
ছবি সংগৃহীত
প্রবাস জীবনে ফেসবুকই আমার জলসাঘর: রীতা রায় মিঠু
আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৭, ১০:০১
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রীতা রায় মিঠু। ছবি: সংগৃহীত।
(প্রিয়.কম) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপিতে ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারের ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে অ্যাসোসিয়েট হিসেবে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে চাকরি করছেন রীতা রায় মিঠু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। ফেসবুকে বাংলায় লেখা তাঁর নাতিদীর্ঘ স্ট্যাটাস পড়তে অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এসব স্ট্যাটাস তাঁকে জনপ্রিয়তার এমন মাত্রায় নিয়ে গেছে যে তিনি স্ট্যাটাস দিয়ে বই লিখে ফেলেছেন। ২০১৪ সালের বই মেলায় তাঁর লেখা 'ঠাকুরবাড়ীর আঁতুড়ঘরে' পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর লেখালেখির বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক একটি লেখা দিয়ে তাঁর লেখালেখি শুরু। এরপর লেখালেখিতে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৬৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন রীতা রায় মিঠু। বাবা সুনীল কুমার দাস ও মা স্বর্গীয়া শংকরী দাসের তিন ছেলে এবং এক মেয়ে। বড় ভাই কানাডা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার। মেজো ভাই বাংলাদেশ সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার পদে কর্মরত এবং ছোট ভাই সরকারি কলেজের অধ্যাপক। মিঠুর স্বামী ড. জীবেন রায় আমেরিকার মিসিসিপি ইউনিভারসিটির অধ্যাপক। তাঁদের তিন কন্যা। বড় মৌটুসী, সাইকিয়াট্রিস্ট, ডালাস আমেরিকা। মেজো মিশা, মাস্টার্স ইন পাবলিক হেলথ, মেডিক্যাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত, আটলান্টা, আমেরিকা। ছোট মিথীলা দ্বাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়ণরত।
তিনি পড়াশোনা করেছেন নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষাগত যোগ্যতায় আরও রয়েছে কেমিস্ট্রি অনার্স অ্যান্ড মাস্টার্স, বিএড। বাংলাদেশে থাকতে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এখন তিনি ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
তাঁর ব্যস্ততা কী নিয়ে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি জীবনে কোন কিছু নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম না, লেখাপড়া নিয়েও ব্যস্ত ছিলাম না, সংসার নিয়েও না। একত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে আঠারো বছর সংসারের মাঝেই ঘুরেছি, হেসেছি কেঁদেছি খেলেছি। এরই ফাঁকে তিন কন্যার জন্ম হয়েছে, তিন কন্যাকে লালন পালন করেছি, স্কুল কলেজ পাঠিয়েছি। কিন্তু কখনওই ব্যস্ত হইনি। কাজের ফাঁকে অবসরে গল্পের বই পড়েছি, পত্রিকা পড়েছি, ম্যাগাজিন পড়েছি। এসবের মাঝেই অসুস্থ কন্যাদের সেবা শুশ্রুষা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছি। কিন্তু বিশেষ কিছু নিয়ে ব্যস্ত হইনি। এগারো বছরের বেশি সময় ধরে ওয়ালমার্টে চাকরি করছি, চাকরি নিয়েও ব্যস্ততা নেই আমার। তবে এখন মনে হচ্ছে, আমি ফেসবুকে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসি। হ্যাঁ, ফেসবুকেই আমি ব্যস্ত সময় কাটাই, নাওয়া খাওয়া ঘুম ভুলে যাই। প্রতিদিন বিশাল বড় স্ট্যাটাস লিখতেই হয় আমাকে, নাহলে শান্তি পাইনা। প্রবাসের নিস্তরঙ্গ জীবনে ফেসবুকই আমার জলসাঘর। আমি সঙ্গীত ভালোবাসি, সাহিত্য ভালোবাসি, নৃত্যকলা, চিত্রকলা ভালোবাসি। এসবই পাই ফেসবুকের এই জলসাঘরে। দিনের আট ঘন্টা চাকরিতে কাটাই, দুই ঘন্টা রান্নাঘরে, পাঁচ ঘণ্টা ঘুম বাকী নয় ঘণ্টা ফেসবুকে!'
তিন কন্যা সন্তানের সাথে মা রীতা রায় মিঠু।
জীবনে কি কোন অপ্রাপ্তি আছে? উত্তরে রীতা রায় মিঠু বলেন, 'জীবনে তেমন কিছু চাইবার সুযোগ পাইনি। ফলে অপ্রাপ্তির হিসেব কষে দেখিনি। ভাগ্যগুণে যা হাতে পেয়েছি, তাই পরম পাওয়া বলে গ্রহণ করেছি। আমার জন্ম হয়েছিল সদ্বংশীয় সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা সাধারণ চাকরি করতেন, মা করতেন শিক্ষকতা। সংসারে কখনওই প্রাচুর্য ছিল না কিন্তু স্বস্তি এবং শান্তি ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোট ছিলাম, তখন সময়টা কারো নিয়ন্ত্রণে ছিল না। চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারগুলোও বুঝতাম না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চারজন ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবা মা শূন্য থেকে জীবন শুরু করলেন। পরবর্তী দশ বারো বছর আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব দূর্বল ছিল, বিশেষ কিছু চাওয়া-পাওয়ার কথা মনেই আসেনি। মাপা পয়সার সংসারে পরিবারের প্রত্যেককে বুঝদার হতে হয়, আমরা সকলেই ছোটবেলা থেকেই বুঝদার ছিলাম। বাবা মায়ের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতাটুকু হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলাম।'
ছোট বেলার গল্প ব্লতে গিয়ে তিনি বলেন, 'তবুও মনের কোথাও কিছু একটা ব্যথা ছিল। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল আমার প্রচণ্ড ঝোঁক। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আমার বয়স কতইবা ছিল, ৫/৬ বছর। রাস্তা দিয়ে সিনেমার ক্যানভাসার যেতো, মাইকে বাজতো গান। সেই ছোট্ট আমি কান পেতে গানগুলো শুনতাম। এরপর আপন মনেই গানগুলো গাইতাম। কিশোরীবেলায় পাশের বাড়িতে সমবয়সী দুটি মেয়ে গান শিখতো। আমার খুব ইচ্ছে করতো যদি বাবা আমাকেও একটা হারমোনিয়াম কিনে দিতেন, তাহলে বড় হয়ে লতা মুঙ্গেশকারের মত গান গাইতে পারতাম। কিন্তু মনে মনে জানতাম, তা হবার নয়। বাবা চাইতেন, আমরা লেখাপড়ায় মন দেই, যেনো সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করতে পারি। সকলেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি। বাবা মায়ের কষ্টে গড়া সংসারে মনের অন্য কোন চাওয়াকে প্রশ্রয় দেইনি। কিন্তু গান শেখার চাওয়াটাকে অস্বীকারও করতে পারিনি। মায়ের একটা খুব ভাল রেডিও ছিল। রেডিওতে গান শুনতাম, শুনে শুনে গান শিখতাম, নিজের মনেই গান গাইতাম। আজও সারাক্ষণ গানের মধ্যে ডুবে থাকি। মধ্যবয়সে কত কারণে মন খারাপ হয়, মন খারাপ হলেই গানের মধ্যে ডুব দেই, ভুলে যাই সকল না পাওয়ার ব্যথাগুলো। টিভি দেখার নেশা নেই, তবে গানের অনুষ্ঠানগুলো দেখি, বিশেষ করে দুই বাংলার রিয়েলিটি শো। ছেলেমেয়েরা গান গায়, আমার হৃদয়ে তালাবন্ধ কুঠুরীতে কিশোরী মিঠু জেগে উঠে, সেও স্টেজে যায়, গান গায়, বিচারক এবং শ্রোতাদের প্রশংসায় স্নাত হয়।'
রীতা রায় মিঠু জীবনে কি হতে চেয়েছিল? উত্তরে বলেন, 'প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি লক্ষ্য থাকে, আমার কোন লক্ষ্য ছিল না। বাবা লেখাপড়া করতে বলতেন, আমি লেখাপড়া করেছি। লেখাপড়া করার সময় একবারও ভাবিনি, বড় হয়ে আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবো নাকি কবি সাহিত্যিক হবো। সময় আমাকে যখন যেভাবে টেনে নিয়ে গেছে, সময়ের স্রোতে আমি ভেসে গিয়েছি। কেমিস্ট্রিতে অনার্স মাস্টার্স করেছি, বিএড করেছি কিন্তু শ্রুতিনন্দন কোন পেশা বেছে নিতে পারিনি। আমার বাবা মনে দুঃখ পেয়েছেন, বাবা সবসময় বলতেন, চার সন্তানের মধ্যে আমি নাকি সবচেয়ে মেধাবী এবং সবচেয়ে বেয়াড়া। নিজের ইচ্ছেমত চলেছি। আমার তিন ভাই বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছে, আমি বাবাকে স্বপ্ন দেখাইওনি, স্বপ্ন পূরণও করিনি। সময়ের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছি, সময়ের স্রোতে ওয়ালমার্টে চাকরি নিয়েছি, এখনও সময়ের সাথেই এগোচ্ছি।'
তবে তিনি মনে মনে যা হতে চেয়েছিলেন তা তাঁদের পরিবারে থেকে হওয়া সম্ভব ছিল না। এ ব্যাপারে মিঠু বলেন, 'আমি হতে চেয়েছিলাম অনেক বড় সঙ্গীতশিল্পী, সমাজে কোন না কোনভাবে বিখ্যাত কেউ। সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল না। মাঝে মাঝে টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা দেখার সুযোগ হতো। কখনও নিজেকে কবরী ভাবতাম, কখনও শাবানা। বড় হয়ে নিজেকে সুচিত্রা সেন ছাড়া আর কিছুই ভাবতাম না। বিখ্যাত হওয়ার লোভ ছিল। বুঝতে পারতাম, শিল্পীসত্তা আমার রক্তে মিশে আছে, সুযোগ পেলে ভালো গায়িকা হতাম, ভালো অভিনেত্রী হতে পারতাম। যখন অস্ট্রেলিয়া ছিলাম, মঞ্চে নকশি কাঁথার মাঠ গীতি নাট্যে দুখাই ঘটকের রোল প্লে করেছিলাম। ছোট রোল, পুরো অডিটোরিয়াম মুহূর্মুহু করতালি দিয়েছিল। অথবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ‘যেমন খুশী সাজো’ খেলায় দুই বাচ্চা কোলে ভিখিরি মা, সারা মাঠ মনে রেখেছে আমার সেদিনের তাৎক্ষণিক অভিনয়। এখনও ভাবি, কোন নাট্যকার বা চলচিত্র নির্মাতা যদি আমাকে চ্যালেনজিং কোন চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দিতেন!'
লেখালেখি জীবনের গল্প বলতে গিয়ে রীতা রায় মিঠু বলেন, 'মায়ের ছিল গল্পের বই পড়ার নেশা। গরীবের সংসারে টিভি, ফ্রিজ না থাকলেও বুকশেলফ ভর্তি বই ছিল। মা পড়তো, মেজদা পড়তো। দুই একটা বই আমিও পড়তাম। নতুন বই আর কেনা হতো না, বড় হয়ে নিজের সংসার হলো। সেই সংসারেও মায়ের মত আঙ্গুলের কড় গুণেছি, আর হিসেবের সংসার চালিয়েছি। অন্যের বাড়িতে গল্পের বই দেখলে চেয়ে এনেছি, বই পড়ে ফেরত দিয়েছি। গল্পের বই পড়তাম আর ভাবতাম, যাঁরা এত সুন্দর বই লিখেন, তারা কি আমার মত সাধারণ কেউ? কেমন করে লিখেন তাঁরা? শুরুটা করেন কিভাবে? আমার স্বামী ছাত্রাবস্থায় বাংলায় জৈব রসায়ন বই লিখেছিলেন। প্রায় চৌদ্দ বছর পর বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ হয়েছিল। তখন আমি তার জীবনসঙ্গী। দ্বিতীয় সংস্করণে কৃতজ্ঞতায় তিনি আমার নাম লিখেছিলেন। জৈব রসায়ন বইয়ে লেখকের কৃতজ্ঞতা নোটে আমার নাম দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম। তখন কল্পনার ধারে কাছেও আসেনি যে ছবি, একদিন তিনখানা বইয়ের কভারে লেখক হিসেবে আমার নাম ছাপা হবে।'
রীতা রায় মিঠুর স্বামী ড. জীবেন রায়। তবে তাঁকে তিনি ‘উত্তম কুমার’ নামে ডাকতে বেশি পছন্দ করেন।
পত্রিকা ও ব্লগে লেখালেখি প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ছয় বছর আগে ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছিলাম। প্রতিদিন এক দুটো করে স্ট্যাটাস লিখতাম। খোঁজ পেলাম প্রিয়.কম নামের ওয়েবসাইটের। খুঁজে পেলাম প্রিয়.কমের কর্ণধার জাকারিয়া স্বপন ভাইকে। আমি অনলাইন জগতে একেবারেই কাঁচা, কিছুই জানি না। স্বপন ভাই নিজে প্রিয় ব্লগে আমার একাউন্ট খুলে দিলেন, প্রিয় ব্লগে লিখতে শুরু করলাম। স্বপন ভাই আমার প্রতি ভীষণ সহানুভূতিশীল ছিলেন, ব্লগে যাই লিখতাম, কোন স্ক্রিনিং ছাড়াই সরাসরি পোস্ট হতো। এরপর বিডিনিউজ২৪ ব্লগ, আমার ব্লগ, জলছবি বাতায়নে লিখতে শুরু করি। একই সময়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক বিখ্যাত কলামিস্ট পীর হাবীবুর রহমান সাহেব ওই পত্রিকায় আমাকে কলাম লেখার সুযোগ করে দিলেন। লেখালেখিতে আমার নেশা ধরে গেলো। স্বামীর বইয়ের কৃতজ্ঞতায় আমার নাম দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম, সেই আমার লেখা এখন পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, ব্লগে ছাপা হচ্ছে, পাঠক সমালোচনা করছে! এটাইতো চেয়েছিলাম। কোন না কোনভাবে বিখ্যাত হতে চেয়েছিলাম, বিখ্যাত নাই বা হলাম, কিছু মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠবার সিঁড়ি তো পেলাম!'
তিনি বলেন, '২০১২ সালে পত্রিকা, ব্লগে লেখালেখি শুরু। দেড় বছরের মাথায় ২০১৪ সালের একুশে বইমেলায় সিঁড়ি প্রকাশন থেকে আমার লেখা প্রথম বই ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরে প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে একই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় বই ‘মুহূর্তে দেখা মানুষ’। উল্লেখ করার মত ঘটনা হলো, যেখানে দুই একজন বিখ্যাত লেখক ছাড়া বাকী সব লেখকের বই গাঁটের টাকা খরচ করে ছাপাতে হয়, সেখানে আমার প্রথম বই এবং দ্বিতীয় বই সিঁড়ি প্রকাশন নিজেদের খরচে ছাপিয়েছে। এ যে আমার কত বড় পাওয়া, এই নিস্তরঙ্গ জীবনে, অসফল জীবনে, কিছুই হতে না পারা জীবনে, উদ্দেশ্যহীন জীবনে এ যে কত বড় পাওয়া, আমি ঠিক বলে বুঝাতে পারবো না। মানুষ ঈশ্বর খুঁজে বেড়ায়, আর ঈশ্বর স্বয়ং প্রকাশক হাশিম মিলনের রূপ ধরে আমায় দেখা দেন।'
প্রথম বই নিয়ে প্রিয়.কম তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'প্রথম বই ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরে যখন প্রকাশিত হলো, প্রিয়.কমের মিজানুর রহমান সোহেল আমার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে প্রিয়.কমের হোম পেজে ছাপিয়ে দিল। সেই সাক্ষাৎকারের ছাপানো অংশ দেখে অদ্ভুত এক ভালো লাগায় আমি গলে গেছিলাম। দুচোখ গড়িয়ে জল পড়ছিল, সোহেলকে কাছে পেলে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম। বাবা মায়ের অকেজো সন্তান আমি, যখন কিছুটা কেজো হলাম, মা’কে তা দেখানোর সুযোগ পেলামনা। দেড় বছর আগেই মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন! মা থাকলে দেখাতাম, মায়ের গরীবী বুকশেলফ ভর্তি বই কখন অগোচরে আমার চোখে লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল।'
নিজের প্রকাশিত বই ও বইমেলা সম্পর্কে তিনি বলেন, '২০১৪ সালে বইমেলায় গেছিলাম, হিসেবের সংসারে প্রতিবছর দেশে যাওয়া সম্ভব হয় না। ২০১৫ সালে যেতে পারিনি তবে ২০১৬ সালে বইমেলায় গিয়েছিলাম। ২০১৬ সালে বইমেলায় নন্দিতা প্রকাশ বের করলো আমার লেখা ১২টি গল্প দিয়ে সাজানো ‘তুমি বন্ধু তুমি সখা’। গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল, নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল কিন্তু কোনটাই হয়ে উঠেনি। যা কখনও স্বপ্নেও দেখিনি, দুঃস্বপ্নেও দেখিনি, মধ্যবয়সে পৌঁছে নিজেকে সেই স্থানে আবিষ্কার করেছি। এতদিনে লেখালেখিতে মনোযোগ দিতে শুরু করেছি, মধ্যবয়সে পৌঁছে নিজেকে আবিষ্কার করেছি, গায়িকা-নায়িকা হতে না পারলেও লেখিকা হওয়ার সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছি।' এবারের বইমেলাতে সিঁড়ি প্রকাশন তাঁর চতুর্থ বই ‘সাগর ডাকে আয়’ প্রকাশ করছে বলে তিনি জানান।
প্রকাশক সম্পর্কে বলতে গিয়ে মিঠু বলেন, 'সিঁড়ির প্রকাশক হাশিম মিলন বয়সে ছোট হলেও আমার প্রতি বড় ভাই সুলভ আচরণ করে। ভীষণ প্রশ্রয় দেয় আমাকে। ছোট বোনের মত মমতা করে। প্রবাসে জীবন ভীষণ কঠিন, ব্যাপারটা আর কেউ বুঝুক আর নাই বুঝুক মিলন বুঝে। আট ঘণ্টা ওয়ালমার্টে চাকরি করে, ঘর সংসার সামাল দিয়ে মাত্র ১৫ দিনে ৩০০ পৃষ্ঠার বই লেখা, কম্পিউটারে টাইপ করা লেখা মেইল করার আগ মুহূর্তে কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যাওয়া, পেন ড্রাইভে সেভ করা, লেখা ল্যাপটপে ট্র্যান্সফার করার পর প্রকাশককে মেইল করার দুঃসাধ্য কাজটুকু সম্পন্ন করা। তবে অন্য প্রকাশক হলে আমার চতুর্থ বই প্রকাশ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। লেখককে যতখানি স্বাধীনতা দিলে লেখক আপাতত অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে, মিলন তার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা আমাকে দিয়েছিল।'
২০১৭ সালের বইমেলায় ‘সাগর ডাকে আয়’ বইটি নিয়ে তিনি খুব আশাবাদী বলে জানান। তবে এবারের বইমেলায় তাঁর বাংলাদেশে আসা হচ্ছে না। তবে সন্তানতুল্য বই আর বাংলাদেশ বিষয়ে বলেন, 'কঠিন বাস্তবতার কাঠগড়ায় আমাদের জীবন। ফলে ২০১৭ বইমেলায় উপস্থিত থাকতে চাইলেও তা হবে না। আমি উপস্থিত না থাকলেও আমার লেখা ‘সাগর ডাকে আয়’ থাকবে সিঁড়ি প্রকাশনের স্টলে। আমার খুব সাধ হয়, আমার লেখা বইগুলো পাঠকের বুকশেলফে শোভা পাক, মনটা সারাক্ষণ বাংলাদেশেই ঘুরে বেড়ায়। বইটা যদি পাঠকের হাতে থাকে, বইয়ের পাতার ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে পারবো আমার প্রিয় বাংলাদেশকে।'
সর্বশেষ প্রকাশিত তাঁর ‘সাগর ডাকে আয়’ বই লেখার গল্প শুরু এখান থেকেই!
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে এসে তিনি সমুদ্রপ্রেম আর নতুন বই লেখার পেছনের গল্প বলেছেন। তিনি বলেন, 'তরুণীবেলায় আমার খুব ইচ্ছে করতো জাহাজে চড়ে সমুদ্র যাত্রা করি। সৈকত থেকে সমুদ্র যতখানি দেখা যায়, তাতে আমার মন ভরতো না। ইচ্ছে করতো সমুদ্রের মাঝখানে চলে যাই, শুনেছি মাঝ সমুদ্র থেকে চারদিকে তাকালে জল ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। আমি খুব রোমান্টিক ছিলাম, শুধু মাঝ সমুদ্র নয়, ইচ্ছে করতো রাতের বেলা জাহাজের ডেকে শুয়ে আকাশের তারা গুনি, পাশে থাকবে আমার প্রিয় পুরুষ। অথবা প্রিয় পুরুষের কাঁধে হেলান দিয়ে সূর্যোদয় দেখি, অথবা সূর্যাস্ত! স্বামীর সাথে জাহাজে চড়ে ভারতের গোয়া বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তরুণীবেলার সেই স্বপ্ন সংসার নামক কঠিন বাস্তবতার আড়ালে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত দেড় বছর আগে সমুদ্র যাত্রা করেছি। জাহাজে চড়েই সমুদ্রে বেড়িয়েছি, স্বামীর সাথেই গিয়েছি। তবে কথায় বলে সময় পেরিয়ে হয়না সাধন! সমুদ্র যাত্রা নিয়ে তরুণীবেলায় যে উচ্ছ্বাস ছিল, মধ্যবয়সে পৌঁছে সেই উচ্ছ্বাস ছিল কি? তাই নিয়েই ‘সাগর ডাকে আয়’ নামক বইটি লেখা।'
আরও পড়ুন -
>> ‘ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরে’ নিয়ে রীতা রায় মিঠুর বিশেষ সাক্ষাৎকার
সম্পাদনা: গোরা