ছবি সংগৃহীত

কিতাবুল ইমান : প্রবন্ধ নং- ৫৮ : কাফের কখন মুমিন হয়

priyo.Islam
লেখক
প্রকাশিত: ০৫ মার্চ ২০১৪, ১৫:৫৪
আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৪, ১৫:৫৪

কাফের কখন মুমিন হয়

পেছনের প্রবন্ধগুলোয় আমরা জানতে পেরেছি, একজন মুমিন কি কি বিষয় স্বীকার করে নেবে, যা কখনো অস্বীকার করবে না। ঈমানের হাকিকত অধ্যায়ে আমরা দেখিয়েছি ঈমান অভিধার ব্যাপ্তি কি এবং ঈমানের বিষয়বস্ত্তগুলো এর সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হয়। আগত প্রবন্ধগুলোয় আমরা দেখাব কি কি বিষয় ঈমানকে নস্যাৎ করে দেয় এবং একজন ব্যক্তিকে মুমিনদের দল থেকে বের করে কাফেরদের দলভুক্ত করে ফেলে। তবে এ বিষয়টির বর্ণনা আলাদা একটি অধ্যায়ের দাবি করে যা পরবর্তী অধ্যায়ের মুখবন্ধ হিসেবে কাজ করবে। অর্থাৎ যেখানে ঈমান ও ইসলামের সীমানা নির্ধারণ করা হবে। যে সীমানার অভ্যন্তরে অবস্থানকারীকে মুমিন ও মুসলিম খেতাবে ভূষিত করা হবে। আর যে এর বাইরে অবস্থান করবে তাকে কাফের-ঈমানহারা বলে আখ্যায়িত করা হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তার ওপর কাফের ব্যক্তি-বিষয়ক হুকুএ আহকাম বাস্তবায়িত করা হবে, যদি সে ঈমানের গন্ডিতে প্রবেশ না করেই কাফের অবস্থায়-ই মারা যায়। ভূমিকাতুল্য এ অধ্যায়টি এ জন্য প্রয়োজন যে, এর মাধ্যমে আমরা ঈমানের গন্ডি ও কুফরের গন্ডি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে পারব, যাতে পরবর্তী অধ্যায়ে, কি কি বিষয় একজন মানুষকে ঈমানের গন্ডি থেকে কুফরের গন্ডিতে নিয়ে যায়, বুঝা সহজ হয়ে যায়। অতএব এ পর্বটি দু-অধ্যায়ে বিভক্ত করা হলো, প্রথম অধ্যায়টি দ্বিতীয়টির মুখবন্ধস্বরূপ। অধ্যায় দুটি হলো, প্রথম অধ্যায়, একজন কাফের কখন মুমিন হয় (অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশের পদ্ধতি) দ্বিতীয় অধ্যায়, একজন মুমিন কখন কাফের হয় (অর্থাৎ ঈমান নস্যাৎকারী বিষয়সমূহ) কাফের কখন মুমিন হয় বিগত পর্বে আমরা জানতে পেরেছি যে ঈমানের স্তম্ভসমূহের জ্ঞান দু-পর্যায়ের, একটি অবিশ্লিষ্ট বা এজমালি, আরেকটি বিশ্লিষ্ট বা তাফসীলি। আবার প্রতিটি স্তম্ভেরই অবিশ্লিষ্ট ও বিশ্লিষ্ট আকার রয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি ঈমানের স্তম্ভসমূহ বিস্তারিতভাবে জানবে, তাতে বিশ্বাসপোষণ করবে এবং তার দাবি অনুযায়ী আমল করবে সে ওই লোকদের মধ্যে শামিল হবে যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ ‘তারাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট উচ্চ মর্যাদাসমূহ এবং ক্ষমা ও সম্মানজনক রিয্ক’-(সূরা আল আনফাল, ৪)। তবে আল্লাহ তাআলার মহাপ্রজ্ঞা অনুযায়ী তিনি ঈমান গ্রহণের বিষয়টি বান্দাদের ওপর সহজ করে দিয়েছেন এবং অবিশ্লিষ্ট আকারে ঈমান আনলেই - যার মধ্যে সংকোচিত আকারে বিস্তারিত ঈমানও প্রবিষ্ট রয়েছে- তিনি একজন মানুষকে মুমিন হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দিয়েছেন। অতঃপর তিনি একজন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে যেটুকু ঈমান কবুল করে নেন, তা হলো জিহবা ও অন্তর দ্বারা এ কথা স্বীকার করে নেয়া যে, একমাত্র আল্লাহ তাআলাই তার রব ও সত্য মাবুদ। তিনি ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই, ইলাহ নেই। এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসুল এবং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা-কিছু নিয়ে এসেছেন তার সবই সত্য এবং তদনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। তিনি এই অবিশ্লিষ্ট ঈমানের একটা শিরোনাম দিয়েছেন। আর তা হলো কালেমায়ে তাইয়েবা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। অতএব যে ব্যক্তি এ কালেমা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবে এবং তা অন্তর দিয়ে সত্য বলে জানবে, এর পাশাপাশি ওইসব কাজ, কথা ও বিশ্বাস পরিত্যাগ করবে যা তার উক্ত স্বীকারোক্তি নস্যাৎ করে দেয়, তবে সে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ এবং কুফরি পরিত্যাগ করেছে বলে ধরা হবে। [প্রশ্ন হতে পারে- সহিহ হাদীসে ঈমানের স্তম্ভসমূহের যে বর্ণনা এসেছে, তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান ছাড়াও অন্যান্য বিষয়কে শামিল করে। তাহলে শুধু শাহাদাতাইন দ্বারা কীভাবে ঈমানের বলয়ে প্রবেশ করা সম্ভব হবে? এর জবাব হলো- ঈমান মূলত দু-প্রকার। ঈমানে মুজমাল ও ঈমানে মুফাস্সাল। ঈমানে মুজমাল হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যা-কিছু এসেছে তার প্রতি ঈমান- তিনি কি কি নিয়ে এসেছেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু না বলেই। সে হিসেবে একজন বান্দা যখন এ সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহর ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর রাসূল, তখন সে প্রকারান্তরে, মুহাম্মাদ (সা.) যা-কিছু নিয়ে এসেছেন, ঈমান ও ইসলামের স্তম্ভ হিসেবে যা-কিছু তিনি বলেছেন, সব কিছুকেই সত্য বলে জানার ঘোষণা দেয়, যদিও সে তা বিস্তারিতভাবে জানেনা; কেননা সে যে-শাহাদতাইনের ঘোষণা দিয়েছে, তার দাবি হলো- যখন তার কাছে এমন কোনো বিষয় পৌঁছবে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন তখন সে সঙ্গে সঙ্গে তা সত্য বলে মেনে নেবে, তার প্রতি ঈমান আনবে। আর যে ব্যক্তির কাছে ইতোমধ্যেই সব কিছু বিস্তারিতভাবে পৌঁছেছে, অতঃপর সে তার প্রতি ঈমান এনেছে, এবং সে অনুযায়ী আমল করে যাচ্ছে এ ব্যক্তি অবশ্যই অধিক শাক্তিশালী ঈমানওয়ালা এবং আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান বলে বিবেচিত। আর যদি এমন হয় যে, কোনো ব্যক্তি ঈমানে মুজমাল ঘোষণা করল ঠিকই, কিন্তু যখন তার কাছে এমন কোনো বিষয় এল, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন, তখন সে তা প্রত্যাখ্যান করল, তা হলে সে শাহাদাতাইনের দাবির বিরুদ্ধে গেল, অতঃপর মুরতাদ হয়ে গেল। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরে আসছে। দেখুন: ইবনে তাইমিয়া, আল ফুরকান বাইনা আওলিয়াইর রাহমান ওয়া আওলিয়াইশ শায়তান পৃ.৫১০] উল্লিখিত মূলনীতির দলিল ঈমানে মুজ্মাল আকারে ঈমানের বিষয়গুলো স্বীকার করে নেয়া অর্থাৎ মুখে শাহাদাতাইন উচ্চারণ করা ও অন্তরে তা সত্য বলে জানা, কেবল এতটুকুই যে ঈমান ও ইসলামের গন্ডিতে প্রবেশ করার জন্য প্রয়োজন, এর দলিল হিসেবে আমরা বেশ কয়টি বিশুদ্ধ হাদিস পাই, যা প্রমাণ করে যে, যে ব্যক্তি মৌখিক ঘোষণার পাশাপাশি বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসুল, সে মুমিন ও মুসলিম খেতাবে ভূষিত হবে, জান্নাতে প্রবেশের হকদার হবে এবং তাকে অনন্তকাল জাহান্নামের অধিবাসী হয়ে থাকতে হবে না। অনুরূপভাবে সীরাতের ঘটনাবলিও প্রমাণ করে যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীবৃন্দ এমন যে কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করতেন যে শাহাদাতাইন উচ্চারণ করেছে। শুরুতেই তারা শাহাদাতাইনের সঙ্গে অন্যকিছু যুক্ত করতেন না। নিচে এ বিষয়ক কিছু হাদিস উল্লেখ করছি, এরপর সীরাত থেকে কিছু ঘটনা উল্লেখ করার আশা রাখি। হাদিসের দলিল ১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল, এ দুটোতে কোনো সন্দেহ পোষণ না করে যে বান্দা আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [মুসলিম, আস-সহিহ (নববীর ব্যাখ্যাসহ) ১/২২৪] অন্য-এক বর্ণনা মতে, ‘যে বান্দা এ দুটো নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, সন্দেহকারী না হয়ে, তার জান্নাতে প্রবেশের পথে বাধা থাকবে না।’ [প্রাগুক্ত:১/৪২৬] ২ - রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘যে ব্যক্তি এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল যে সে জানে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [প্রাগুক্ত:১/২১৮] ৩ - উবাদা ইবনে ছামেত (রাযি.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিল যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দিলেন।’ [প্রাগুক্ত:১.২২৯] এ অর্থে আরও বহু হাদিস রয়েছে, [প্রগুক্ত ১/২১৮-২৪০] যা অভিন্ন বক্তব্যকে তাগিদ করে, অর্থাৎ যে ব্যক্তি তাওহিদের বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করবে, শাহাদাতাইন সঙ্গে নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে সে, আগে হোক পরে হোক, একদিন-না-একদিন জান্নাতে যাবে, সে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না, পাপ-গুনাহের জন্য জাহান্নামে তাকে শাস্তি দেয়া হলেও। মূল : ড. মুহাম্মাদ নাঈম ইয়াসিন বাংলা অনুবাদ : ড. মাওলানা শামসুল হক সিদ্দিক