আজকাল আমি প্রায় প্রতিদিনই একটি প্রশ্নের মুখোমুখী হই- "আপু, সত্যিকারের ভালবাসা কী? কিংবা কীভাবে বুঝবো যে মানুষটি আমাকে সত্যি সত্যি ভীষণ ভালোবাসে?" ... ব্যাপারটা স্বাভাবিক। রিলেশনশিপ কাউন্সিলিং যার প্রয়োজন হচ্ছে, ভালবাসা বা সম্পর্ক নিয়ে একটা দ্বিধা তাঁর মনে থাকতেই পারে।

 

প্রথম প্রথম আমি থমকে যেতাম। কারণ "ভালবাসার" ধারণাটি খুব ব্যক্তিগত একটা জিনিস। প্রতিটি মানুষই ভালবাসা জিনিসটাকে একদম নিজের মত করেই সংজ্ঞায়িত করতে চাইবেন আর সেটাই স্বাভাবিক। মানুষ থেকে মানুষে ভালোবাসার ধারণাটি ভিন্ন বলেই প্রতিটি সম্পর্কের আঁকাবাঁকা পথগুলিও ভিন্ন। আবার, কাউকে ভালো লাগা-প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদি প্রতিটি অনুভবই কিন্তু পরস্পর থেকে ভিন্ন। হ্যাঁ, বেশীরভাগ মানুষই এই সম্পর্কগুলির ভিন্নতা হয়তো অনুধাবন করতে পারেন না। কিন্তু, সম্পর্ক বা অনুভবগুলো আদতেই ভিন্ন।

 

এই প্রশ্নগুলোর কারণেই ভালবাসা শব্দটা নিয়ে আমাকে অনেক ভাবতে হয়, ভাবছি। প্রতিটি মানুষের ভাবনাই তাঁর জীবন ঘিরে আবর্তিত, আমিও এই বৃত্তের বাইরে নই। একজন লেখক বা একজন মানুষ হিসেবে আমি কীভাবে প্রেম-ভালবাসা বা এই ধরণের মানবীয় সম্পর্কগুলিকে সজ্ঞায়িত করি, সেই কথাগুলোই লিখছি আজ-

 

কাউকে ভালো লাগলো মানেই আমি তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম, বিষয়টি মোটেও এত সহজ নয়। জীবনের পথে চলতে ফিরতে ভালো অনেককেই লাগতে পারে। কাউকে কাউকে দেখে মনের মাঝে ভালো লাগার বা পছন্দ করার একটা অনুভব হতেই পারে। যদি সেই মানুষটার সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়, কিছুদিন জানাশোনার পর মনে হয় যে এর সাথে আরও খানিকটা সময় কাটাতে চাই, তাহলে যে সম্পর্কটি তৈরি হয় সেটাই হচ্ছে প্রেম!

 

জি না, প্রেম ও ভালবাসা কিন্তু মোটেও এক জিনিস নয়। আমরা প্রায় সবাই প্রেম ও ভালোবাসার মাঝে পার্থক্যটা করে উঠতে পারি না। আর এই কারণেই প্রেমে ব্যর্থতা মেনে নিতে পারি না অনেকেই। প্রেম কোন চিরকালের জিনিস নয়। প্রেমের সম্পর্ক ভাঙতে পারে, প্রেমের রূপ বদল হতে পারে, একটা মানুষ বারবার প্রেমে পড়তে পারে। কোন কোন প্রেম ভালোবাসায় রূপ নিতে পারে, কিন্তু সব প্রেমের সম্পর্কই যে ভালবাসা হয়ে উঠবে এটা কিন্তু জরুরী নয়! অন্যদের কথা জানি না, তবে প্রেম সম্পর্কে আমার ধারণাটি বিচিত্র। আমার মনে হয় একজন মানুষ ততবার প্রেমে পড়তেই থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর জীবনে সত্যিকারের ভালবাসা প্রবেশ করে। নিজের বাড়ি থেকে পেট ভরে খেয়ে বের হবার পর বাইরে যত ভালো খাবারই সামনে পড়ুক না কেন, খাওয়া যায় না। কারণ পাকস্থলীতে জায়গা নেই! ভালোবাসার ব্যাপারটিও আমার ঠিক তেমনই মনে হয়। যার জীবনে ভালবাসা স্থায়ী হয়ে যায়, তাঁর জীবনে আর প্রেমের প্রবেশাধিকার থাকে না। তবে হ্যাঁ, ভালবাসা পাবার পর সেটা ধরে রাখতে পারে কতজন, এটা নিয়ে অবশ্য তর্ক হতেই পারে। খুব অদ্ভুত কোন একটা কারণে আমরা অনেকেই প্রেমের চাকচিক্যে ভুলে ভালোবাসার স্নিগ্ধতাকে আর পাত্তাই দিই না!

 

ঘুরেফিরে প্রশ্নটি আবার সেখানেই চলে এলো- "তাহলে ভালবাসা কী? আর কী করে বুঝবো যে এটাই ভালবাসা?'

 

উত্তরটি কিন্তু ভীষণ সহজ।

যে সম্পর্কটি আপনার মনের মাঝে হাজার হাজার ওয়াটের আলো জ্বেলে দেয়, সেটাই ভালবাসা। যে সম্পর্কটি আপনার জীবনের প্রতিটি ইঞ্চি আলোকিত করে তোলে, সেটাই ভালবাসা। যে সম্পর্কটি আপনাকে আরও উন্নত, আরও সফল, আরও ভালো একজন মানুষ বানিয়ে ফেলে আপনার অজান্তেই- সেটাই ভালবাসা! যে সম্পর্কটি আপনাকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করে নিজের যোগ্যতার চাইতেও দারুণ একটা কিছু হয়ে ওঠার জন্য, সেটাই ভালবাসা। যে সম্পর্কটি আপনার ভেতরের সব অস্থিরতাগুলোকে শান্ত করে আপনাকে ধৈর্যশীল আর সুখী মানুষ বানিয়ে দিতে পারে, সেটাই ভালবাসা! 

 

একটু থামুন, ভাবুন। আপনি এখন যে সম্পর্কটিতে আছেন, সেই সম্পর্কটি আপনার মাঝে কী কী বদলে দিয়েছে? সম্পর্কটিতে প্রবেশের পর আপনার জীবনে কী কী অর্জন হয়েছে? কোন কোন সাফল্যের পথ পাড়ি দিয়েছেন আর তাতে কি সঙ্গী/সঙ্গিনীর ভূমিকা ছিল? আপনি কি আগের চাইতে সুখী মানুষ পরিচত হয়েছেন? আপনার কি নিজেকে "কমপ্লিট" মনে হয় এখন? একাকীত্ব কী জিনিস আপনি কি ভুলেই গিয়েছেন?

 

উত্তরগুলো যদি হ্যাঁ হয়, সম্পর্কটি নিঃসন্দেহে ভালোবাসার।

উত্তরগুলো যদি না হয়, তাহলে আপনার আরও ভাবার প্রয়োজন আছে!

 

আমার মনে হয় সত্যিকারের ভালবাসা সেই অদ্ভুত শক্তি, যা আমাদের ভেতরের সেরাটুকুন বের করে নিয়ে আসে। মানুষ মাত্রই নিজের বুকের মাঝে গোপন দুনিয়ায় একেবারেই একা। আর সত্যিকারের ভালবাসা সেই আশ্চর্য শক্তি, যা এই একাকীত্বকে দুর করে মনে মাঝে পুরোটা আলোকিত করে তোলে। আপনার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য করা ভালবাসা নয়, সন্দেহ বা নিন্দা করা ভালবাসা নয়, আপনার সামনে এগোনোর পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি ভালবাসা নয়, পৃথিবীর সামনে যা আপনাকে ছোট করে সেটাও কোনভাবেই ভালবাসা নয়। "ও আমাকে অনেক ভালোবাসে, এই কারণেই তো সন্দেহ করে! ও আমাকে এইটা করতে দেয় না, করলে ও খুব রাগ করে। ও বলেছে আমি ওইটা করতে পারলে ও বিয়ের কথা ভাববে। সম্পর্ক করতে গেলে তো কম্প্রোমাইজ করতেই হয়! ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন? আমার জীবনে ভালোবাসার মানুষ আছে, কিন্তু তবুও আমার একলা লাগে। ও আমাকে অনেক ভালোবাসে, জাস্ট আমি একটু মোটা/কালো/খাট বলে মন খারাপ করে"... এইসব অনুভবের কোনটাই ভালবাসা নয়! যদি এগুলোই আপনার ভাবনা হয়ে থাকে, ধরে নিতে পারেন যে সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ জীবনে এখনও পেয়ে ওঠা হয়নি।

 

আমার কথা শুনে রাগ হচ্ছে খুব? ভাবছেন , এই মহিলা ভালোবাসার কী জানে! হ্যাঁ, আমি হয়তো কিচ্ছু জানি না। তবে একটি জিনিস নিশ্চিত জানি যে- সত্যিকারের ভালবাসা কখনো আপনাকে অসুন্দর অনুভব করায় না। যে মানুষটি আপনাকে আসলেই ভালোবাসে, আপনাকে কালো-মোটা-চিকন-ফর্সা এসব নিয়ে তাঁর কিচ্ছু যাবে আসবে না। সে আপনাকে শর্ত দিয়ে খাঁচার মাঝে আটকে রাখবে না, আপনাকে তার নিজের মত করে চালানোর চেষ্টাও করবে না। বরং আপনার সাথে নতুন একটা আকাশ উন্মুক্ত করে দেবে, সে আকাশে দুজনে একসাথে উড়বেন। একটার পর একটা সাফল্যের পালক এসে যুক্ত হবে আপনার ডানায়। অর্থ-বিত্ত থাকুক বা না থাকুক, পরস্পরের সাথে থাকতে পারাটাই হবে একমাত্র সুখ।আর কম্প্রোমাইজ? কম্প্রোমাইজ সেটাকেই বলে যখন আমরা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করি। সত্যিকারের ভালোবাসায় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার প্রয়োজনই পড়ে না!

 

আর হ্যাঁ, এমন ভালবাসা কিন্তু সত্যিই মেলে জীবনে!

বেশি কিছু ভাবতে হবে না, শুধু এটুকু ভেবে দেখুন- আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনী মানুষটি কি আপনার জীবনে আর মনে হাজার হাজার ওয়াটের আলো জ্বালতে পেরেছে? আপনাকে কি আগের চাইতে অনেক বেশি ভালো আর সুখী মানুষে রূপান্তরিত করতে পেরেছে?

 

শেষমেশ যাবার আগে ছোট্ট একটি সুসংবাদ দিয়ে যাই। চলছে একুশে গ্রন্থমেলা, আর এই গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে এই ক্ষুদ্র লেখকের লেখা তিন বই। বইগুলো সারা মাস পাওয়া যাবে বইমেলা ছাড়াও অনলাইন বুক স্টোরগুলোতে

 

অবলৌকিক- বিদ্যা প্রকাশ (স্টল নং ৩৭০-৩৭১-৩৭২)

প্রিয় সম্পর্ক- জাগৃতি প্রকাশনী (স্টল নম্বর ১৫৮-১৫৯-১৬০)

পুনঃশায়াতিন- জাগৃতি প্রকাশনী (স্টল নম্বর ১৫৮-১৫৯-১৬০)