ছবি সংগৃহীত

প্রবাসে ইসলাম, প্রবাসীদের ইসলাম পালন

মুফতি রাশিদুল হক
লেখক
প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০১৬, ০২:৪৮
আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৬, ০২:৪৮

ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজনে মানুষকে প্রবাসে পাড়ি জমাতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণের মধ্যে এর প্রচলন তুলনামূলক একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয়। পৃথিবীর যে প্রান্তেই অবস্থান করুক না কেন ঈমান প্রতিটি মুসলমানের অমূল্য সম্পদ। ঈমান-ইসলামের অমূল্য সম্পদ যেন জীবন থাকতে হাতছাড়া না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ সজাগ দৃষ্টি রাখা সব মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনটা খুবই সংক্ষিপ্ত। আখেরাতে কতটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে- তাতে একটু গভীরভাবে ভেবে দেখলে শিউরে উঠতে হয়। প্রবাসের জীবনে যদি সে দেশের সব কিছু অর্জন করতে গিয়ে খোদাভীতি এবং আখেরাতের স্মরণটুকু খোয়া যায়, তাহলে আমরা হব পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যহত মানুষ। নিজেকে এমন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া এবং সন্তানদের ধর্মীয় অভবিষ্যতকে হুমকির সম্মুখিন করার চেয়ে দারিদ্র বহু গুণে ভালো। রাসূলুল্লাহ্ (স.) বলেন- যে ব্যক্তির মধ্যে তিনটি বিষয় বিদ্যমান সে পরিপূর্ণ মুমিন। তার একটি হল, কোনো মুসলমান কুফুরীতে প্রত্যাবর্তন করতে এরুপ ভয় পায়, যেমন কোনো মানুষকে বেধে জলন্ত আগুনে নিক্ষেপকালে সে ভীত হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- “বলুন, আমি কি তোমাদেরকে সেই সব লোকের সংবাদ দেব যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্থ। তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিভ্রান্ত হয়; অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে। ” (কাহাফ: ১০৩-১০৪) অনেকে মন্দকে মন্দ জেনে সে কাজে লিপ্ত থাকে। আরেক শ্রেণির মানুষ মন্দকে মন্দ ভাবার উপলব্ধিটুকু হারিয়ে ফেলে। অধিকন্তু নিজ কৃতকর্মকে সঠিক মনে করে আত্মপ্রবঞ্চণার শিকার হয়। শেষে আপন ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যেতে যেতে এক সময় নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। প্রবাসে সর্ব প্রকার উন্নতি ও অগ্রগতিতে ঈমানের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। দুনিয়া থেকে নিরাপদে ঈমান নিয়ে যেতে হবে এবং হাশরের দিন ঈমান নিয়ে উঠতে হবে। প্রবাসের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঈমান-আমল হেফাজত যেমন কঠিন, ঠিক এর প্রতিদানও ঢের বেশি। আমেরিকা বসবাস করে যে ব্যক্তি ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারবে এবং হাশরের দিন ঈমানসহ উঠবে তার প্রতিদান আরবের জমিনে ঈমান নিয়ে উত্থিত ব্যক্তির চেয়ে অধিক হবে ইনশাআল্লাহ্। কেননা সে গভীর অন্ধকারে নিজ ঈমানের জ্যোতির সংরক্ষণ করেছে। রাসূলুল্লাহ্ (স.) ইরশাদ করেন, আমার কিছু ভাই ঈমানের উপর অটল থাকবে এবং দ্বীনের পূর্ণ অনুসরণ করবে। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনার ভাই নই? জবাবে নবীজী (স:) ইরশাদ করলেন, তোমরা আমার সঙ্গী। আমার ভাই হল সে সব ব্যক্তিবর্গ যারা আমাকে দেখেনি। তারা অনেক পরে (দুনিয়াতে) আসবে। তারা গায়েবের (অদেখাবিষয়ের) উপর ঈমান আনবে। প্রবাস জীবনে সর্বদা নিজের নিয়ত সহীহ করার অনুশীলন অব্যহত রাখতে হবে। সব কাজ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করতে হবে। যশ-খ্যাতি, পদমর্যাদা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য যেন ভেতরে স্থান না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নিজ মেহনত ও যোগ্যতা অনুযায়ী জাগতিক উন্নতি তো সাধিত হবেই, তবে আমলের সওয়াব অর্জনের লক্ষে সর্বদা নিয়ত পরিশুদ্ধ রাখতে হবে। হাদীস শরীফে আছে- “প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া অর্জনের অথবা কোনো রমনীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য। ” (বুখারী শরীফ ১/১) ঈমান এবং ইহতেসাব এর প্রতি গুরত্ব প্রদান করতে হবে। তাহলে আমল ভারী হবে। আল্লাহ্ তাআলার অঙ্গিকারের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন এবং তার প্রতিদান ও সাওয়াব লাভের আশায় কর্ম সম্পাদন করাই হলো ঈমান ও ইহতেসাব। যে আমল ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে হয় আল্লাহ্ তাআলার কাছে সেই আমলের ওজন বেশি। নিজের ব্যাপারে কোনো ভাবেই উদাসীন হওয়া যাবে না। নিজ আমল ও ঈমানী অবস্থা যাচাই অব্যহত রাখতে হবে। নিজেই নিজের পরীক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে দু’ এক বছর পর পর নিজ দেশে গিয়ে সেখানে কিছু দিন অবস্থান করা ভালো। দেশীয় খোদাভীরু বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গের সাহচর্যে কিছু দিন অবস্থান করা যেতে পারে। যারা নির্লোভ, যাদের সাক্ষাতে আল্লাহর স্মরণ হয়, এমন লোকদের সঙ্গ গ্রহণ করা শ্রেয়। আমেরিকার মতো দেশে লাগাতার অবস্থান করার ফলে আল্লাহ তাআলার সাথে সুসম্পর্ক ও ঈমানী উন্নতির মূলধন হ্রাস পেতে পারে। যেমন একটি ব্যাটারী লাগাতার ব্যাবহারের ফলে এক সময় এর কার্যক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। পুনরায় তার নতুন সেল্স এর প্রয়োজন পড়ে। ঠিক তেমন নিজের আত্মার ব্যাটারীকে সর্বদা নতুন সেল দিতে থাকুন। দুই থেকে চার বছরের মধ্যে নিজ দেশে গমন করুন। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, যারা নিজ দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলে, ধর্মীয় ব্যাপারে তাদের প্রাপ্তিটা তুলনামূলক বেশি। প্রবাসে যথানিয়মে নামাজ রোজা ইত্যাদি আমল করাও কম নয়। তবে মতৃভূমির সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারীদের চোখে সাধারণত নিজ আমলের ত্রƒটিগুলো ধরা পড়ে না। আল্লাহ্ তাআলার প্রিয় বান্দাদের নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতসহ সার্বিক অবস্থার সাথে নিজের আমলের তুলনা করার সুযোগ হয়ে উঠে না। সর্বপরি ধর্মীয় বিষয়াবলীর মাপ-কাঠি নিজের সামনে উম্মোচিত হয় না। ধর্মীয় পরিবেশকে পাওয়ার হাউজ মনে করা উচিত। আল্লাহ্ তাআলার মেহেরবার্নীতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে এখনো দ্বীনী পরিবেশ বজায় রয়েছে। সেখানে এমন মানুষ রয়েছেন যাদের সাহচর্যে আত্মার মরিচা দূর হয়। ইংরেজী ভাষার পাশাপাশি দেশীয় ভাষায় অনেক ধর্মীয় বই পুস্তক এখানে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে মুসলিম দেশের উলামা কিরাম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষকবৃন্দ এদেশে আগমন করেন এবং আপনাদের সামনে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে থাকেন। তাদের প্রোগ্রামগুলোতেও গুরুত্বসহ অংশগ্রহণ করা উচিত। নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হলে প্রবাসেও নিজ ঈমান রক্ষা করা সহজ। তাই সঠিক সময়ে নামাজ আদায় করার ব্যাপারে বিশেষভাবে মনযোগী থাকতে হবে। আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর রা. একবার এই মর্মে ফরমান প্রেরণ করেন, আপনাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নামাজ। যে ব্যক্তি নামাজের বিষয়ে যত্নবান হবে সে সকল বিষয়ে যত্নবান হবে। পক্ষান্তরে যে নামাজের ব্যাপারে উদাসীন হবে এবং তা নষ্ট করবে, সে আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট রাখবে না। সুতরাং আপনারা নামাজ কায়েম করুন। কমৃস্থল, বাজার বা যেখানেই থাকুন না কেন ফরজ আদায় করুন এবং সুন্নাত আদায়ের ব্যাপারেও যত্নবান হোন। সুন্নাত ও নফল ফরজ নামাজকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। সর্বপরি স্বকীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি রক্ষার চেতনা নিজের মধ্যে জিইয়ে রাখতে হবে। স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এখানে নারী-পুরুষের একত্রে চলাফেরা তুলনামূলক অনেক বেশি। যথা সম্ভব নারী পুরুষের সম্মিলিত সমাবেশে যোগ দান করা থেতে বিরত থাকতে হবে। একান্তই যদি এমন সমাবেশ আয়োজনের প্রয়োজন পড়ে নারীদের জন্য স্বতন্ত্র স্থান নির্ধারণ ও উভের প্রবেশপথ ভিন্ন রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ইসলামী জীবনব্যবস্থা অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। হাদীস শরীফে নারী পুরুষের অবাধ চলাফেরার ব্যাপারে কঠিন বাণী এসেছে। ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও কৃষ্টি-কালচার রক্ষার্থে যত্নবান হতে হবে। এর সর্বত্তোম বৈশিষ্ট্য নিজ নিজ জীবনে প্রতিফলিত করতে সচেষ্ট হতে হবে। মুফতি রাশিদুল হক সিনিয়র মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব, নরাইবাগ ইসলামিয়া মাদরাসা, ঢাকা।