ছবি সংগৃহীত

ছোটলোক-বড়লোক

Shekhor.Seraj
লেখক
প্রকাশিত: ১৫ আগস্ট ২০১৩, ০৯:৫৭
আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০১৩, ০৯:৫৭

ছোটলোক-বড়লোক বলতে আদতে আমি বুঝি, মানব প্রেমের মনের দৈর্ঘ্য-প্রস্তের উদারতা কিংবা সংকীর্ণতার প্রকাশ। মানুষের অর্থ, প্রভ���ব পতি-পত্তি, সামাজিক পদ মর্যাদার তারতম্যের ভিত্তিতে অনেক মানুষেই ধনী কিংবা গরীব হতে পারেন। কিন্তু সবাই ছোটলোক-বড়লোক হতে পারেন না। অর্থ, প্রভাব পতি-পত্তি, সামাজিক পদ মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই আচার ব্যবহারে, মানসিকতায় অসভ্য, ইতর, তাঁকে হয়তো ধনী বলা যায়, কিন্তু কোনো মতেই তাঁকে বড়লোক বলা যায় না। এবং তিনিই হবেন সভ্য মানুষের মধ্যে স্মরণ-কালের অসভ্য, ইতর, ছোটলোক। আবার যে মানুষ অর্থ, প্রভাব পতি-পত্তি, সামাজিক পদ মর্যাদার তারতম্যের ভিত্তিতে গরীব বৈষম্য পীড়িত, কিন্তু আচার ব্যবহারে, মানসিকতায় সভ্য, তিনিই হবেন স্মরণ-কালের সভ্য সমাজে বড়লোক। বড়লোক-ছোটলোক, ধনী-গরীবের বিষয়টা আমি এমন দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়েই বিচার করি। আমি সবজান্তা শমশের নই, অন্যের চোখে, আমার দৃষ্টি ভঙ্গির বিচারের মধ্যে ভুল থাকতে পারে। ভুল-ক্রুটির মতাদর্শ নিয়েই মানুষ। কোনো মানুষেই শতভাগ ভাবে মানুষ হয় না। যিনি শতভাগ মানুষ রূপে নিজেকে দাবী করেন, তিনি হবেন শয়তান, নয়তো ঈশ্বর। শয়তান এবং ঈশ্বরের মাঝামাঝি মানুষ। টক, ঝাল, মিষ্টির মত। ভালো- মন্দ দুটো মিলিয়ে মানুষ।( ভালো-মন্দ আপেক্ষিক, একদেশের গালি, অন্য দেশের বুলি)। মানুষের ক্ষেত্রে মন্দটাকে বাদ দিয়ে, জীবনের ইতিবাচক ভালো চিন্তা চেতনার চর্চা করলে প্রাপ্তিটা তাঁর চরিত্রে তাৎক্ষনিক প্রকাশ পায়। এবং ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। আমার কথাকে আদেশ উপদেশ হিসাবে নেওয়ার প্রয়োজন নাই। এই কাজ`টা একদমেই পছন্দ করি না। আমি কারও জীবনের পথ প্রদর্শক নই। আমি নিজেই চির অন্ধকারের মানুষ, রোজ সকালে, দাঁত ব্রাশ করতে করতে বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়ালে। তখন, নিজের কাছে নিজেকেই অসভ্য, ইতর, ছোটলোক মনে হয়, ঘৃণা লাগে। নিজেকে চির অন্ধকার গুহার মধ্যে রেখে, অন্যকে আদেশ, উপদেশ দেওয়া হচ্ছে ঐশ্বরিক হঠকারিতা। নিজের সম্পর্কে যার এমন ধারনা, সে কী আর মানুষকে আদেশ, উপদেশ দিতে পারে? আমার বোধগম্য নয়। ধনী হতে পেরেছি কিনা জানি না। কখনো জাবেদা, খতিয়ানের হিসাব কষে দেখি নাই, কিন্তু বড়লোক যে এখনো হয়ে উঠতে পারি নাই, তা শতভাগ হলফ করে বলতে পারি। যে সমাজে জ্ঞানের সাথে ধনের যোগ নাই। সচ্ছলতার প্রবৃদ্ধির সাথে আত্ম উন্নয়নের উৎকর্ষতা নাই, সে সমাজে অর্থের বিনিময় বাঘিনীর দুধ মিলে গেলেও, একজন বড়লোক মানুষ পাওয়া যাবে না। বরং ধনী পাওয়া যাবে গণ্ডায় গণ্ডায়। ছোটলোক, ইতর, অসভ্য পাওয়া যাবে লাখে, লাখে। কিন্তু বড়লোক? বামন হয়ে আকাশের চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর মত। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ থেকে চাঁদের দূরত্ব কতটুকু? নিজের শরীরের সাথে মনের দূরত্ব আমাদের আরও বেশি। জীবনের আত্ম উন্নয়নে আমরা এগিয়ে যাওয়ার বদলে, মন মানসিকতা চিন্তা চেতনায় ধর্মীয় গোঁড়ামি আর রক্ষণশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর রক্ষণশীলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার নাম কী উন্নয়ন? আসল রেখে, নকলের পিছে দৌড়ানো এখন আমাদের সামাজিক পদ মর্যাদা, বিলাসিতা। হঠাৎ করে, আলাদীনের আশ্চর্য সেই যাদুর চেরাগের মত, ছলে, বলে কৌশলে, লোক ঠকিয়ে রাতারাতি সবাই আমরা আঙ্গুল ফুলে (ধনী)কলা গাছ হতে চাচ্ছি, কিন্তু বড়লোক হতে চাচ্ছি না আমরা কেউই। ধনী হতে বুদ্ধি, কু-বুদ্ধি দুটোই লাগে, বড়লোক হতে লাগে বিবেক, আর যুক্তি-বোধ। বিবেক আর যুক্তি-বোধকে মেরে বুদ্ধির অপ-প্রয়োগ আমাদেরকে প্রতিনিয়ত করে তুলছে আগ্রাসী, হিংস্র, ইতর, অসভ্য, ছোটলোক। পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতে খেতে আমরা আচার ব্যবহারে মানসিকতায় আর কত ছোটলোকের পরিচয় দেবো? তবে কী আমাদের অর্জিত শিক্ষা, নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ সবেই ভুঁইফোঁড় আষাঢ়ে গল্প? আমাদের গর্ব করার মত আছে, মহান ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, আছে অনুসরণ করার মত যথেষ্ট আদর্শবান নেতা। যে জাতির অতীত ইতিহাস এত গর্বের, সে জাতি সত্তার শিক্ষা, নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ এতটা অধঃপতন হয় কী করে? দেশ ছেড়েছি এক যুগেরও বেশি সময়, এর মধ্যে দেশে অনেক উন্নয়ন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে, কতটা দেশের চালচিত্র, রাজনৈতিক পরিবর্তন, উন্নয়ন হয়েছে সেই বিচার বিবেচনায় যাচ্ছি না। তা করতে গেলে, কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মত বিশাল এক নিবন্ধন হয়ে যাবে। সেই সাহস দেখানোর মত ধৃষ্টতা, আমার নেই। আমি ছাপোষা মান্দার গাছের কেরানি, মূক, বধির, অক্ষম। তবে দুর-প্রবাস থেকে মাঝে মধ্যেই পত্র-পত্রিকার এমন সব খবর পড়ে আঁতকে উঠেছি, নিজের চোখ, কানকে বিশ্বাস করতে পারি নাই। দুর-প্রবাসে থেকেও মনে হয়, নিজের দেশটা আর নিজের নাই, চর দখলের মত করে, কারা যেন রাতারাতি দখল করে নিয়েছে। ফিরে গেলে হয়ত সিকি পরিমাণ মাটিও আর উদ্ধার করতে পারব না। বলতে পারব না, এই মাটিতে আমার পিতামহ, আমার পিতার রক্ত মাংসের হাড় মিশে আছে। আমার দুরন্ত ডানপিঠের শৈশব, কৈশোরের সোনালী দিনের গুপ্তধন লুকিয়ে আছে। হয়তো লাঠি হাতে রাস্তার নেড়ি কুকুরের মত ধেয় ধেয় করে তাড়া করবে, গলা ধাক্কা দেবে। অস্ত্রের মহড়া দিয়ে রাবণের বীর পুরুষত্ব দেখাতে আসবে। যখন এইসব সাত-পাঁচ ভাবি, দেশে যাবার ইচ্ছে কূ-পুরের মত বাতাসে উবে যায়। মাঝে মধ্যে ধাঁধাঁয় পড়ে যাই, নিজের জীবন বেশি প্রিয়, নাকি প্রিয় মাতৃভূমি? আমি কাপুরুষ, আত্মকেন্দ্রিক, পলায়নপরতা সময় সময় সাপের বিষের যন্ত্রণার মত লাগে। স্বার্থপরের মত ভুলে যাই, সব। এখনো কানের মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পাই, যেদিন প্রথম বিমানে উঠি মা, বলছিল- দেখিস বিমানে উঠে আবার বেঈমান হয়ে যাসনি`। বিমানে উঠলে মানুষ কি আসলেই বেঈমান হয়ে যায়? মাস শেষে ঠিকেই বেতন থেকে আদরের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি। জাতীয় চলমান অর্থনীতি কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে পেরেছি। সেই দেশটাই নাকি এখন আমার না। নিজের দেশের উপর কোনো অধিকার থাকবে না? নিজের দেশে ফিরে যেতে আমি এখন ভয় পাই। দেশে যাবার কথা শুনলে মা, টেলিফোনে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। বলে, যেখানে আছিস, যেমন আছিস, ভালো আছিস। জানবো তুই বেচে আছিস। শুধু দেশে ফেরার কথা বলিস না। জামাতিরা, তোকে পেলে (মৃত) ব্লগার ``রাজীব হায়দায়ের`` মত তোকেও জবাই করে দেবে। ব্লগার ``আসিফ মহিউদ্দীনের`` মত তোকেও জেলে ভরে রাখবে। আমি মা`কে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, মা- আমি ওদের মত বিখ্যাত কেউ না। আমাকে আর ক`জন মানুষ চেনে? দেশের একটু আলো, বাতাস শরীরে না লাগলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমিও যে, বিদেশ নামক এক অদৃশ্য পাচিল ঘেরা ঘরের কয়েদী। মা, তবুও রাজি হয় না। দীর্ঘশ্বাস, দুপুরের রোদের মত লম্বা হয়। টেলিফোনের ওপাশে মা কাঁদে, এ পাশে আমি কাঁদি। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে টেলিফোন রেখে দেই। জামাতের ভয়ে আমি আমার নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবো না? জামাতের ভয়ে আমি আমার সন্তানের মুখ দেখতে পারবো না? চোখের সামনে ``তসলিমা নাসরীনের`` নির্বাসন দেখেছিলাম। সেই নির্বাসন যে, একদিন আমারও সাধ, স্বপ্নকে রাহু-গ্রাস করবে, তা কী আমি জানতাম? দেশে যাই না, আজ কত বছর? এমন দিন দেখার জন্যই কী এদেশটা স্বাধীন হয়েছিল? রাবণের বীর পুরুষেরা যদি ওদের নিজেদের দর্শনের কথা বলতে পারে, বিলি প্রচার করতে পারে? তবে কেনো নাস্তিক (মৃত) ব্লগার ``রাজীব হায়দার, ``আসিফ মহিউদ্দীন`` ``তসলিমা নাসরীন`` নিজেদের বিশ্বাসের কথা বলতে গেলে তা অপরাধ হতে যাবে কেনো? এটা কী কোনো স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের চরিত্র হতে পারে? ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা টিপে যারা বাকরুদ্ধ করতে চায়, তাঁরা আর যাই হোক-গণতন্ত্র প্রেমী নয়। চরম ছোটলোক, অসভ্য, ইতর। স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন কখনো কখনো কঠিন বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যায়, মনকে প্রবোধ দেই। নিজের শৈশব-কৈশোরের যে মাটির আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছি, সে দেশটা এমন ছিল না, সে দেশের মানুষ`গুলো এমন, নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ, আবেগ-বিবেক বিবর্জিত ছিল না। যেখানে, বিজ্ঞানীরা আজ রোবট যন্ত্রকে মানুষের আদলে আবেগ অনুভূতি দেওয়ার জন্য, আদা-জল খেয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। সেখানে, মানুষ কেনো নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ, আবেগ-বিবেক প্রতিমা দুর্গার মত গঙ্গা জলে বিসর্জন দিতে চাইছে? সবটাই কী ব্যক্তির নিজের আরাম আয়েশ? মুক্তবাজার ভোগবাদীর চাহিদা? ক্ষমতা, লোভ, কাম, ঈর্ষা? নাম, যশ, খ্যাতির সাথে স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা? সামাজিক পদ মর্যাদা? বোধ করি, তাঁর বিবিধ কারণ, সমাজ বিশ্লেষক`রা আমার চেয়ে আরও ভালো করে বলতে পারবেন। আমি যা বলতে পারি, তা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে, তাঁর থেকে বেশি দুর গড়িয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার জ্ঞানের দৌড়, মোল্লার দৌড়ের মসজিদের চেয়ে বেশি না। বেশি বলতে গেলে, ছোট মুখে, বড় কথা বলা হবে। তবুও নির্লজ্জ বেহায়ার মত বলতে হবে। না বললে, নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ ভেবে, একদিন ক্ষমতা, লোভ, কাম, ঈর্ষা, নাম, যশ, খ্যাতির সাথে স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা, আমার ঘাড় মটকিয়ে দেবে না, তাঁর নিশ্চয়তা কী? কাঁচা অর্থের প্রলোভন খুব খারাপ জিনিস। মানুষের বোধ, বুদ্ধি, নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ, আবেগ-বিবেক সব পশুর স্তরে নামিয়ে দেয়। তখন মানুষে আর পশুতে কী পার্থক্য থাকে? নিজেকে দিয়ে বুঝি, সমাজ সংসারের যাপিত মানুষের জীবন দিয়ে বুঝি। মানুষ আসলে তাঁর ভেতরে মনুষ্যত্ব লালন করার চেয়ে পশুত্ব লালন করে বেশি। চোর, ডাকাত, ধর্ষক, মুচি, মেথর, চামার যা করে সবটাই সত্য করে। কোনো রাখঢাকের বালাই নাই। কিন্তু ধনী ভদ্রলোক নামধারীরা করে, মুখোশ পড়ে। কী বিশ্বাস হচ্ছে না, স্কুল, কলেজে যাও, মাদ্রাসায় যাও, ব্যাংকে যাও, থানায় যাও, আদালতে যাও, চাকরীতে যাও, দশ জনকে জিজ্ঞেস করো, জীবন সম্পর্কে তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতা কী? আমি শতভাগ নিশ্চিত যা শুনবে, তাতে ভূত দেখার মত করে রীতিমত শরীরের লোম কুপ দাঁড়িয়ে যাবে, পচে যাওয়া মৃত শরীর দেখার মত করে তোমার জীবিত শরীরে ঘৃণায় ঘিন ঘিন করে উঠবে। আপাদমস্তক মানুষ সম্পর্কে তোমার ধারনা পাল্টে যাবে। ঐ ধনী ভদ্রলোক নামধারীরাই এক একটা প্রকৃত চোর, ডাকাত, ধর্ষক, মুচি, মেথর, চামার, ছোটলোক। চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ করার ক্ষেত্রে এইসব ছোট লোকেরা বেশ কৌসুলি, অভিজ্ঞ। দেশের প্রচলিত আইন, নিয়ম, সংবিধান সব ওদের নাকের ডগায় তেল দিয়ে ঘুমায়। মুখ খুলবে, তো বিপরীতে ফেঁসে যাবে, প্রতারণা না করেও কাউকে প্রতারক বানিয়ে দেওয়াটা ওদের চরম অসভ্যতা, ইতরামি। অসভ্যতা, ইতরামি করাটাকেই ওরা ব্যক্তিত্ব মনে করে। প্রভু ভুক্ত কুকুরের মত ওদের চোখেও হায়া, লজ্জা শরমের আব্রু নাই, বিষণ তেলবাজ। বাঙ্গালীর আর কিছু পছন্দ না হলেও, তেল জিনিসটা খুব প্রিয়, ঘরে বাইরে সর্বত্র। আমি তাঁর ঠিক বিপরীত, তেল জিনিসটা সহজে কাউকে দিতে পারি না, তেমনি নিতেও পারি না। তাঁর থেকে স্পষ্ট কথা বলি, ঠোট কাটা স্বভাব। বন্ধু, আত্মীয় স্বজন গোলাপ ভেবে না, গোলাপের কাটা ভেবে, আমকে দেখে রাস্তা বদল করে, পালিয়ে যায়। সেই আমি পালিয়ে গেলাম দেশ থেকে, দেশের মানুষের কাছ থেকে, বন্ধু, আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে। দেশের বাইরে আছি, কিন্তু মানুষের সমাজের আর বাইরে যেতে পারলাম না। কত রকমের মানুষ, কত বিচিত্র তিক্ত অভিজ্ঞতা। মাঝে মধ্যে খৈয় হাড়িয়ে ফেলি, তখন মানুষের কাছ থেকে দুরে সরে যাই। মানুষের সহচর আর ভাল লাগে না, ফেইসবুক, টুইটার, মোবাইল থেকে নিজেকে খেয়ে ফেলি। কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না। তাঁর থেকে বরং ইচ্ছে করে জঙ্গলে চলে যাই। ঐ যে বলে না, আপনের চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে জঙ্গল ভালো। অনেক দেখলাম, বুঝলাম। এবার ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাছি। ক্ষমতা পেলে নিজের বাড়ির দরোজার কুকুরও ঘেউ ঘেউ করে। ক্ষমতার অনৈতিক সুযোগের সদ ব্যবহার এদেশে অফিসের পিয়ন থেকে প্রধানমন্ত্রী সবাই করে, সৎ যোগ্য মানুষের মেধার মূল্যয়ান এদেশে ক`জন করে? পারলে, ভিটে মাটি সহ চৌদ্দ গোষ্ঠীর পিণ্ডি উদ্ধার করে, দেশ ছাড়া করে। শুধু একটা দেশ নয়, গোটা পৃথিবীটা ওদের নামে নিঃশর্ত লিখে দাও, তবুও ঐ ভদ্রলোক নামধারী, মুখোশ পড়া চোর, ডাকাত, ধর্ষক, মুচি, মেথর, চামার, ছোটলোক`দের ভাগে কম পড়বে। তখন বলবে, আমার মঙ্গল গ্রহ চাই, মঙ্গল গ্রহ হাতে পেলে হয়তো বলে বসবে, আমার গোটা সৌরজগত চাই। অবাক, বিস্ময় প্রকাশ করার মত কিছু নেই। ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের চাহিদার শেষ নেই। সে যত পাবে, তত নেবে, নৈতিক, অনৈতিক বোধ বুদ্ধির বিচারের সময় জ্ঞান পরকালের জন্য বন্ধক থাকল। তাঁর জন্য তো ঐশ্বরিক আসমানি কিতাব সর্বস্ব পুস্তক পৃথিবীতে বিদ্যমান। নগদ নিয়েই যখন ঐ চোর, ডাকাত, ধর্ষক, মুচি, মেথর, চামার, ছোটলোক`দের কাজ কারবার, তখন ঐ ঐশ্বরিক আসমানি কিতাব সর্বস্ব পুস্তকের প্রয়োজনীয়তা কী? আজও আমার বোধগম্য নয়। ভোগ বিলাসে, অস্তিত্ববাদী হয়ে মানুষ কী করে এমন অস্তিত্বহীন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে? ভণ্ড প্রতারক, আত্ম প্রবঞ্চক আর কাকে বলে? যে নিজের বিশ্বাসের সাথে প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্ত যে বিশ্বাস ঘাতক। সে কী করে মানুষের কল্যাণ করতে পারে? মুখে মধু অন্তরে বিষ রেখে কোনো মহৎ কাজেই সম্পূর্ণ হয় না। এক সময় না এক সময় তাসের ঘরের মত, তা ভেস্তে যায়। বরং তোমার কাল্পনিক বিশ্বাসের চেয়ে প্রকৃতিকে আরও বেশি বিশ্বাস করা যায়। কারণ, প্রকৃতি চলে পদার্থ বিজ্ঞানের নিরস নিজস্ব নিয়ম অনুসারে, তাতে ঈশ্বরের যেমন কোনো লাল সালু কাপড়ের কেরামতি নাই। তেমনি তাতে তোমার, আমারও কোনো হাতের যাদুকরী স্পর্শ নেই, যে শিশু মায়ের জরায়ু থেকে একবার বেরিয়ে গেছে, তাঁকে তুমি কোনো অবস্থাতেই মায়ের জরায়ুতে পুনরায় ফেরত পাঠাতে পারো না। প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে তুমি, আমি, আমরা এমন কেউ ক্ষমতাধর মানুষ নই। যদি প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই না পারলে, তবে প্রকৃতি ধ্বংস করার অধিকারও তোমার নাই। তুমি নিজে মরো, প্রায়-চিত্ত করো, ভালো কথা। অন্য দশ জনকে মারার অধিকার কোন হরি-দাস পাল তোমাকে দিয়েছে? তবুও, কেনো মানুষের এত ক্ষমতা, লোভ, কাম, ঈর্ষা, নাম, যশ, খ্যাতির মিথ্যে আস্ফালন? আমি বুঝি না। ক`দিন বাচে মানুষ? কচ্ছপের মত তিন`শ বছর আয়ু নিয়ে তো মানুষ জন্ম গ্রহণ করেনি। তবে? সময়ে গতির সাথে মানুষের গড় আয়ুর সম্পর্ক। মানুষ যদি, পৃথিবীর বাসিন্দা না হয়ে, সূর্য থেকে দূরবর্তী কোনো গ্রহের বাসিন্দা হত। এবং সেই গ্রহের ঘূর্ণন গতি যতি হাজার ঘণ্টার উপরে দিন-রাতের পার্থক্য হত, তবে তো মানুষের পৃথিবীর গড় আয়ু ষাট থেকে এক লাফে ষাট হাজার বছর হয়ে যেত। তা না হলেও বুঝতাম, ঐ সব ক্ষমতা, লোভ, কাম, ঈর্ষা, নাম, যশ, খ্যাতির আস্ফালন করার একটা মানে থাকত। একটা মাত্র মানুষের বাস যোগ্য পৃথিবী, সেখানেও অর্থ, নীতি, বিধি নিষেধের শর্ত রোপিত করে মানুষকে জীবন ধারণের ব্যয় নির্বাহ করতে হবে কেনো? প্রকৃতি ধ্বংস করতে হবে কেনো? ক্ষমতা, লোভ, কাম, ঈর্ষা, যশ, খ্যাতির বিরম্ভনার নাম সভ্য হওয়া নয়। চরম অসভ্যতা, মানুষের চরম নির্বুদ্ধিতা। আর এই চরম অসভ্য এবং নির্বুদ্ধিতায় পৃথিবী ধ্বংসের কাছাকাছি মানুষকে পৌঁছে দেবে। প্রকৃতিকে, প্রকৃতি কখনো ধ্বংস করে না, ধ্বংস করে মানুষ। ক্ষমতা, লোভ, কাম, ঈর্ষা, নাম, যশ, খ্যাতির সাথে স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার, তোমার এইযে আত্মঘাতী প্রবণতার প্রায়-চিত্তের ভোগ, তা তুমি শুধু একা করবে না। সাথে ভোগ করবে, হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ। অন্যকে বঞ্চিত করে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ব্যক্তি স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করার অধিকার প্রকৃতি তোমাকে দেয়নি। সূর্যের আলো পৃথিবীতে তোমার একার জন্য আসে? রাতের অমাবস্যা পূর্ণিমা তোমার একার জন্য আসে? জানি, সে উত্তর তোমার জানা নেই। জানার জন্য, তোমাকে ধনী হবার আগে বড়লোক হতে হবে, বড় মনের মানুষ হতে হবে। মানুষের জীবন নিয়ে অসভ্য, ইতর, ছোটলোক হয়ে বেচে থেকো না। মুসলমান, হিন্দু,.... বাঙ্গালী...অমুক-তমুক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, উকিল, সম্পাদক, ডাক্তার, ব্যাংকার, হওয়ার আগে অন্তত একবার বড়লোক হও, মনের আয়নায় দেখবে, দেশ, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, ধনী-গরিব, ছোটলোক-বড়লোক ..অমুক-তমুক, সব অন্তর সার শূন্য, সবার আগে মানুষ সত্য, মানবতা সত্য।