কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

মৃদুলা আমাতুন নূর।

মৃদুলা, বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ নারী পর্বতারোহী

আফসানা সুমী
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৮ জুলাই ২০১৭, ১৮:৩৮
আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৭, ১৮:৩৮

(প্রিয়.কম) মৃদুলা। সম্প্রতি মাউন্ট এভারেস্টের ২২,০০০ ফুট উচ্চতায় আরোহণ করে সর্বকনিষ্ঠ বাংলাদেশি নারী পর্বতারোহী হিসেবে আলোচিত হয়েছেন তিনি। যেখানে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে নারীর পোশাক কি হবে, নারীরা কোন কাজ করবে, কোনটা করবে না এই সব কিছু নিয়ে এখনো নানান কূপমণ্ডূকতা দেখা যায়, সেখানে এভারেস্টের মতো পর্বত জয়ের পথটা কেমন ছিল জানতে আমরা সরাসরি কথা বলি তার সাথে। 
 
প্রিয়.কমঃ পর্বতকে জয় করা- নেশা? নাকি সখ? কি বলতে পছন্দ করেন?  
 
মৃদুলাঃ নেশা এবং শখ দুটোই। পর্বত নেশাতে সুখ, সুখের জন্য নেশা।
 
প্রিয়.কমঃ আপনার পর্বতজয়ের গল্পটা শুরু থেকে শুনতে চাই? কীভাবে শুরু করলেন? ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল কি?
 
মৃদুলাঃ প্রথমে নেপালে সারানকোটে কিছু ট্রেকিং করি । আহামরি বড় কিছু না তবে হেঁটে হেঁটে সাদা পাহাড় গুলো দেখতে আমার ভাল লাগত। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ছোট থেকে দেখতাম। ক্লাইম্বারদের দেখতাম। খুব টানত আমাকে এসব, এই ক্লাইম্বিং এর ইচ্ছা আমারও ছিল। ফ্যামিলির সাথে নেপাল ও ভারত কয়েক বার যাওয়া হয় ।সেখানেই অনেক বন্ধু এবং জানা শোনা তৈরি হয় এসব নিয়ে। অন্নপূর্ণার চারিদিকে প্যারাগ্লাইডিং করেছিলাম আমি। স্বপ্নগুলো তখন থেকেই গড়ে উঠতে থাকে।
 
প্রিয়.কমঃ দেশের ভেতরে পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা কেমন?
 
মৃদুলাঃ রাঙ্গামাটিতে কাপ্তাইয়ে প্রথম কোন বাংলাদেশি পাহাড়ে উঠি। চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের অনেক পাহাড়েই আমি উঠেছি। তবে আমার মূলত ভালো লাগত সাদা পাহাড়। নেপাল দার্জিলিং এর আকাবাঁকা বরফে ঢাকা রাস্তাগুলো আর পাহাড়গুলো আমাকে খুব টানত। আমার জানা ছিল পর্বতে উঠার সরঞ্জাম গুলোর নাম। এগুলোর ব্যাবহার প্রথমে আমাকে বুঝিয়ে দেয় আমার পাহাড়ি নেপালি ভারতীয় বন্ধুরা।
 
প্রিয়.কমঃ শুনেছি, পাহাড়ে চড়া ছাড়াও আরও নানান রোমাঞ্চকর কাজে আগ্রহ আছে আপনার?
 
মৃদুলাঃ হ্যাঁ। সব ধরণের এডভেঞ্চারই আমাকে আকর্ষণ করে। সার্ফিং শিখি বাংলাদেশ সার্ফিং ক্লাব প্রেসিডেন্ট জাফর আলমের কাছ থেকে। স্কুবা ডাইভিং শিখি ডাইভিং ইন্সট্রাকট্রস ওয়ার্ল্ড এসোসিয়েশন এর এশিয়ান হেড বাংলাদেশি মুজিবর রহমান স্যারের কাছ থেকে। পরে জার্মানি থেকে এই এসোসিয়েশনের মূল প্রেসিডেন্ট আমাকে ফোন করে জানান, আমিই একমাত্র যে কিনা পানির নিচেও গিয়েছে এবং মাউন্ট এভারেস্টেও যাচ্ছে। এই বিষয় উনি না বলা পর্যন্ত আমার মাথায় আসে নি। পরে তারা স্কুবা ডাইভিং এর বেশ কিছু স্টিকার, লাইসেন্স এবং ডাইভিং ইন্সট্রাকট্রস ওয়ার্ল্ড এসোসিয়েশন এর ফ্ল্যাগ পাঠিয়ে দেন জার্মানি থেকে আমার বাসায় উপহার হিসেবে এবং মাউন্ট এভারেস্টে উড়াবার জন্য।
 
প্রিয়.কমঃ তাহলে তো জলে-স্থলে দুই দিকেই আপনার জয়জয়কার!
 
মৃদুলাঃ এগুলো সম্ভব হয়েছে কারণ ছোট থেকেই ছিলাম অন্য ধাঁচের মেয়ে । বাকি মেয়েরা যখন সাজগোজ, শাড়ি নিয়ে ব্যস্ত আমি তখন ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের এক ক্যাডেট। নিজের বুট পালিশ করতাম। মিলিটারি ট্রেইন্ড ছিলাম। শক্ত মনের এবং শরীরের অধিকারী ছিলাম।
 
পাহাড়ে বিভিন্ন সময় মৃদুলা। 
 
আলোচনার এই পর্যায়ে আসি নারী হয়েও এডভেঞ্চারের প্রতি ওনার এই আকর্ষণকে কীভাবে নিতেন তার পরিবার সেই প্রসঙ্গে। মৃদুলা বলেন, "ভ্রমণ প্রথমদিকে ফ্যামিলির সাথেই হত। তারাও ভ্রমণপ্রেমী। তবে আমি ভ্রমণপ্রেমীর চেয়েও বেশি এডভেঞ্চার আসক্ত। আমি যেদিন প্রথম প্যারাগ্লাইড করি ভীষণ ভয় পেয়েছিল আমার বাবা-মা। সেদিনই হয়ত বুঝতে পারেন নাই এই মেয়ে অন্য কিছুর জন্য!"
 
"আগে রিস্কি কাজ গুলোতে সায় দিতেন না বাবা মা। মানালিতে ট্রেনিং এ যাব শুনে তো আকাশ থেকে পড়েছিলেন। তবে ধীরে ধীরে আমার সাফল্য ধৈর্য সব কিছু মিলিয়ে তারা আশ্বস্ত হন। শুনলেই বাবা রেগে যান, তাই আমি কাজ করার আগে কিছু বলি না। সেবারও ইন্ডিয়া থেকে সিলেকশন লেটার (ক্যাডেট হিসেবে) পেয়ে তারপর বাবার হাতে দেই। নেপাল ভারতে বন্ধুবান্ধব থাকায় আমার ক্লাইম্বার বন্ধুরাই অনেক সাহায্য করে,নেপাল আর ভারতের হিমাচলের কালচারই অন্যরকম। নির্ঝঞ্ঝাট মন এবং প্রকৃতি প্রেমী বন্ধুদের থেকে শিখেছি অনেক কিছু। এখন মা-বাবাই আমার ছোট ছোট অর্জন জমিয়ে রাখেন। কোন শিশু ভক্ত বা কেউ ছবি তুলতে চাইলে বা কোন সংবর্ধনাতে এসে তারাও খুশি হন। 
 
প্রিয়.কমঃ সর্বকনিষ্ঠ পর্বতারোহী নারী (বাংলাদেশ) হিসেবে আজ আপনার স্বীকৃতি। আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন চূড়াটা কেমন জানতে চাই!
 
মৃদুলাঃ যেভাবে চাচ্ছিলাম ওভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমি এম. বি. বি. এস. করছি। যুক্ত আছি বাংলাদেশ WHO এবং অন্য বিভিন্ন বাংলাদেশ মেডিকেল ফিল্ড উন্নত করার সংস্থায়। ভয়েস ফর চিলড্রেন এর নতুন কিছু রিসার্চ প্রজেক্ট নিজ হাতে বানাচ্ছি। এভাবে অনেক দরজা খুলে যাচ্ছে। নেপাল ও মানালিতে কিছু প্রজেক্ট আছে, তারা আমাকে ভবিষ্যৎ ডাক্তার হিসেবে সেখানেই চায়।
 
প্রিয়.কমঃ তাহলে আপনার হাতে অনেক কাজ!
 
মৃদুলাঃ হ্যাঁ, অনেক কাজ। অনেক কিছু সামলাতে হয়। আম্মু মাঝে মাঝে বলেন, তুমি এত কাজ কেন কর? আমি বলি, নতুন নতুন কিছু করতে আমার ভালো লাগে।
 
নারীদের জন্য তো পরিবেশ খুব একটা নিরাপদ নয়। সবখানেই বিপদ যেন ওঁত পেতে থাকে। ট্রেকিং এ এধরণের পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেন?- এধরণের প্রশ্নের জবাবে মৃদুলার উত্তর হলো, 'নিজে ঠিক তো দুনিয়া ফিট!' 
 
আরও বলেন, "অনেকেই প্রশ্ন করেন, মেয়েরা সেইফ কোথায়? হ্যাঁ, তা ঠিক, কিছু কিছু কেস এবং জরিপে দেখা যায় মেয়েরা ঘরেও সেইফ না। তবে কি, মেয়েদের থাকতে হয় যেকোনো পরিস্থিতি সামলানোর যোগ্যতা। যেমন, একবার উড়ীরচড় মেডিকেল ক্যাম্পে এক লোক আমার বান্ধবীকে উত্যক্ত করার চেষ্টা করছিল, বান্ধবী একটু নরম হওয়াতে বুঝছিল না কি করবে! বান্ধবীর থেকে তেমন প্রতিবাদ না পেয়ে লোকটি আমার দিকে আগ বাড়াতে সাহস পায় আর আমি তার সাহসের বারোটা বাজিয়ে দেই। আমার এখনো মনে আছে, আমি তার দিকে এমন চাহনি দিয়েছিলাম মনে হচ্ছিল আমার এক চাহনিতেই তার সব পাপ একসাথে মনে পড়ে গিয়েছিল এবং চোখ নিচু করে আর তাকানোর সাহস পায়নি সে আমার এবং আমার বান্ধবীর দিকে। তো এইভাবেই আসলে চলতে হয়।"  
 
নারীদের উদ্দেশ্যে মৃদুলা বলেন, 
"আমার থিম ছিল, স্বপ্ন সবাই দেখে কিন্তু বাস্তবায়ন করতে হলে করতে হয় তার জন্য কাজ। এই সময়ের নারীদের জন্য বলতে চাই, স্বপ্নে বিভোর না হয়ে কাজে ডুবে যেতে হবে যাহা চাই তাহা নিয়ে। আমাকেও অনেক কষ্টের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। হয়ত সামনে আরও দিতে হবে। যে যার জন্য কাজ করবে সে তাই পাবে এটাই সত্য। তাই বসে না থেকে, নিজেকে হিনমন্যতায় না জড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে অনেকে স্বাধীনতা পেয়ে তা নষ্ট করে আবার অনেকে তা কাজে লাগায়। এই স্বাধীনতার মানে বুঝতে হবে, স্বাধীনতা তখনি কার্যকরি হবে যখন আপনি নিজেকে ভালো কিছুর যোগ্য করে সময়কে কাজে লাগাবেন।"
 
'এভারেস্টের ২০,০০০ ফুট উচ্চতা তো জয় হলো। এবার চূড়ায় উঠছেন কবে?' এমন প্রশ্নের জবাবে মৃদুলা জানান তার মেডিকেলের পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনা আর রোমাঞ্চকর অভিযান এগিয়ে চলে দুটোই চলে পাশাপাশি। তাই নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না সময়টা। তবে শুধু এভারেস্ট নয়, সেভেন সামিটও করবেন তিনি শীঘ্রই। 
 
 
সম্পাদনা ড. জিনিয়া রহমান।
আপনাদের মতামত জানাতে ই-মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।