ছবি সংগৃহীত

হাইপোথার্মিয়ায় করুন মৃত্যু এবং মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের ব্যাখ্যাহীন প্রতিক্রিয়া

প্রিয় লাইফ
লেখক
প্রকাশিত: ০৭ জানুয়ারি ২০১৪, ১২:৫৭
আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৪, ১২:৫৭

বাংলাদেশে বেশি একটা ঠাণ্ডা পড়ে না বটে। শৈত্যপ্রবাহের কনকনে শীত সহ্য করতে না পেরে উত্তরাঞ্চলে মানুষ মারা যাবার ঘটনা ঘটলেও সব সময় তেমন ভয়ংকর শীত পড়ে না। শীতবস্ত্রের নিচে চাপা পড়ে থেকে কোনোমতে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু ভাবুন তো, যদি নিয়মিত বরফ পড়তো এই দেশে, তবে একের পর এক গরম কাপড় চাপা দিয়েও কি তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতো? যেসব দেশে বরফ পড়াটা স্বাভাবিক, সেসব দেশে হাইপোথার্মিয়ায় মৃত্যুর ব্যাপারটাও মানুষের কাছে পরিচিত। কী এই হাইপোথার্মিয়া এবং কী তার বৈশিষ্ট্য? হাইপথার্মিয়াকে রোগ না বলে বলা উচিত কন্ডিশন, যেখানে মানুষের শরীরের কেন্দ্রীয় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসেরও নিচে নেমে যায়। হাইপোথার্মিয়া শুরু হয়ে গেলে অবধারিতভাবেই মানুষটির শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে যায় আর সেই সাথে অনেকে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না। দিকভ্রান্ত হয়, হোঁচট খেতে থাকে এবং গতি ধীর হয়ে যায়। তাদেরকে দেখলে মনে হয় তারা মাতাল হয়ে আছেন, কথাবার্তা একটু জরিয়ে যেতে থাকে। তবে এটা হলো প্রথম পর্যায়ের লক্ষণ। পরবর্তী পর্যায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃৎস্পন্দন আশংকাজনক মাত্রায় কমে আসে, মানুষ জ্ঞান হারায় এবং মারা যায়। তবে জ্ঞান হারানোর আগে মানুষ এমন কিছু কাজ করে যার নিশ্চিত কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। মৃত্যুর আগে বেঁচে থাকার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে হয়ত এই কাজগুলো করে থাকেন তারা।

গর্ত খোঁড়া

এটা হয়তো অনেকের জানা থাকতে পারে যে কিছু প্রাণী শীতকালে গর্ত খোঁড়ে এবং তার মাঝে শীতনিদ্রা বা হাইবারনেট করে। তাদের শরীরের আশেপাশে চাপা এই গর্ত তাদের দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতে সাহায্য করে। হাইপোথার্মিয়ার চরম পর্যায়ে মানুষের মাঝেও এ ধরণের একটি উপসর্গ দেখা যায় যাকে বলা হয় Terminal Burrowing। ১৯৯৫ সালের এক গবেষণাপত্রে জার্মানির গবেষকেরা হাইপোথার্মিয়ার রোগীদের ব্যাপারে বর্ণনা করেন, “নিরাপত্তার চূড়ান্ত উপায় হিসেবে অনেককে বিছানার নিচে, ওয়ারড্রোবের পেছনে বা শেলফের ভেতরে ঢুকে যেতে দেখা যায়।” এই ব্যাপারে খুব বেশি গবেষণা হয়নি এবং এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের ধারনাও একেবারে পরিষ্কার নয়, কিন্তু এই জার্মান গবেষকদের মতে, “এটা মস্তিষ্কের একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া যা হাইপোথার্মিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে দেখা যায় এবং নিজের নিরাপত্তার জন্য গর্ত খোঁড়ার মতো আচরণ দেখা যায়।”

পোশাক খুলে ফেলা

খুব ঠাণ্ডা লাগলে আমরা কি করি? আরও একটা সোয়েটার পরি, গলায় মাফলার জড়াই বা অতিরিক্ত একটা কম্বল চাপা দেই শরীরের ওপর। হাইপোথার্মিয়া হলেও তো তেমনটাই করার কথা তাই না? কিন্তু মানুষ করে ঠিক তার উল্টোটা। চরম হাইপোথার্মিয়ার কিছু রোগীর মাঝে দেখা যায় শরীরের সব বা বেশিরভাগ পোশাক খুলে ফেলার প্রবণতা, যাতে তার শরীর থেকে আরও দ্রুত তাপ হারিয়ে যায় এবং মৃত্যু আসন্ন হয়। কি কারণে মানুষের মাঝে এই অদ্ভুত আচরণ দেখা যায়? হাইপোথার্মিয়ার কারণে শরীর থেকে উষ্ণতা হারিয়ে যায় এবং তা ঠেকাতে শরীরে “ভ্যাসোকন্সট্রিকশন” নামের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায় শরীরের রক্তনালীগুলো নিজে থেকেই সংকুচিত হয়ে যায়। কিন্তু ভ্যাসোকন্সট্রিকশনের জন্য দায়ী পেশিগুলো কিছু সময় পর দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে হঠাৎ করে শরীরে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং শরীর গরম মনে হয়। হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা এমনিতেই বিভ্রান্ত থাকেন। তার ওপর এমন একটি ঘটনায় তাদের মনে হয় তারা “হিট ফ্ল্যাশ” অনুভব করছেন এবং তারা নিজেদের পোশাক খুলে ফেলার চেষ্টা করেন।
এই পোশাক খুলে ফেলার ব্যাপারটা ঘটে থাকে গর্ত খোঁড়ার পর্যায়ের আগে। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা যায়, হাইপোথার্মিয়ায় মৃত ব্যক্তিরা পোশাক খুলে ফেলার পরে বরফের মাঝে গর্ত খোঁড়েন বা কোন চাপা জায়গায় লুকিয়ে যান, ফলে তাদের কনুই এবং হাঁটুতে কাটাছেঁড়া দেখা যায়।

হাইপোথার্মিয়া নাকি খুন?

ভেবে দেখুন, কোন চাপা জায়গায় লুকানো এবং নগ্ন একটি মৃতদেহ পাওয়া গেলো। স্বভাবতই পুলিশের প্রথম ধারনা হবে এই মানুষটিকে কেউ যৌন নির্যাতনের পর মেরে ফেলেছে। সে যে আসলে হাইপোথার্মিয়ার শিকার এবং নিজে থেকেই সে পোশাক খুলে, কোন চাপা জায়গায় গিয়ে লুকিয়েছে তা কেউ ধারনা করবে না।

হাইপোথার্মিয়া থেকে নিরাপদ থাকা

হাইপোথার্মিয়া শুধু ঠাণ্ডার কারনেই নয় বরং তার পাশাপাশি ড্রাগ বা অ্যালকোহল আসক্ত, বেশ অসুস্থ এবং পুষ্টি সমস্যায় ভুগতে থাকা মানুষের হতে পারে। খুব কম বয়সী বা খুব বৃদ্ধ মানুষের হাইপোথার্মিয়া বেশি হয়। খুব বেশি ঠাণ্ডায় ভালোমত শীতবস্ত্র পরে থাকা উচিত। বাতাস বইছে এমন সময়ে পানির আশেপাশে যাবেন না, জলো হাওয়ায় শরীর থেকে তাপ হারিয়ে যায় ২৫ গুন দ্রুত। অ্যালকোহল জাতিয় পানীয় থেকেও দূরে থাকুন, এটা শরীর ঠাণ্ডা করে ফেলে। হাইপোথার্মিয়া যে মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে তা বলাই বাহুল্য। যত দ্রুত সম্ভব এর চিকিৎসা নিতে হবে পেশাদার ডাক্তারের থেকে। ফার্স্ট এইড হিসেবে শুকনো, গরম কম্বল দিয়ে তাকে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে, সুস্থ কোন মানুষের শরীরের সংস্পর্শে থাকতে হবে এবং গরম, মিষ্টি ও নন-অ্যালকোহলিক কোন পানীয় খাওয়াতে হবে।