
ছবি সংগৃহীত
প্রিয় ভ্রমণ গল্প: পানামনগর: দ্য লস্ট সিটি
আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:০৭
দূর থেকে অজানা আকর্ষণে টানবে পানাম। ছবি: জোহরা মিলা।
(প্রিয়.কম) হঠাৎ-ই আবার সেই পুরনো নেশায় পেয়ে বসল আমায়, উত্তাল হয়ে উঠল ভেতরটা, রক্তে ভিন্ন উত্তেজনা। দেশের হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন শহর ঐতিহ্যবাহী, ঐতিহাসিক পানাম নগরে হঠাৎই এসে হাজির হলাম কোন পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সামনে থেকে উৎসব বাসে আড়াই ঘন্টার নিরাপদ জার্নি শেষে নির্বিঘ্নে মোগড়াপাড়ায় পৌঁছে গেলাম। এখান থেকেই চারটি রিক্সায় পানামের পথে আমরা আট জন। মোগড়াপাড়া থেকে পানামের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার।
পর্যটকের আনাগোনায় পানামের পথ। ছবি: জোহরা মিলা।
রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে সিদ্ধান্ত হলো এখনই ঢুকছি না পানামে। কাছে এসে দর্শণের তৃষ্ণা চরমে পৌঁছাক আর ততক্ষণে মিটে যাক বাজারের এক দোকানীর হাঁক ‘গরুর খাঁটি দুধের চা’য়ের তৃষ্ণা। চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে অজান্তে তাকিয়ে আছি বিশালাকার আম গাছ ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাড়ানো পানামের এক দালানের ছাদে। যেন ‘নীহারিকা’র ছাদে হেঁটে বেড়াচ্ছে স্বয়ং ঈশা খাঁ।
মাথা উচুঁ করে রাখা ভবনগুলো অদম্য কৌতুহল জাগাবে। ছবি: জোহরা মিলা।
টিকিট কেটে হুড়মুড়িয়ে পানামে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটি সরু রাস্তার ধারে সারি সারি পুরনো দালান। ঢোকার পথেই বই আকৃতির ফলকে দেখেছি ৫ মিটার প্রশস্থ ও ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দুই পাশে পানামে টিকে থাকা বাড়ি মোট ৫২টি যার মধ্যে সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি। বাড়িগুলোর বেশিরভাগই দোতলা, তবে একতলা বা তিনতলা বাড়িও রয়েছে কয়েকটা। বাড়িগুলোর স্থাপত্যরীতির দিকে তাকালে কাউকেই বলে বোঝাতে হবে না যে প্রায় সাড়ে চারশত বছর আগে কোন শ্রেণীর মানুষ বাস করতেন এ নগরীতে। রাজাদের আমির-ওমরাহদের জন্য পানাম নগর ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে গড়ে উঠেছিল নিপুণ কারুকাজখচিত পাকা ইমারত। পানাম ও এর আশপাশ ঘিরে পঞ্চদশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এক সমৃদ্ধ জনজীবন ছিল।
কারুকার্য মুগ্ধ করবে আপনাকে। ছবি: জোহরা মিলা।
মোগল ও গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে প্রতিটি বাড়ির কারুকাজ স্বতন্ত্র। তাছাড়া প্রত্যেকটি বাড়ির রঙের ব্যবহার ও নির্মাণকৌশল ভিন্নতা এনে দিয়েছে পানামকে। বইপত্র বা ইন্টারনেটের কল্যাণে অর্জিত স্বল্প জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে বিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিকদের মত আমরাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি পানামকে। সরু রাস্তার দুই পাশে আবাসিক ভবন ছাড়াও মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, পুকুর, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, বিচারালয় ও পুরনো জাদুঘর, সরাইখানা, ঠাকুর ঘর, কূপ, খাজাঞ্চিখানা, টাঁকশাল, প্রশস্ত দেয়াল, প্রমোদালয়, ইংরেজদের নীল কুঠি, শের শাহের আমলে নির্মিত সোনারগাঁ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মাইল দীর্ঘ ঐতিহাসিক গ্র্যান্ডট্যাংক রোডের নির্দশন ইত্যাদি জানান দেয় এ নগরের প্রাচীন সমৃদ্ধির কথা। এসব আমাদের মুগ্ধতার সীমায় যোগ করে আরও অজানা পাওয়া।
ধুঁকছে পানামের ভবন। ছবি: জোহরা মিলা।
পানামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঙ্খীরাজ খাল। এ খাল পানামের গুরুত্বপূর্ন ভবনগুলো ছুঁয়ে পূর্বদিকে মেনিখালি নদ হয়ে মেঘনা নদীতে মিশেছে। নগরীর পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, ‘পানাম নগরে একসময় ঈসা খাঁর যাতায়াত ছিল। ১৫ শতকে তিনি সোনারগাঁওয়ে বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। সেই সময়ে অর্থাৎ সুলতানি আমলে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যার নদীপথে বিলেত থেকে আসত বিলাতি থান কাপড়, সোনারগাঁও তথা পানামনগর থেকে যেত মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড় করত বড় বড় পালতোলা নৌকা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে পানাম নগরী। ইংরেজরা এখানে নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র খুলে বসে। সেই সঙ্গে মসলিনের বাজার দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য।’
ইতিহাসবিদ জেমস টেলরের মতে, ‘আড়ংয়ের তাঁতখানা সোনারগাঁর পানাম নামক স্থানে ছিল এবং মসলিন শিল্প কেনাবেচার এক প্রসিদ্ধ বাজার ছিল পানাম নগর।’ সবদিক বিবেচনা করেই হয়তো ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড ২০০৬ সালে পানামনগরকে বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় স্থান দিয়েছে।
দেশী বিদেশী পর্যটকেরা প্রতিদিন ছুটে আসেন পানামে। ছবি: জোহরা মিলা।
আজকের পানাম আর জীবন্ত পানাম মনের ভেতরে একেঁ নিচ্ছিলাম বারবার, কল্পনায়। এরই মধ্যে দুপুর পেরিয়ে গেল। খাবারের খোঁজ পানামের ইতিহাস খোঁজার চেয়ে বেশিই সহজ। দুপুরের খাবার শেষ করে একটু আলসেমির পর আবার পানামে ঢুকব এরই মাঝে হঠাৎ নজরে এলো একদল বিদেশী পর্যটক। সম্ভাষণ জানিয়ে কথা বলে জানা গেল তারা কানাডা থেকে তারা পাঁচ জন ভ্রমণে বের হয়েছেন দক্ষিণ এশিয়া দেখবেন বলে। ভারত ঘুরে দু’দিন আগে এসেছেন বাংলাদেশে। পাঁচ জনের দলের দুই নারী সদস্যকেই বেশি উচ্ছ্বসিত মনে হল। তাদের একজন লিরা। খুব সহজেই ভাব জমিয়ে ফেললাম। উদ্দেশ্য পানামে ঢুকতেই হাতের ডান দিকের যে বিল্ডিংটা ‘বিদেশী আর ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত’ সেখানে প্রবেশ করা। বিদেশী অতিথিদের প্রকৃত ঘটনা বুঝতে না দিয়েই ‘আমরা একটি দল’ কর্তব্যরত আনসার সদস্যকে এমনটি বুঝিয়ে ওখানে ঢুকতে বেগ পেতে হলো না। অস্বাভাবিক খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠে একটা বিশাল হলরুমে পৌঁছালাম। চারিদিকের দেয়ালে, পিলারে, সিলিংয়ে রঙিন কারুকার্য (অনেকটা আল্পনার মত) এখনও স্পষ্ট। একটু খোঁজ নিতেই জানা গেল, এখানেই নাচের আসর বসত এককালে। শিহরণ অনুভব করলাম! তবে এই কি সেই বাড়ি? ইশা খাঁর নাচ ঘর হিসেবে পরিচিত ‘নীহারীকা’ এক সময় সন্ধ্যা নামার পরই নাচ, গান, সুর ও সাকির আয়োজনে মেতে উঠত; নৃত্যের তালে তালে ঝুমুরের শব্দ ও তানপুরার সুরে শহরের সবচেয়ে দুঃখী বাইজী মেয়েটিও মুখরিত করে তুলত সোনারগাঁও’য়ের বাতাস। প্রশ্নের উত্তর আমরা পেলাম না, নেই কোন দিক নির্দেশনাও। যেন জনশূণ্য পানাম নগরীর মত নাম না জানা সেই দুঃখী নাচনেওয়ালীর সব শূণ্যতা আর চাপা কষ্ট হঠাৎই ঘিরে ধরল আমায়।
এই কি সেই ‘নীহারিকা ভবন’? ছবি: জোহরা মিলা।
বের হয়ে এলাম নাচ ঘর থেকে। এরই মাঝে পড়ন্ত বিকেলের সোনালি রোদের ছটা গায়ে এসে লাগছে। গোধূলির আলোয় পানাম নগরের দালানগুলো উজ্জ্বল রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। যেন এরই জন্য এসেছে পানামে এমনই বাঁধভাঙ্গা খুশি ছড়িয়ে পড়ল আমাদের চোখে-মুখে।
যেভাবে যাবেন
ব্যক্তিগত গাড়ি বা ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে সহজেই যেতে পারেন পানাম নগরে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সামনে থেকে বিআরটিসি, দোয়েল, বোরাক আর স্বদেশের বাস ছাড়ে সোনারগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে। ভাড়া বাসভেদে (এসি-ননএসি) ২৫-৫৫ টাকা। নামবেন সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া বাস স্ট্যান্ডে। গ্রামের পরিবেশ রিক্সায় উপভোগ্য হবে। ভাড়া ২০ টাকা। চাইলে সিএনজি নিয়েও যেতে পারবেন। পানামে প্রবেশ টিকিট মূল্য বাংলাদেশিদের জন্য ১৫, বিদেশিদের জন্য ১০০ টাকা।
সতর্কতা
পানাম নগরের ভবনগুলোর বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ নির্দেশনা সংবলিত ভবনগুলোর ভেতরে প্রবেশ করবেন না। পানাম নগরী বাংলাদেশের ঐতিহ্যই নয় এটি আমাদের জাতীয় সম্পদও। তাই কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি বা ময়লা-আবর্জনা ফেলে নোংরা করবেন না। আর সন্ধ্যার পর যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসাই ভাল।
লেখকঃ আবু আজাদ সম্পাদনা: ড. জিনিয়া রহমান। আপনাদের মতামত জানাতে ই-মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।