কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের সংলাপ। ছবি: ফোকাস বাংলা

সংলাপ-আলাপে আমাদের রাজনীতি

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ০১ নভেম্বর ২০১৮, ২০:৩৩
আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৮, ২০:৩৩

‘রাজনীতির পক্ষ বিপক্ষ’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম সম্প্রতি। লেখাটি গণমাধ্যমে দেওয়া হয়নি। লেখার পর মনে হয়েছে, আজকে আমি যা লিখছি, তা কালকের দৃশ্যপটের সঙ্গে মিলবে কি না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে সম্ভাব্য কিছু বলা খুব কঠিন। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের রাজনীতি তো অনুমানেরও বাইরে। ৯০-এর গণ-আন্দোলনের কথা এই প্রজন্মের মনে থাকার কথা নয়। আমাদের বয়সীরা যারা সেই আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, তারা বলতে পারবেন। এরশাদ সাহেব সকালে বিশাল জনসভায় দাঁড়িয়ে দৃঢ়চিত্তে বললেন, আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সেদিন সন্ধ্যাতেই কিন্তু গণেশ উল্টে গেল, তিনি পদত্যাগ করলেন। সুতরাং বিশাল জনসভা বা হুংকার এসব টিকে থাকার শর্ত নয়। গরিব দেশের সরকারে টিকে থাকার আরও নানা শর্ত রয়েছে, যেসব শর্তপূরণ করেই টিকে থাকতে হয়।

এ লেখাটি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘সংলাপ’ বিষয়ক সাময়িক উত্তেজনার আগের দিন লেখা। গণমাধ্যমগুলো শিরোনাম করেছে, ‘আগামীকাল কী হবে’, ‘সংলাপের পরিণতি কী’, ইত্যাদি সব। আমাকেও অনেকে বলেছেন, এ বিষয়ে লিখতে। তাদের ছোট্ট করে বলেছি, হাতের রেখা দেখে হয়তো ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া যায়, কিন্তু এদেশের রাজনীতির রেখা গুনে দেখা অনেক বড় জ্যোতিষের পক্ষেও সম্ভব নয়। সংলাপের কথাই বলি। কেউ কি ভেবেছিলেন, হঠাৎ এভাবে সংলাপের আলাপ উঠার কথা। মানা হবে না, শোনা হবে না, এমন কথাইতো শক্তভাবে উত্থিত হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সংলাপের আহ্বান। এখানে বিনা মেঘের বজ্রপাত বললাম এ জন্যই যে, অনেকেই ঐক্যফ্রন্টের চিঠি পাঠানোকে ‘পণ্ডশ্রম’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর স্বপক্ষে কিবোর্ডে অনেকে যুক্তির ঝড়ও তুলেছিলেন। তাদের সেই অবস্থানের বিপরীতে সংলাপের আহ্বান তো বিনা মেঘে বজ্রপাতেরই মতো। কোনো রকম আভাস না দিয়েই সংলাপ এবং সকল ‘না’-এর আগল ভেঙে বলা, আলোচনা হতেই পারে।

গণভবনে সন্ধ্যা ৭টার পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও জোট নেতাদের বৈঠক শুরু হয়। ছবি: ফোকাস বাংলা
গণভবনে সন্ধ্যা ৭টার পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও জোট নেতাদের বৈঠক শুরু হয়। ছবি: ফোকাস বাংলা

এখন আলাপ চলছে ‘সংলাপ’ সফল হবে কি না, এ বিষয়ে। এ লেখা যদি প্রকাশিত হয়, তখন হয়তো সংলাপ শেষ হয়ে যাবে। তাই অহেতুক অনুমানের আশ্রয় নিয়ে মস্তিষ্ককে ব্যতিব্যস্ত রাখার কোনো মানে হয় না। দু’একদিনের জন্য সংলাপের পরিণতি অনুমান না করে, বরং সংলাপ এবং তার পরবর্তী কী আলোচনা হওয়া উচিত, সেটার ওপর আলোকপাত করা বেশি জরুরি।

দেশে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। অন্তত দেশ ও মানুষ বাঁচাতে বিকল্প সন্ধানের সুযোগও নেই। সুতরাং আলোচনা কেন্দ্রিভূত হওয়া উচিত এ বিষয়টাতেই, যাতে নিশ্চিত হয় অমন নির্বাচনের পথটি। মানুষ ভোট দিতে পারলে এবং মানুষের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার এলেই বাকি সব সমস্যার সমাধান খুব একটা শ্রমসাধ্য হবে না। এমন নির্বাচন মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে এবং সেই ভোটের ফলাফল যেন সে অনুযায়ীই হয়। ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দীনের ভোট দেখেছি, মানুষ ভোট দিয়েছে এবং ফলাফলে বিস্মিত হয়েছে, তেমন বিস্মিত হবার নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। আবার সেই নির্বাচনেরও প্রয়োজন নেই, সকাল থেকে বিকেল অবধি বুথের সামনে লম্বা লাইন, কিন্তু দিনভর লাইনে ঘুরে-ফিরে একই মুখ। লাইন দেখে গণমাধ্যমকর্মীরা লিখছেন, প্রচুর মানুষের উপস্থিতি, লম্বা লাইন, ভোটগ্রহণ চলছে। অথচ ঘুরে-ফিরে একই মুখের লাইনে কী চলছে, তা বলাবাহুল্য।

রাজনীতি বিষয়ে অনুমানের ব্যাপারটি যে কত কঠিন, তা কাদের সিদ্দিকী সাহেবের সংবাদ সম্মেলন থেকেই বোঝা যায়। মানবজমিন অনলাইন দেখছিলাম, সেখানে কাদের সিদ্দিকীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, তিনি কোন জোটের সঙ্গে যাবেন, তা ৩ নভেম্বর জানাবেন বা পরিষ্কার করবেন। অর্থাৎ তিনিও হয়তো অনুমান করতে পারছেন না, কোন জোটের ভবিষ্যৎ কী? তবে এই যে জোটে যাওয়া না যাওয়া বিভিন্ন দলের মধ্যে মতভেদ, তা দেশের অনিশ্চিত রাজনীতিরই প্রমাণ। আর এ কারণেই রাজনীতি নিয়ে অনুমান হাতের রেখা গোনার চেয়েও কঠিন।

সংলাপ চলাকালে গণভবনের বাইরে ফলপ্রসূ সংলাপের দাবিতে মানববন্ধন করেন বেশকিছু তরুণ। ছবি: প্রিয়.কম

যে দেশে জোট হয়, মানুষের কথা চিন্তা করে নয়, ক্ষমতার কথা ভেবে। মানুষ কী করে ভালো থাকবে, নিরাপদ থাকবে, নিশ্চিন্তে থাকবে। তার মৌলিক অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা হবে কি না, এসব ভাবনার চেয়ে ক্ষমতার চিন্তাই রাজনীতিকদের বেশি থাকে। জানি, অনেকে বলবেন, ক্ষমতার জন্যেই রাজনীতি। এ কথা যারা বলেন, তারা মূলত দেশ, রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি এসবের পার্থক্যকে ধর্তব্যে আনেন না। হয় বোঝেন না, না হলে বোঝার প্রয়োজন বোধ করেন না। অথচ সবকিছুর মূলে হলো মানুষ। একদল মানুষ যখন চিন্তা করে তাদের স্বকীয়তা, সাযুজ্য সব মিলিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র প্রমাণে একটি নির্দিষ্ট এবং নিজস্ব ভূখণ্ড দরকার, সেই চিন্তাই হলো রাষ্ট্র। এর বড় উদাহরণ আমরা বাংলাদেশিরা। নিজ স্বাতন্ত্র্য প্রমাণে আমরা একটি ভূখণ্ড অর্জন করেছি। আর এই অর্জন মানুষের প্রয়োজেনই। মানুষের প্রয়োজনেই রাষ্ট্র চালাতে সরকার প্রয়োজন হয়। আর সরকারের কর্মপদ্ধতি হলো রাজনীতি। যেটা মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্ট। অথচ আমাদের দেশের রাজনীতিকদের চলা হলো উল্টো পথে। তারা রাজনীতি করে সরকার বানানোর জন্য, যার জন্য প্রয়োজন ক্ষমতা। যে রাষ্ট্রকে শাসন করার জন্য ক্ষমতা প্রয়োজন, ক্ষমতার জন্য রাজনীতি প্রয়োজন, তার উদ্যোক্তা হলো মানুষ। ভুল পথে চলা রাজনীতির কারণে সে মানুষই উপেক্ষিত থেকে যায়, অথচ তারা বোঝেন না, মানুষ উপেক্ষিত হলে, নির্যাতিত হলে, অমন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে, ক্রমেই সেই রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে।]