
ছবি সংগৃহীত
শব্দে শব্দে দীন শেখা: আমানত ও আমানতদারিতা
আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৬:১৮
কারও কাছে কোনো কিছু নিরাপদে গচ্ছিত রাখাই আমানত। ছবি: সংগৃহীত
(প্রিয়.কম) আমানত একটি আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ বিশ্বস্ততা, আস্থা, নিরাপত্তা বা নিরাপদে রাখা ইত্যাদি। প্রখ্যাত অভিধানবেত্তা ইবনু মানযূর (রহ.) বলেন, আমানত শব্দটি খেয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতার বিপরীত শব্দ। আমানত অর্থ হলো- কারও ওপর কোনো ব্যাপারে নির্ভর করা বা কারও কাছে কোনো কিছু নিরাপদে রাখা। (আল মুজামুল ওয়াসিতত, আল মুনাজদ)।
গচ্ছিত জিনিসের সংরক্ষণ ও হেফাজত করার নাম আমানতদারিতা। হেফাজতের দায়িত্ব যার ওপর ন্যস্ত করা হয় তাকে বলা হয় আমিন অর্থাৎ আমানতদার। বিশিষ্ট তাফসিরবিদ আল্লামা কুরতুবি (রহ.) -এর দৃষ্টিতে আমানতদারীর বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক। ইসলামী জীবন পদ্ধতির সব কিছুর সঙ্গে আমানতদারীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অর্থাৎ ফরজ, ওয়াজিব, ইবাদত, মুয়ামালাত (দৈনিক আচার ব্যবহার) সব কিছুই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। আর এ সবই হলো আল্লাহ প্রদত্ত আমানত।
আল্লাহর অবতীর্ণ কোরআন একটি আমানত। সালাত, সাওম, জাকাত, হজের মতো মুয়ামালাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী হক বা অধিকার এমনকি প্রতিটি মানুষের হাত-পা, চোখ-কান, নাক, মাথা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সবই আমানতের আওতাভুক্ত। হককুল্লাহ ও হককুল ইবাদ সবই আমানত। রাষ্ট্র পরিচালনা, সরকারি ও বেসরকারি দাফতরিক কাজকর্ম, শিক্ষকতা, সমাজের নেতৃত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, মজুরি, শ্রম-মেহনত, দেশপ্রেম ইত্যাদি সবই আমানত। সুতরাং আমানত শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হয়।
আমাদের সমাজে সাধারণত টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখাকেই আমানত মনে করা হয়। আর কেউ যদি এটা নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে বা গচ্ছিত অর্থ-সম্পদ আত্মসাত করে ফেলে এটাকে আমরা খেয়ানত বলি। তবে কোরআন-হাদিসে আমানতের বিস্তৃতি আরেকটু ব্যাপক। যেমন, জন্মের আগেই মানুষ রূহের জগতে স্বীকার করে এসেছে আল্লাহ আমাদের প্রভু- এটাও একটি আমানত। মানুষের গোটা দেহটাই আমানত। প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন আমানত হিসেবে। যথাযথভাবে তা ব্যবহার না হলেই তা আমানতের খেয়ানত।
আবুল বাকা আইয়ূব বিন মূসা আল-কাফাবি (মৃ. ১০৯৪ খ্রি.) বলেন, আমানত হলো প্রত্যেক ওই জিনিস যা বান্দার উপর ফরজ করা হয়েছে। যেমন, সালাত, সিয়াম, জাকাত ও ঋণ পরিশোধ করা ইত্যাদি। অন্যত্র তিনি বলেন, আমানত হল এমন সম্পদ, নিষিদ্ধ বিষয়াবলী ও গোপন কথা, যা কারও কাছে রক্ষিত থাকে। (কাফাবি, কিতাবুল কুল্লিয়াত, পৃ. ১৭৬)
এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টরে আমানত একটি অতি পরিচিত ও বহুল প্রচলিত শব্দ। আমানত শব্দটি ইসলামী ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিশেষ একটি ব্যাংকিং পরিভাষা। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকের পক্ষ থেকে একটি ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত রাখা সব ধরনের ডিপোজিট বা সঞ্চয়কে আমানত বলা হয়ে থাকে। ইসলামী ব্যাংকগুলো বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ইসলামী পরিভাষায় আমানত সংগ্রহ করে থাকলেও মূলত তাদের আমানত সংগ্রহের প্রধান পদ্ধতি চারটি। ১. চলতি হিসাব। ২. সঞ্চয়ী হিসাব। ৩. স্থায়ী হিসাব। ৪. বিশেষ হিসাব।
এ ছাড়া গ্রাহক ব্যাংকের ভল্ট-লকার-সিন্দুক বা নিরাপদ নিরাপত্তাবেষ্টিত কক্ষে যে সব কিছু সংরক্ষিত রাখেন ইসলামী ব্যাংকিং পরিভাষায় তাকেও আমানত বলা হয়।
ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত রাখা সব ধরনের সঞ্চয়কে ইসলামী ব্যাংকিং পরিভাষায় আমানত বলা হয়। ছবি : সংগৃহীত
ইসলামে আমানতদারীর গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম আমানত ও আমানতদারিতাকে বেশ কিছু কারণে গুরুত্ব প্রদান করেছে। তার মধ্যে বিশেষ কিছু কারণ হলো- ১. আমানত রক্ষার ওপর দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের উন্নতি নির্ভর করে। যে কোনো সম্ভাবনাময় জাতির জন্য আমানত ও আমানতদারিতা একটি অপরিহার্য বিষয়। ২. আমানতদারী না থাকলে জাতির বিপর্যয় নিশ্চিত। ৩. সমাজের মধ্যে ঐক্য, সংহতি, হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা, স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা সৃষ্টির মূল হলো আমানতদারী। পরস্পরের আস্থা প্রতিষ্ঠার একটি মাত্র উপায় হলো আমানতদারী।
হাদিসে মুনাফিকের অন্যতম পরিচয় হিসেবে আমানতের খেয়ানত করাকে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল (সা.) আমানত লঙ্ঘনকারীকে মুনাফেক সাব্যস্ত করেছেন। অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, যার মধ্যে আমানতদারী নেই, তার ঈমান নেই।
হাদিসে আরও বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি আল্লাহর পথে শাহাদত বরণ করেন, কিন্তু সে মানুষের আমানত না বুঝিয়ে মারা যান। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে বলবেন, মালিকের কাছে আমানত ফেরত দাও। কিন্তু সে মালিককে খুঁজে পাবে না। তখন আমানতের বোঝা তার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এই লোক শহীদ হওয়ার পরও বান্দার অধিকার নষ্ট করার কারণে জাহান্নামের ভাগী হলো। ঈমানের অনিবার্য দাবি হলো- বিশ্বস্ত হওয়া, আমানতে খেয়ানত না করা। ইসলামী জীবন পদ্ধতির সব কিছুর সঙ্গে আমানতদারীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যে আমানত রক্ষার ব্যাপারে স্বচ্ছ না, সে মুমিন নয়। অন্য হাদিসে আল্লাহর মহানবী (সা.) বলেছেন, আমানতের খেয়ানতকারী ইসলামচ্যুত হিসেবে গণ্য হবে। কোনো লোক নেক আমল করা সত্ত্বেও আমানতের খেয়ানতের কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, হে মুসলিমগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদের হাতে ফেরত দেবার নির্দেশ দিচ্ছেন। আর লোকদের মধ্যে ফায়সালা করার সময় আদল ও ন্যায়নীতি সহকারে ফায়সালা করো। আল্লাহ্ তোমাদের বড়ই উৎকৃষ্ট উপদেশ দান করেন। আর অবশ্যই আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও দেখেন। (সূরা নিসা : ৫৮)
এ ছাড়াও অন্য আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! জেনে বুঝে আল্লাহ ও তার রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না, নিজেদের আমানতসমূহের খেয়ানত করো না। (আল আনফাল: ২৭)।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বনি ইসরাঈলরা যেসব খারাপ কাজে লিপ্ত হয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিল আমানতের খিয়ানত করা। তারা নিজেদের পতনের যুগে আমানতসমূহ অর্থাৎ দায়িত্বপূর্ণ পদ, ধর্মীয় নেতৃত্ব ও জাতীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মর্যাদপূর্ণ পদসমূহ (Positions of trust) এমন সব লোকদেরকে দেয়া শুরু করেছিল যারা ছিল অযোগ্য, সংকীর্ণমনা, দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ, খেয়ানতকারী ও ব্যভিচারী। ফলে অসৎ লোকদের নেতৃত্বে সমগ্র জাতি অনাচারে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
কেউ কারও কাছে কিছু গচ্ছিত রাখলে তা যথাযথভাবে মালিকের কাছে পৌঁছে দেয়ার নামই হচ্ছে আমানতদারী। প্রত্যেক মানুষই কোন না কোন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে প্রত্যেকে যার যার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করাও আমানতদারীর পরিচায়ক। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, অফিসের কোন কর্মচারী বা কর্মকর্তা যে দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা তার আমানতদারী, এর বিপরীতে সে যদি দায়িত্বে অবহেলা করে অথবা একে অবলম্বন করে অন্য কোন উপায়ে অর্থ উপার্জন করে তবে সে আমানতের খেয়ানত করল।
প্রত্যেক আমানতদারের মাঝে তিনটি মৌলিক গুণ থাকা জরুরি। ১. আমানত যার কাছে রাখা হয় তাকে পবিত্র নিষ্ঠাবান হতে হবে। ২. আমানত রক্ষার ব্যাপারে সার্বিক দায়দায়িত্ব পালন করতে হবে। ৩. আমানতের হুবহু জিনিসটি মালিকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
সম্পাদনা: ফকির কামরুল