভুবনে সহসা, সঞ্চারি ভূমিকম্প। ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’-

ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’। আমি দেবশিশু, আমি চঞ্চল,

আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!

আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,

মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্‌ঘুম্‌

ঘুম্‌ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্‌ঝুম

মম বাঁশরীর তানে পাশরি’।

আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,

ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!

আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া! আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,

কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস ধন্যা-

আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!

আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,

আমি ধূমকেতু জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!

আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,

আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি! আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,

আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!

আমি মানব দানব দেবতার ভয়,

বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,

জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,

আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!

আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!

আমি সহসা আমারে চিনেছি, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,

নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!

আমি হল বলরাম স্কন্ধে,

আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে। মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত,

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি আমি সেই দিন হব শান্ত!

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,

আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!

আমি চির-বিদ্রোহী বীর -

আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

কামাল পাশা

ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,

অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল-সামাল তাই!

       কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

(হাবিলদার মেজর মার্চ্চের হুকুম করিলঃ-কুইক মার্চ্চ!)

        লেফট্! রাইট্! লেফট্!!

        লেফট্! রাইট্! লেফট্!!

  (সৈন্যগণ গাহিতে গাহিতে মার্চ্চ করিতে লাগিল )

ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,

অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই!

  কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

 হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

  (হাবিলদার মেজরঃ- লেফট্! রাইট্!  )

সাব্বাস্ ভাই! সাব্বাস্ দিই, সাব্বাস্ তোর শমশেরে|

পাঠিয়ে দিলি দুষমনে সব যম-ঘর একদম্-সে রে!

       বল্ দেখি ভাই, বল হাঁ রে,

দুনিয়ায় কে ডর্ করে না তুর্কীর তেজ্ তলোয়ারে?

  (লেফট্! রাইট্! লেফট্!)

       খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া!

বুজদিল ঐ দুশমন্ সব বিলকুল্ সাফ হো গিয়া!

       খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া,

          হুররো হো!

         হুররো হো!

দস্যুগুলোয় সামলাতে যে এমনি দামাল কামাল চাই!

কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

(হাবিলদার মেজরঃ- সাবাস্ সিপাই! লেফট্! রাইট্! লেফট্!)

শির হ'তে পাঁও তক্ ভাই লাল-লালে-লাল খুন মেখে

         রণ-ভীতুদের শান্তি-বাণী শুন্ বে কে?

             পিন্ডারীদের খুন-রঙীন

         নোখ-ভাঙা এই নীল সঙীন

 তৈয়ার হেয়্ হর্দ্দম ভাই ফার্ তে যিগর্ শত্রুদের!

  হিংসুক-দল! জোর তুলেছি শোধ্ তোদের!

       সাবাস্ জোয়ান্! সাবাস্!

 ক্ষীণ-জীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্-

         এমনি ক’রে রে-

         এমনি জোরে রে-

 ক্ষীণ-জীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্!

  ঐ চেয়ে দ্যাখ্ আস্ মানে আজ রক্ত-রবির আভাস!

       সাবাস্ জোয়ান্! সাবাস্!!

        (লেফট্! রাইট্! লেফট্!)

হিংশুটে ঐ জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের,

তাই তারা আজ নেস্ত-নাবুদ, আমরা মোটেই হই  নি জের!

      পরের মুলুক লুট ক’রে খায় ডাকাত তারা ডাকাত!

তাই তাদের তরে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত!

            কি বল ভাই শ্যাঙাত?

              হুররো হো!

              হুররো হো!

দনুজ-দলে দ’লতে দাদা এমনি দামাল কামাল চাই!

       কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

(হাবিলদার মেজর: রাইট্ হুইল্! লেফট্! রাইট্! লেফট্!

          সৈন্যগণ ডানদিকে মোড় ফিরিল|)

আজাদ মানুষ বন্দী ক’রে, অধীন ক’রে স্বাধীন দেশ,

কুল্ মুলুকের কুষ্টি ক’রে জোর দেখালে ক’দিন বেশ,

মোদের হাতে তুর্কী-নাচন নাচলে তাধিন্ তাধিন্ শেষ!

            হুররো হো!

            হুররো হো!

বদ্-নসিবের বরাত খারাব বরাদ্দ তাই ক’রলে কি না আল্লায়,

পিশাচগুলো প’ড়ল এসে পেল্লায় এই পাগলাদেরই পাল্লায়!

      এই পাগলাদেরই পাল্লায়!

        হুররো হো!

        হুররো-

ওদের কল্লা দেখে আল্লা ডরায়, হল্লা শুধু  হল্লা,

.          ওদের হল্লা শুধু হল্লা,

এক মুর্গির জোর গায়ে নেই, ধ’রতে আসেন তুর্কী তাজী,

        মর্দ্দ গাজী মোল্লা!

        হাঃ! হাঃ! হাঃ!

      হেসে নাড়ীই ছেঁড়ে বা!

      হা হা হাঃ! হাঃ! হাঃ!

  (হাবিলদার-মেজরঃ- সাবাস্ সিপাই! লেফট্! রাইট্! লেফট্!

          সাবাস্ সিপাই! ফের বল ভাই|)

 ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,

অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই!

     কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

    হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

(হাবিলদার-মেজরঃ- লেফট্ হুইল! য়্যাজয়ু ওয়্যার্! রাইট্ হুইল!-

         লেফট্! রাইট্! লেফট্!)

(সৈন্যদের আঁখির সামনে অস্ত-রবির আশ্চর্য রঙের খেলা ভাসিয়া উঠিল।)

    দেখচ কি দোস্ত্ অমন ক’রে? হৌ হৌ হৌ!

সত্যি তো ভাই! সন্ধ্যেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বৌ।

   শহীদ সেনার টুকটুকে বৌ লাল-পিরাহাণ- পরা,

  স্বামীর খুনের ছোপ-দেওয়া, তায় ডগ্ ডগে আন্ কোরা!-

 না না না,-কলজে’ যেন টুকরো-ক’রে কাটা

হাজার তরুণ শহীদ বীরের,-শিউরে উঠে গা’টা!

আসমানের ঐ সিং-দরজায় টাঙিয়েছে কোন্ কসাই!

দেখতে পেলে এক্ষুণি গ্যে এই ছোরাটা কলজেতে তার বসাই!

          মুন্ডুটা তার খসাই!

গোস্বাতে আর পাইনে ভেবে কি যে করি দশাই!

(হাবিলদার মেজরঃ- সাবাস্ সিপাই! লেফট্! রাইট্! লেফট!)

[ঢালু পার্ব্বত্য পথ, সৈন্যগণ বুকের পিঠের নিহত ও আহত সৈন্যদের ধরিয়া

সন্তর্পণে নামিল!]

        আহা কচি ভাইরা আমার রে!!

এমন কাঁচা জানগুলো, খান্ খান্ ক’রেছে কোন্ সে চামার রে?

      আহা কচি ভাইগুলো আমার রে!!

[সামনে উপত্যকা! হাবিলদার-মেজর:- লেফট্ ফর্ম্ম্|)

সৈন্য-বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল! হাবিলদার-মেজর:-ফরওয়ার্ড!

       লেফট! রাইট্! লেফট্!]

           আসমানের ঐ আঙরাখা

          খুন-খারাবীর রং-মাখা

          কি খুবসুরৎ বাঃ রে বা!

          জোর বাজা ভাই কাহার্ বা!

        হোক্ না ভাই এ কারবালা ময়দান-

        আমরা যে গাই সাচ্চারই জয় গান!

        হোক্ না এ তোর কারবালা ময়দান!!

               হুররো হো

               হুররো-

[সামনে পার্ব্বত্য পথ-হঠাৎ যেন পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে| হাবিলদার-মেজর

পথ খুঁজতে লাগিল| হুকুম দিয়া গেলঃ-“মার্ক টাইম”! সৈন্যগণ এক স্থানেই

দাঁড়াইয়া পা আছড়াইতে লাগিল-]

              দ্রাম্! দ্রাম! দ্রাম!

             লেফট্! রাইট্!  লেফট্!

             দ্রাম্! দ্রাম্! দ্রাম্!

আসমানে ঐ ভাসমান যে মস্ত দুটো রং-এর তাল,

একটা নিবিড় নীল-সিয়া আর একটা খুবই গভীর লাল,-

     বুঝলে ভাই! ঐ নীল সিয়াটা শত্রুদের!

     দেখ্ তে নারে কারুর ভালো,

তাইতো কালো রক্ত-ধারার বইছে শিরায় স্রোত ওদের |

          হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!

   গৃধু ওরা, লুব্ধ-ওদের লক্ষ্য অসুর বল-

          হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!

          জালিম ওরা অত্যাচারী!

   সার জেনেছে সত্য যাহা হত্যা তারই!

          জালিম ওরা অত্যাচারী!

          সৈনিকের এই গৈরিকে ভাই-

          জোর অপমান ক’রলে ওরাই,

তাই তো ওদের মুখ কালো আজ, খুন যেন নীল জল!-

           ওরা হিংস্র পশুর দল!

           ওরা হিংস্র পশুর দল!!

[হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিয়া ফিরিয়া অর্ডার দিল|ঃ-ফরওয়ার্ড! লেফট্ হুইল-

           সৈন্যগণ আবার চলিতে লাগিল-লেফট্! রাইট! লেফট্!]

      সাচ্চা ছিল সৈন্য যারা শহীদ হ’ল মরে!

      তোদের মতন পিঠ ফেরে নি প্রাণটা হাতে ক’রে,-

            ওরা শহীদ হ’ল ম’রে!

       পিটনি খেয়ে পিঠ যে তোদের টিট্ হ’য়েছে! কেমন!

      পৃষ্টে তোদের বর্শা বেঁধা, বীর সে তোরা এমন!

            মুর্দ্দারা সব যুদ্ধে আসিস্! যা যা!

খুন দেখেছিস্ বীরের? হা দেখ্ টক্ টকে লাল কেমন গরম তাজা!

[বলিয়াই কটিদেশ হইতে ছোরা খুলিয়া হাতের রক্ত লইয়া দেখাইল]

              মুর্দ্দারা সব যা যা!!

            এঁরাই বলেন হবেন রাজা!

            আরে যা যা! উচিত সাজা

          তাই দিয়েছে শক্ত ছেলে কামাল ভাই!

         [হাবিলদার-মেজরঃ- সাবাস সিপাই!]

          এই তো চাই! এই তো চাই!

থাকলে স্বাধীন সবাই আছি, নেই তো নাই, নেই তো নাই!

             এই তো চাই!!

[কতকগুলি লোক অশ্রু পূর্ণ নয়নে এই দৃশ্য দেখিবার জন্য ছুটিয়া আসিতেছিল,

         তাহাদের দেখিয়া সৈন্যগণ আরও উত্তেজিত হইয়া উঠিল!]

              মার দিয়া ভাই মার্ দিয়া!

              দুশমন্ সব হার্ গিয়া!

              কিল্লা ফতে হো গিয়া!

              পরওয়া নেহি, যা’নে দো ভাই যো গিয়া!

                কিল্লা ফতে হো গিয়া!

                হুররো হো!

                হুররো হো!

[হাবিলদার-মেজরঃ-সাবাস্ জোয়ান! লেফট্! রাইট্!]

               জোর্’সে চলো পা মিলিয়ে,

               গা হেলিয়ে,

               এমনি ক’রে হাত দুলিয়ে!

            দাদরা তালে ‘এক দুই তিন’ পা মিলিয়ে

               ঢেউ-এর মতন যাই!

       আজ স্বাধীন এ দেশ! আজাদ মোরা বেহেশ্ তও না চাই!

             আর বেহেশতও না চাই!!

[হাবিলদার-মেজরঃ-সাবাস্ সিপাই!! ফের বল ভাই!]

 ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,

অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই!

       কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

[সৈন্যদল এক নগরের পার্শ্ব দিয়া চলিতে লাগিল| নগর-বাসিনীরা ঝরকা হইতে মুখ বাড়াইয়া

এই মহান দৃশ্য দেখিতেছিল; তাহাদের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত| আজ বধুর মুখের

বোরকা খুলিয়া পড়িয়াছে| ফুল ছড়াইয়া হাত দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা

করিতেছিল| সৈন্যগণ চীত্কার করিয়া উঠিল|]

    ঐ শুনেছিস্? ঝরকাতে সব বলছে ডেকে বৌ-দলে,

      “কে বীর তুমি? কে চলেছ চৌদলে?”

চিনিস্ নে কি? এমন বোকা বোনগুলি সব!-কামাল এ যে কামাল!!

       পাগলী মায়ের দামাল ছেলে! ভাই যে তোদের!

       তা না হ’লে কার হবে আর রৌশন এমন জামাল?

             কামাল এ যে কামাল!

      উড়িয়ে দেবো পুড়িয়ে দেবো ঘর-বাড়ী সব সামাল!

             ঘর-বাড়ী সব সামাল!

      আজ আমাদের খুন ছুটেছে, হোশ ঠুটেছে|

             ডগ্ মগিয়ে জোশ উঠেছে|

             সামনে থেকে পালাও!

      শোহরত দাও নওরাতি আজ! হর্ ঘরে দীপ জ্বালাও!

             সামনে থেকে পালাও!

             যাও ঘরে দীপ জ্বালাও!!

 [হাবিলদার-মেজরঃ-লেফ্ ট ফর্ম্ম! লেফট্ রাইট্! লেফট্!-ফরোয়ার্ড!)

বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল| পার্শ্বেই পরিখার সারি| পরিখা-ভর্তি নিহত সৈন্যের

দল পচিতেছে এবং কতকগুলি অ-সামরিক নগরবাসী তাহা ডিঙ্গাইয়া ডিঙ্গাইয়া চলিতেছে!]

       ইস্! দেখেছিস্! ঐ কা’রা ভাই সামলে চলেন পা,

       ফ’সকে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা!

       ও তাই শিউরে ওঠে গা!

                হাঃ হাঃ হাঃ!

           ম’রলো যে সে ম’রেই গেছে,

           বাঁচলো যারা রইল বেঁচে!

       এই তো জানি সোজা হিসাব! দুঃখ কি আর আঃ?

      মরায় দেখে ডরায় এরা! ভয় কি মরায়? বাঃ!

            হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

[সন্মুখে সঙ্কীর্ণ ভগ্ন সেতু| হাবিলদার মেজর অর্ডার দিলেন-“ফর্ম্ম ইনটু সিঙ্গল লাইন!”

এক একজন করিয়া বুকের পিঠের নিহত ও আহতদের চাপিয়া ধরিয়া অতি সন্তর্পনে

“শ্লো মার্চ্চ” করিয়া পার হইতে লাগিল|]

              সত্যি কিন্তু ভাই!

যখন মোদের বক্ষে বাঁধা ভাইগুলির এই মুখের পানে চাই-

       কেমন সে এক ব্যথায় তখন প্রাণটা কাঁদে যে সে!

       কে যেন দুই বজ্র-হাতে চেপে ধরে কলজেখানা পেষে!

নিজের হাজার ঘায়েল জখম ভুলে’ তখন ডুকরে কেন কেঁদেও ফেলি শেষে!

             কে যেন ভাই কলজেখানা পেষে!!

         ঘুমোও পিঠে, ঘুমোও বুকে, ভাইটি আমার, আহা!!

       বুকে যে ভরে হাহাকারে যতই তোরে সাব্বাস দিই,

                 যতই বলি বাহা!

            লক্ষীমণি ভাইটি আমার, আহা!!

        ঘুমোও ঘুমোও মরণ-পারের ভাইটি আমার, আহা!!

    অস্ত-পারের দেশ পারায়ে বহুৎ সে দূর তোদের ঘরের রাহা,

      ঘুমোও এখন ঘুমোও ঘুমোও ভাইটি ছোট আহা!

       মরণ-বধূর লাল রাঙা বর! ঘুমো!

       আহা, এমন চাঁদমুখে তোর কেউ দিল না চুমো!

                  হতভাগা রে!

         ম’রেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগারে!

       না জানি কোন্ ফুটতে-চাওয়া মানুষ-কুঁড়ির হিয়ায়!

তরুণ জীবন এমনি গেল, একটি রাতও পেলিনে রে বুকে কোনো প্রিয়ায়!

               তরুন খুনের তরুন শহীদ! হতভাগা রে!

               ম’রেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে!

তাই যত আজ লিখনে-ওয়ালা তোদের মরণ, ফূর্ত্তি-সে জোর লেখে

      এক লাইনে দশ হাজারের মৃত্যু কথা! হাসি রকম দেখে!

      ম’রলে কুকুর ওদের, ওরা শহীদ-গাথার বই লেখে!

                       খবর বেরোয় দৈনিকে,

    আর একটি কথায় দুঃখ জানান, “জোর ম’রেছে দশটা হাজার সৈনিকে!”

       আঁখির পাতা ভিজলো কি না কোনো কালো চোখের,

    জানলো না হায় এ-জীবনে ঐ সে তরুণ দশটি হাজার লোকের!

    প’চে মরিস্ পরিখাতে, মা-বোনেরাও শুনে বলে ‘বাহা’!

   সৈনিকেরই সত্যিকারের ব্যথায় ব্যথী কেউ কি রে নেই? আহা!-

       আয় ভাই তোর বৌ এলো ঐ সন্ধ্যা মেয়ে রক্ত চেলী পরে,

    আঁধার-শাড়ী প’রবে এখন প’শরে যে তোর গোরের বাসর-ঘরে!-

        ভাবতে নারি, গোরের মাটি ক’রবে মাটি এ মুখ কেমন ক’রে-

               সোনা মানিক ভাইটি আমার ওরে!

          বিদায়-বেলায় আরেকটিবার দিয়ে যা ভাই চুমো!

         অনাদরের ভাইটি আমার! মাটীর মায়ের কোলে এবার ঘুমো!!

[নিহত সৈন্যদের নামাইয়া রাখিয়া দিয়া সেতু পার হইয়া আবার জোর মার্চ্চ করিতে করিতে

তাহাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিল|]

                  ঠিক ব’লেছ দোস্ত তুমি!

                চোস্ত কথা! আয় দেখি তোর হস্ত চুমি!

              মৃত্যু এরা জয় ক’রেছে কান্না কিসের?

       আব্-জম্-জম্ আনলে এরা, আপনি পিয়ে কলসী বিষের!

              কে ম’রেছে? কান্না কিসের?

                   বেশ ক’রেছে!!

              দেশ বাঁচাতে আপনারি জান শেষ ক’রেছে!!

                                বেশ করেছে!!

                               শহীদ ওরাই শহীদ!

               বীরের মতন প্রাণ দিয়েছে খুন ওদেরি লোহিত!

                                শহীদ ওরাই শহীদ!!

[এইবার তাহাদের তাম্বু দেখা গেল| মহাবীর আনোয়ার পাশা বহু সৈন্য সামন্ত ও সৈনিকের

আত্মীয়-স্বজন লইয়া বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন দেখিয়া সৈন্যগণ আনন্দে

আত্মহারা হইয়া “ডবল মার্চ্চ” করিতে লাগিল|]

                  হুররো হো!

                 হুররো হো!!

     ভাই-বেরাদর পালাও এখন! দূর্ রহো! দূর রহো!!

               হুররো হো! হুররো হো!

      [কামাল পাশাকে কোলে লইয়া নাচিতে লাগিল|]

          হৌ হৌ হৌ! কামাল জিতা রও!

            কামাল জিতা রও!

         ও কে আসে? আনোয়ার ভাই?-

        আনোয়ার ভাই! জানোয়ার সব সাফ্!!

       জোর নাচো ভাই! হর্দ্দম্ দাও লাফ্!

           আজ জানোয়ার সব সাফ্!

         হুররো হো! হুররো হো!!

সবকুছ্ আব্ দূর্ রহো!-হুররো হো! হুররো হো!!

রণ জিতে জোর মন মেতেছে! সালাম সবায় সালাম!-

              নাচনা থামা রে!

জখমী ঘায়েল ভাইকে আগে আস্তে নামা রে!

              নাচ্ না থামা রে!

           [আহতদের নামাইতে নামাইতে]

          কে ভাই? হাঁ, হাঁ, সালাম!

-ঐ শোন্ শোন্ সিপাহ্-সালার কামাল-ভাই-এর কালাম!

           [সেনাপতির অর্ডার আসিল]

            “সাবাস্! থামো! হো হো!

           সাবাস্! হল্ট্! এক! দো!!”

[এক নিমেষে সমস্ত কলরোল নিস্তব্ধ হইয়া গেল! তখনো কিন্তু তারায় তারায় যেন ঐ বিজয়-

গীতির হারা-সুর বাজিয়া বাজিয়া ক্রমে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণ তর হইয়া মিলিয়া গেল।]

ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই!

অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল সামাল তাই!

           কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

   হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

 

কাজী নজরুল ইসলাম।

কারার ঐ লৌহ-কপাট

কারার ঐ লৌহকপাট,

ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,

                   রক্ত-জমাট

শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।

ওরে ও তরুণ ঈশান!

বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!

ধ্বংস নিশান

উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।

গাজনের বাজনা বাজা!

কে মালিক? কে সে রাজা?

কে দেয় সাজা

মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?

হা হা হা পায় যে হাসি,

ভগবান পরবে ফাঁসি!

সর্বনাশী

শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!

ওরে ও পাগলা ভোলা!

দে রে দে প্রলয় দোলা

গারদগুলা

জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে!

মার হাঁক হায়দারী হাঁক,

কাধে নে দুন্দুভি ঢাক

ডাক ওরে ডাক,

মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!

নাচে ওই কালবোশাখী,

কাটাবী কাল বসে কি?

দে রে দেখি

ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!

লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!

যত সব বন্দী শালায়-

আগুন-জ্বালা,

ফেল উপাড়ি।।

কাজী নজরুল ইসলাম।

এই শিকল পরা ছল

এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।

এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।।

তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়,

ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন-ভয়।

এই বাঁধন প’রেই বাঁধন-ভয়কে করবো মোরা জয়,

এই শিকল-বাঁধা পা নয় এ শিকল ভাঙা কল।।

তোমার বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে কর্‌ছ বিশ্ব গ্রাস,

আর ভয় দেখিয়েই ক’র্‌বে ভাবছো বিধির শক্তি হ্রাস

সেই ভয়-দেখানী ভূতের মোরা ক’র্‌বো সর্বনাশ,

এবার আন্‌বো মাভৈঃ বিজয়-মন্ত্র বল-হীনের বল।।

তোমরা ভয় দেখিয়ে কর্‌ছ শাসন জয় দেখিয়ে নয়;

সেই ভয়ের টুটি ধর্‌ব টিপে কর্‌ব তারে লয়।

মোরা আপনি ম’রে মরার দেশে আন্‌ব বরাভয়,

প’রে ফাঁসি আন্‌ব হাসি মৃত্যু-জয়ের ফল।।

ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল-ঝঞ্ঝনা,

এ যে মুক্তি-পথের অগ্রদূতের চরণ-বন্দনা!

এই লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে হান্‌ছে লাঞ্ছনা,

মোদের অশ্রু দিয়েই জ্ব’লবে দেশে আবার বজ্রানল।।

কাজী নজরুল ইসলাম।

মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম

মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম

মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল,

মোরা বিধাতার মত নির্ভয়

মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।।

মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন

মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,

বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন

চিত্তমুক্ত শতদল।।

মোরা সিন্ধু জোঁয়ার কলকল

মোরা পাগলা জোঁয়ার ঝরঝর।

কল-কল-কল, ছল-ছল-ছল।।

দিল খোলা খোলা প্রান্তর,

মোরা শক্তি অটল মহীধর।

হাসি গান শ্যাম উচ্ছল

বৃষ্টির জল বনফল খাই-

শয্যা শ্যামল বনতল।।

মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম

মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল,

মোরা বিধাতার মত নির্ভয়

মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।।

কাজী নজরুল ইসলাম।

কাণ্ডারী হুশিয়ার!

দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,

ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?

কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।

এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!

যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান!

ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,

ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,

কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!

“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!

গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,

পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ

কান্ডারী! তুমি ভূলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?

‘করে হানাহানি, তবু চল টানি’, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,

বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!

ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর

উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,

আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?

আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?

দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!

প্রিয় সাহিত্য/ফারজানা রিংকী