কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

অভিনেতা আনিসুর রহমান দীপু। ছবি: শামছুল হক রিপন, প্রিয়.কম

‘ভেতরে শ্রদ্ধাবোধ ও শুদ্ধতা না থাকলে সৃষ্টি কীভাবে শুদ্ধ হবে?’

তাশফিন ত্রপা
ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:১২
আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:১২

(প্রিয়.কম) এক সময়কার টেলিভিশন নাটকের ব্যস্ত অভিনেতা ছিলেন। নাটক ছাড়াও পর্দার জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোতে তার ছিল দক্ষ উপস্থাপনা। পাশাপাশি মঞ্চ নাটকেও ছিল দাপুটে উপস্থিতি। বলছি অভিনেতা আনিসুর রহমান দীপুর কথা ।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের দিকে বিটিভির জনপ্রিয় নাটকগুলোর প্রিয় মুখ ছিলেন তিনি। এরপর ২০১১ সালে বাংলাদেশের বিনোদন জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে বর্তমানে নিউ ইয়র্কেই বসবাস করছেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। ১৬ সেপ্টেম্বর প্রিয়.কমের সঙ্গে আলাপ হয় এ গুণী শিল্পীর। প্রাথমিক কুশল বিনিময় শেষে দীপুর আলাপ থেকে উঠে আসে তার প্রবাস জীবন, ব্যক্তিগত জীবন, রুপালি পর্দার ফেলে আসা সময় ও বর্তমান সময়ের নানা কথা। ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে।

প্রিয়.কম: ছোটবেলায় আপনার অভিনীত অনেক নাটক দেখেছি। আপনাকে দেখার পর হুট করে সেই সময়কার নাটকগুলোর একগুচ্ছ এলোমেলো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছে…

আনিসুর রহমান দীপু: নিউ ইয়র্কে থাকার কারণে মিডিয়া থেকে দূরে আছি অনেক বছর। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একজন জানালেন, ওনার মা আমার অনেক ভক্ত ছিলেন। তিনি তার মায়ের কাছ থেকে আমার অনেক কথা শুনেছেন। ওই হিসেবে তিনি ফেসবুকে আমাকে রিকুয়েস্ট পাঠান। আমি আবার ফেসবুকে মেয়েদের খুব একটা একসেপ্ট করি না। কারণ বেশিরভাগ ফেক, থাকে নানা রকমের সমস্যা। তো তিনি ইনবক্সে লিখে পাঠিয়েছেন, ‘আমার মা আপনার ভক্ত ছিল, ওই হিসেবে আমিও আপানার ভক্ত। অ্যাড করেলে খুশি হব।’ দেখলাম আগের ওই জেনারেশনটা খুব ভালো চিনত। যেহেতু এখন পর্দায় নাই, তাই নতুনদের অনেকেই চিনেন না। কিছুদিন আগে নিউ ইয়র্কে একটা নাটক করলাম। সেখানে সমসাময়িক একজন নায়ক ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি কখনো থিয়েটার করতেন?’ যেহেতু তিনি আমাকে চেনেননি, তো আমি বললাম, ‘না’। এরপর আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কখনো টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন?’ আমি বললাম, ‘না’। তারপর তিনি বললেন, ‘তাহলে?’ তখন আমি বললাম, ‘আসলে আমি ফ্রি ছিলাম তো, ডিরেক্টর সাহেব আমাকে একটা চরিত্রে অভিনয় করতে বললেন। তাই চলে এলাম।‘ যেহেতু বর্তমান মিডিয়ার সঙ্গে আমার একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। এদিকে ওনারাও এরমধ্যে মিডিয়াতে এসেছেন। নিজেদের একটা ভালো জায়গা করে নিয়েছেন। এইতো।

প্রিয়.কম: অভিনয় জগতের শুরুর দিক নিয়ে যদি কিছু বলতেন…

আনিসুর রহমান দীপু: ধারাবাহিক আকারে যাওয়া আমার প্রথম নাটকটি ছিল ১৯৯৬ সালে ইমদাদুল হক মিলনের ‘যুবরাজ’। আর খণ্ড নাটকের মধ্যে ছিল মঞ্জুর হোসেনের ‘মায়ের আদেশ’ ও মোহন খানের ‘শুধু একজন’। মায়ের আদেশ প্রথম অভিনয় হলেও পর্দায় প্রথম আসে ‘যুবরাজ’ এবং ‘শুধু একজন’। দুইটি নাটক ছিল ১৯৯৬-৯৭ সালের সুপার ডুপার হিট। তখনতো বিটিভি ছাড়া আর তেমন কোনো চ্যানেল ছিল না। আর ওই নাটকে মৌসুমী, আমির খানসহ আরও একজন নতুন নায়িকা ছিলেন। সেই সময় প্যাকেজ নাটকেরও একটা ব্যাপার ছিল। তারপর থেকে একে একে অনেক নাটকে অভিনয় করা। ১৯৯৪ সালের দিকে এক কর্মশালার মাধ্যমে মঞ্চে কাজ শুরু করেছি । এরও আগে ১৯৯৩ সালে মুক্তধারা আবৃত্তির কর্মশালায়ও ছিলাম। এভাবেই ছিল শুরুটা। আমি বিটিভিতে কাজ করতাম বেশি। কারণ একটা চাকরি করতাম। অফিস শেষ করে বিটিভি সেটে ঢুকে যেতাম। এটা ছিল আমার জন্য একটা পারফেক্ট জায়গা। যার জন্য আমার বিটিভি নাটকের সংখ্যা অনেক বেশি। সম্ভবত ২০১০ সালের দিকে বিটিভিতে আমার শেষ দুইটা ধারাবাহিক নাটক ছিল। একটি ‘সুলতান সম্রাট সেনাপতি’ অপরটি ‘কোন গ্রামের মেয়ে’। এই দুই নাটকই সেই সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। ‘কোন গ্রামের মেয়ে’ নাটকটিও ছিল ইমদাদুল হক মিলন ভাইয়ের।

১৭ সেপ্টেম্বর ফ্রেমবন্দী দীপু।ছবি: শামছুল হক রিপন, প্রিয়.কম

প্রিয়.কম: বেশ কিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায়ও দেখা গেছে আপনাকে...

আনিসুর রহমান দীপু: আমি আসলে উপস্থাপক ছিলাম, এ কাজটা বেশি ভালো লাগতো। সরাসরি দর্শকদের সাথে সংযোগ। বিটিভিতে ‘ঠিকানা’ নামের একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হতো। ঈদের সময় একটা বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ছিল ‘আনন্দ এবং’ এদিকে বিটিভি ওয়ার্ল্ডে ‘প্রবাসী পরিজন’ নামের আরেকটা অনুষ্ঠান ছিল। অন্যদিকে এটিএন বাংলায় প্রতি বছর ভ্যালেন্টাইন ডেতে ‘ভালোবাসার দিনে’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচার হতো। ওই অনুষ্ঠানের পাঁচটা পর্ব পাঁচ বছর করেছি। এর গ্রন্থনা, পরিচালনা এবং উপস্থাপনায় ছিলাম আমি। আমার স্ত্রী ছিলেন সহ-উপস্থাপিকা।। এ ছাড়া ভিশন-মঞ্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানই নিয়মিত উপস্থাপনা করতাম। অনেক নামি প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত উপস্থাপক ছিলাম।

প্রিয়.কম: অনেকই বলেন দর্শক এখনকার চেয়ে আগে প্রচুর নাটক দেখতেন। তাই টিভি অভিনেতাদের ভক্তের সংখ্যাও ছিল অনেক। জানতে চাইব ভক্তের সঙ্গে প্রিয় অভিনেতা দীপুর যেকোনো একটি স্মৃতির কথা।

আনিসুর রহমান দীপু: সম্ভবত ২০০৯-১০ সাল। তখন ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম, রংপুরে। হঠাৎ এক পত্রিকার হকার দৌড়ে আসেন। আমাকে দেখে উনি অবাক! তিনি বললেন, ‘ভাই আমার ছোটবোন আপনার নাটক না দেখেলে ভাত খায় না। আপনি এখানে এসেছেন! চলেন আমাদের বাসায়। আপনাকে দেখলে আমার বোন খুব খুশি হবে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বোন কী করে? তখন তিনি জানালেন, তার বোন খুবই ছোট। সম্ভবত তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। তো আমি তাদের বাসায় গিয়েছি। গিয়েছি এই কারণে, আমি যখন ছোট ছিলাম, থিয়েটার করি। তখন অনেক স্টারদের দেখতাম। যাদের অটোগ্রাফ চাইলে, কিংবা ছবি তুলতে চাইলে, কেমন একটা ভাব নিতেন। কিংবা সালাম দিলে, সালামের জবাব দিতেন না। তারপর থেকে একটা প্রতিজ্ঞা ছিল। যাতে আমি কখনো স্টার না হই। কারণ স্টার হলেতো ওই ভাবটা আমার ওপর চলে আসবে। আমি মনে করি, একটা মানুষ আমাকে মনে রাখার মানে আমার তার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। তিনি আমাকে নাও চিনতে পারতেন। বা তিনিও ভান করতে পারতেন, তিনি আমাকে চেনেন না। তাহলে কিছুই করার নাই। তো যেহেতু ওইটুকু আন্তরিকতা দেখিয়ে আমার সাথে কথা বলল। আমারও উচিত তাকে সম্মান জানানো। ওই সম্মান দেখানোর জন্যই আমি ওই মেয়েটির বাসায় গিয়েছিলাম। সেদিন আমাকে দেখে ওই ব্যক্তির বোন কী যে খুশি হয়েছে, তা বলে প্রকাশ করা যাবে না।

আলাপের ফাঁকে দীপু। ছবি: শামছুল হক রিপন, প্রিয়.কম

প্রিয়.কম: কীভাবে যাওয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে ?

আনিসুর রহমান দীপু: ২০১১ সালে ডাইভারসিটি ভিসা (ডিভি) পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার কাছে এটা একটা দুর্ভাগ্য ভিসা। কারণ আমি দেশের মিডিয়াটাকে মিস করি। এখানকার কাজগুলো মিস করি। মানুষের ভালোবাসাকে মিস করি। আর দেশে থাকলে চার পাশের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের তো কাছে পেতাম। এগুলোকে মিস করা হয়। তারপরেও অনেক সময় ভুলে থাকি। কারণ আমার মনে হয় বাংলাদেশের পরে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি ওখানে (নিউ ইয়র্ক)। আর সেখানে বাংলাদেশের কমিউনিটিও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অনেক সমৃদ্ধ। নিউ ইয়র্কে যখন কোনো প্রোগ্রাম হয় বা কনসার্ট হয় তখন এতো বাংলাদেশি দেখা যায় যে আপনি বিশ্বাসই করতে পারবেন না। বাংলাদেশি কমিউনিটির এলাকাগুলোতে যত দোকান দেখবেন, সব বাংলাদেশিদের। এ ছাড়া এখানে নানান ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান লেগেই আছে। এসব দেখে ওই সময় দেশ ছেড়ে থাকার অনুভূতিটা খুব একটা কাজ করে না। তখন ভালোই লাগে।

প্রিয়.কম: জানতে চাইব বিয়ে, পরিবার ও সন্তান সম্পর্কে?

আনিসুর রহমান দীপু: পলির (আমেনা রহমান পলি) সঙ্গে আমার বিয়ে হয় ২০০৫ সালে। আমাদের মেয়ের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর, তখন ওকে নিয়েই আমরা নিউ ইয়র্কে যাই। এখন ছোট ছেলেটার বয়স ৪ বছর। আর মেয়েটার বয়স এগারো বছর। ওখানকার একটা স্কুলেই পড়াশুনা করছে। ‘স্পেলিং বি’ নামে একটা বানানের প্রতিযোগিতা হয়। গত বছর (২০১৭ সাল) আন্তঃ নিউ ইয়র্কের ‘স্পেলিং বি’তে আমার মেয়ে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেছে। আমার ভালো লেগেছে এই ভেবে যে, বাংলাদেশ থেকে বাংলা ভাষা শিখে গিয়ে ওখানকার ‘স্পেলিং বি’তে ষষ্ঠ হয়েছে। আমি সব সময় চেষ্টা করি যাতে আমার বাচ্চারা বাংলা চর্চা করে। বাংলাদেশের ইতিহাস সাহিত্য নিয়েও যেন জ্ঞান অর্জন করে। আমাদের আশপাশের অন্যদেরকেও বলি যাতে, তারাও যেন বাংলা ভাষার বিষয়ে তাদের ছেলে মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করেন।

দীপু, তার স্ত্রী পলি ও সঙ্গে তাদের দুই ছেলে-মেয়ে। ছবি: সংগৃহীত

প্রিয়.কম: নাটক নিয়ে দেশের বাইরে কী ধরনের কাজ করছেন?

আনিসুর রহমান দীপু: যেহেতু অনেক বছর নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তাই নাটকের প্রতি একটা টান থেকেই যায়। ব্যক্তিগতভাবে লোক নাট্যদলের আমরা তিন বন্ধু নিউ ইয়র্কে একটি ব্যবসা করছি। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘৯৯ সেন্ট বেস্ট অ্যান্ড ফ্রেশ পিৎজা’। একে ডলার পিৎজা বলে। প্রতিষ্ঠানটির বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হল। এর ফাঁকে ফাঁকে আমরা ওখানে নাটকে বানাচ্ছি। এরমধ্যে পাঁচটি নাটক প্রচার হয়েছে। আরেকটা প্রচারের অপেক্ষায় আছে। আর এমনি, ওখানে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হয় সেগুলোতে উপস্থাপনা করছি। আমরা ভাবছি, এখনতো মঞ্চ-টেলিভিশনের অনেক শিল্পী নিউ ইয়র্কে চলে গেছেন। যেমন শিরীন বকুল আপা, খায়রুল ইসলাম পাখি ভাই, সুলতান বোখারি, টনি ডায়েস, রিচি সোলায়মানসহ আরও অনেকে। তো আমারা চাচ্ছিলাম ওনাদের নিয়ে একটা মঞ্চ নাটকের দল করার। এ নিয়ে কথা বার্তাও চলছে। আর এখানে নাটক বানানোর অনেকে থাকলেও, খরচটা অনেক বেশি। কারণ এখানের হিসেবটাতো ডলারে হয়। যা বাংলাদেশের চ্যানেলের জন্য বেশ ব্যয়বহুল। আর আমরা নাটক বানালেও তা প্রচার করব কোথায়? কিছুদিন আগে পাঁচটি নাটক বানিয়েছিলাম আমরা। যার চারটি নাটক শুধু একটা চ্যানেলেই প্রচার হয়েছে। বাকি কোনো চ্যানেলে আর প্রচার হয়নি। বাকি একটি প্রচারের অপেক্ষায় আছে। যদিও আমাদের এখানে এখন গুণী নাট্যকার, পরিচালক এবং অভিনয়শিল্পীরা আছেন। প্রবাসের শিল্পীরাও চান অভিনয়ে থাকতে। এর জন্য আসলে আরও সুযোগের প্রয়োজন।

প্রিয়.কম: আপনিতো লোকনাট্য দলের সক্রিয়কর্মী ছিলেন, দেশ বিদেশেও অনেক নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। তো সামনে মঞ্চ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

আনিসুর রহমান দীপু: (একটু কাশি দিয়ে) আমার আসার আগে নিউমোনিয়া হয়েছিল তাই কাশির প্রকোপটা রয়ে গেছে। আমি নিজেকে কখনোই সেলেব্রেটি মনে করি না। আর তারকা হওয়া লাগবে এসব ভেবে কখনো কাজ করিনি। শিল্পকে ভালোবাসি তাই এর সাথে থাকতে চাই। এই ভেবেই কাজ করা। তবে আমার কাছে মনে হয় টিভি পর্দায় কাজ করার চেয়ে মঞ্চে কাজ করা একটু বেশি কঠিন। কারণ এ সময় দর্শকের সঙ্গে আপনি সরাসরি থকাছেন। আর টেলিভিশনে অনেকবার টেক নিয়ে, কাট করে তারপর সবচেয়ে ভালো অংশ টুকুই দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয়। দেশের বাইরে বলতে, মঞ্চ নাটকে যখন অভিনয় করতাম তখন বেশ কয়েকটি দেশে নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়েছিলাম। বেশির ভাগই ছিল এশিয়ায়। তার মধ্যে ছিল কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড। শেষ ২০০৬ সালে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেম। চলতি বছরের অক্টোবরে সম্ভবত কানাডায় একটি নাটক প্রদর্শন করব। নিউ ইয়র্ক থেকে আমারা তিন বন্ধু আছি। যারা লোক নাট্যদলের সঙ্গে বহু আগ থেকেই যুক্ত ছিলাম। কানাডার একটি উৎসবে আমারা তিনজন অংশ নেব ও অভিনয়ও করব।

প্রিয়.কম: বিনোদনে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য, বর্তমানে বাংলাদেশের বিনোদন জগতের যারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন তারা কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?

আনিসুর রহমান দীপু: বর্তমানে যারা আছেন, অর্থাৎ আমরা সবাই মিলে আন্তর্জাতিকভাবে বড় কোনো বিট দেওয়ার মতো তেমন কিছু করিনি। সবাই এখানে এসে জীবন যুদ্ধে ব্যস্ত। আমরা কাজ করলে আমাদের ভাষায় আমাদের চ্যানেলে করতে পারি। ক্ষুদে গানরাজ নীলয় বিদেশি সিরিয়ালে অভিনয় করছে। নিউ ইয়র্কে আমাদের একজন ভাতিজি আছে। ও ওয়েস্টার্ন গানে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আমেরিকার একজন পপ সংগীতশিল্পী হিসেবে তার একটা পরিচিতিও হয়েছে। এদিকে যদি টনি ডায়েস ভাইয়ের মেয়ের কথা বলি। ওর নাম অহনা ডায়েস। ওর খুবই চমৎকার গলা। সে ওই ওয়েস্টার্ন ধাঁচের গানগুলো করছে। স্কুলভিত্তিক যে নাটকগুলো হয়, ও সেগুলো করছে। আমাদের অনেকেই আছেন যারা সেখাকার মিডিয়া স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করছেন। কেউ আবার ক্যামেরা বিষয়ে লেখাপড়া করছেন। তো ওরা যখন বড় হয়ে উঠবে তখন হয়তো আন্তর্জাতিকভাবে বিট করার মতো কিছু একটা হতে পারে। এখানে উল্লেখ করতে চাই বিশ্বের জনপ্রিয় এনিমেশন মুভি ফ্রোজেনে একজন বাংলাদেশি এনিমেটর পুরস্কৃত হয়েছেন।

প্রিয়.কম: বিনোদন সংশ্লিষ্ট অনেকের দাবি, প্রবাসী শিল্পীরা যখন বাংলাদেশে আসেন। তখন বিনোদন অঙ্গনে সময় দেওয়ার চেয়ে পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে ভালোবাসেন। কিন্তু অনেক ভক্তই আছেন যারা এখনো পর্দায় ওই শিল্পীদের অনুপস্থিতি অনুভব করেন।

আনিসুর রহমান দীপু: ‘প্রবাসী শিল্পীরা বিনোদন অঙ্গনে কম সময় দিতে চায়’ ব্যাপারটা আসলে কতোটা ঠিক, আমি বলতে পারছি না। আমার জানামতে অনেকেই দেশে এসে কাজ করেন। যদিও সংখ্যায় অনেক কম। আমি অল্প সময়ের জন্য এসে তিনটি নাটকের প্রস্তাব পাই যার সবই ঢাকার বাইরে শুটিং ছিল, গিয়ে থাকতে হতো। দীর্ঘদিন পর দেশে এলে পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব একটু সময় চায়। বলাতো যায় না, কার কখন কী হয়! আবার আসলে পাবেন কিনা! এরপর যদি বলি পরিবেশের কথা। বাংলাদেশ থেকে মিডিয়ার বিভিন্ন কাজে অনেকেই নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন। তো একবার কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তারা আমাকে বলেন, ‘দীপু ভাই, আপনিতো অনেক বছর ধরে পর্দায় নাই। এখনকার যে অবস্থা। এ অবস্থা দেখলে আপানি আর কাজ করতে পারতেন না।’ আমার মনে হয় আপনারাও জানেন। অথবা জানার কথা। এখন দেখা যাচ্ছে এই অঙ্গনে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা আসছেন। যারা কিনা এখানে আসেন শুধু ফুর্তি করার জন্য। তারা কিন্তু শিল্পের প্রতি ভালোবাসা কিংবা নাটক বানানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন না। তো আমার মনে হয় নাটক নির্মাণের জন্য এখন কিছু নিয়ম নীতিমালা তৈরি করা উচিত। এখানে অনেক ধরনের সংগঠন হচ্ছে, যেমন ডিরেক্টর গিল্ট, অভিনয় শিল্পী সংঘ, বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। কিন্তু তাদের বেশির ভাগের মধ্যেই কারো কোনো কমিটমেন্ট নাই। অনেকের মধ্যে জানার আগ্রহের চেয়ে ফান করার মনোভাবটা বেশি। তো এখানে অনেক নির্মাতাও যেমন ফান করা নিয়ে ব্যস্ত, প্রযোজকও ফান, অভিনয়শিল্পীদের ক্ষেত্রেও ফান। সংশ্লিষ্ট সাবাই যখন এমন ফান ফান নিয়ে ব্যস্ত। তখন তো নাটকের প্রাণ-ই চলে যায়। আমার মনে হয় ভালোমতো কাজ করলে নাটক এমনিতেই ভালো হবে। অভিনয়শিল্পী সংঘ থেকে নাটকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে কোনো কোর্স চালু করতে পারেন। পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাই। ন্যূনতম এই যোগ্যোতা থাকলেই সে পরিচালনা করতে পারবে। নাটক ভালো হলে, মানুষ নাটক দেখবে। চ্যানেলগুলো ভালো থাকবে, তারা বিজ্ঞাপন পাবে, টাকাও আসবে, এই শিল্পটাও ভালো থাকবে।

অভিনেতা দীপু। ছবি: শামছুল হক রিপন, প্রিয়.কম

প্রিয়.কম: আপনাদের সময়ে নাটক নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ কেমন ছিল, তখনকার মিডিয়া কেমন ছিল?

আনিসুর রহমান দীপু: আমার মনে আছে ছোটবেলার কথা। আমার বাবা ছিলেন একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি ছিলেন খুবই রাগী মানুষ। আমাদের এলাকায় যখন বিদ্যুৎ আসেনি তখন রেডিওতে নাটক শোনার জন্য তিনি আমাদের এক ঘণ্টার জন্য ছুটি দিতেন। আর তখন বিটিভিতে, সম্ভবত প্রতি সোম কিংবা মঙ্গলবার এক ঘণ্টার নাটক প্রচার হতো। তখনও তিনি ছুটি দিতেন। তো সেই সময় আমাদের দেশের নাটক দেখার জন্য ভারতের মানুষরাও সপ্তাহ ব্যাপী অপেক্ষা করতেন। যদি অনেক আগের বিটিভির কথা বলি, তখন কেউ অভিনয় করতে চাইলে তাকে একটা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারপর পর্দায় আসতে হতো। এখন আর এ বিষয়গুলো নজরে পড়ে না। এখন অনেকই আছেন যারা না জানেন অভিনয়, না আছে শিল্প সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান। কিন্তু অভিনয় না জেনেই রাতারাতি তারকা বনে যাচ্ছেন তারা। অভিনয়ের কাছে যাদের আসার যোগ্যতা নেই তারাই এখন নাটকে হুটহাট শুটিং করছে আর ফেসবুকে ছবি দিচ্ছে। এটাতো কোনো সাংস্কৃতিক চর্চা হতে পারে না। এটা যারা করছে তারা আসলে ফুর্তি করতেই আসে। একটা সময় ফুর্তি করেই চলে যায়। এদের দৌড় কিন্তু বেশি দূর যায় না। কিছুদিন পর এরা হারিয়ে যায়, দর্শক ভুলে যায় এদের। নাটকটাও তাদের এই ফুর্তির মধ্যেই থেকে যায়। সেই নাটক আর আমাদের দেশের বৃহৎ দর্শকের গ্রহণযোগ্যতাতে পৌঁছায় না। যে কারণে দর্শকরা বাধ্য হয়েই ভারতের নাটকগুলোই দেখেন। আর এদিকে দেশের নাট্য সংগঠনগুলো বিদেশি নাটক বন্ধের আন্দোলন করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এসব করে আসলে কোনোই লাভ হবে না। যদি না আমরা নৈতিকভাবে সেই ক্ষেত্রটা তৈরি না করতে পারি। এদিকে এখন দেখা যাচ্ছে অনেকে কালো টাকা সাদা করার জন্য নাটক প্রযোজনা করছেন। কেউবা আবার নায়িকাদের সঙ্গে দুপুরের খাবার কিংবা নৈশভোজে অংশ নেওয়ার জন্যও নাটক প্রযোজনা করছে। এটাতো কোনো সাংস্কৃতিক চর্চা হতে পারে না। কারণ ভেতরে শ্রদ্ধাবোধ ও শুদ্ধতা না থাকলে আপানার সৃষ্টি কীভাবে শুদ্ধ হবে? আমরা কিন্তু আমাদের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম।

প্রিয়.কম: নতুনদের মধ্যেও অনেকেই তো আপনাকে এখনো মনে রেখেছে ...

আনিসুর রহমান দীপু: হ্যাঁ, অনেকেই চেনেন আবার অনেকে মজার প্রশ্ন করেন। যেমন এরকম অনেকেই অনেকবার জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই, আপনার বাড়ি কি রংপুরে?’ যখন বলি, ‘না’। তখন আবার তারা বলেন, ‘ভাই মিথ্যে কথা বলেন কেন?’ আবার যখন একটু ভালো করে দেখেন, তখন বলেন, ‘ও আচ্ছা, আচ্ছা, আপনিতো অভিনয় করতেন’। এ ধরনের অনেক মজাই হয়। অভিনয়ের দীর্ঘ বিরতির জন্যই হয়তো এমন হয়। যেমন কালকে গেলাম গুলশানের একটা মার্কেটে। তখন একজন নারী এসে বললেন, ‘অনেকদিনতো টেলিভিশন দেখি না, তাই ঠিক নামটা বলতে পারছি না’। এই বলে তিনি চলে গেলেন। এরকম অনেক ছোট ছোট মজার ঘটানা ঘটে। নিউ ইয়র্কেও মাঝে মাঝে এমন ঘটে। কিছুদিন আগে সেখাকার একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলাম। তো সেখাকার সব নারী বিপণন বিক্রেতারা ছিলেন কৃষ্ণবর্ণের। তাদের মধ্যেই একজন ইংলিশে বলছিলেন, ‘চেনা চেনা লাগে’। আমাকেই যে বলছিল তা প্রথমে আমি খেয়াল করিনি। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বাংলাদেশি। তিনিও ছিলেন তাদের মতোই কালো। যে কারণে আমিও বুঝতে পারিনি, তিনি বাংলাদেশি। আমি সেখানে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলাম। তখন তিনি বাংলায় বলে ফেললেন, ‘ভাইয়া আপনাকেই বলছি। আপনি এদিক সেদিক কী দেখছেন?’ তখন আমিও বললাম, ‘আমি আসলে বুঝতে পারি নাই আপনি বাংলাদেশি।’ তার পর তিনি বললেন, ‘ভাইয়া আপনি কি শুটিংয়ে এসেছেন, নাকি এখানেই থাকেন?’ এতটুকুই আমার ভালো লাগে, কারণ মানুষ মনে রেখেছে। আর মানুষ তখনই মনে রাখে, যখন তার অভিনয়টুকু মানুষের ভালো লাগে। এই দীর্ঘ বছরে এইটুকুই আমার পাওয়া।

প্রিয় বিনোদন/গোরা