ছবি সংগৃহীত

অন্ধকারের রবীন্দ্রনাথ : পিয়াস মজিদ

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ০৮ মে ২০১৬, ০৮:৪৩
আপডেট: ০৮ মে ২০১৬, ০৮:৪৩

গ্রাফিক্স : আকরাম হোসেন।

(প্রিয়.কম) আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৬তম জন্মদিন। কবিগুরুর জন্মজয়ন্তীতে প্রিয় পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো পিয়াস মজিদের প্রবন্ধ ‘অন্ধকারের রবীন্দ্রনাথ’।

অন্ধকারের রবীন্দ্রনাথ

রাজা। আজ এই অন্ধকার ঘরের দ্বার একেবারে খুলে দিলুম- এখানকার লীলা শেষ হলো। এসো, এবার আমার সঙ্গে এসো, বাইরে চলে এসো- আলোয়।
সুদর্শনা। যাবার আগে আমার অন্ধকারের প্রভুকে, আমার নিষ্ঠুরকে, আমার ভয়ানককে প্রণাম করে নিই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; রাজা, পৌষ ১৩১৭

রবীন্দ্রভুবনে অন্ধকারের এমন কীর্তন সুবিরল। রবীন্দ্রসৃষ্টির কেন্দ্রপ্রতিমা গড়ে উঠেছে অন্ধকারের বিপ্রতীপে আলোর বিজয়গানে। অন্ধকারকে অশুভ আর আলোকে শুভ’র প্রতীক-কল্পনা শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়; যেন প্রাচ্যের তাবৎ শিল্পী-সাহিত্যিকেরই অভিন্ন মুদ্রা। তবে একালের নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন আলো-অন্ধকারের এই ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্যের নির্মাণ। কালো আফ্রিকাকে বর্বরতার রূপক নির্ধারণ করে সেখানে শ্বেত-পাশ্চাত্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার্থে আলো-অন্ধকারের এমন নির্মাণ। সরলভাবেই বোধগম্য এটি এক ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী রাজনৈতিক প্রকল্প। বর্ণবাদ অবসানকল্পে গত শতকে তোলপাড়কারী নিগ্রোচেড আন্দোলন কৃষ্ণ আফ্রিকান শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মূল্য বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিলেও পাশ্চাত্যের মতো প্রাচ্যের লেখক-শিল্পীদের মাঝে এখনও আলো-অন্ধকারের প্রতীকে শুভাশুভ নির্ধারণের প্রয়াস চলমান।
বাংলা সাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ থেকে শামসুর রাহমান পর্যন্ত এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম খুব কমই চোখে পড়ে। জীবনানন্দ দাশকে অবশ্যই এ জরিপের বাইরে রাখতে হবে। কারণ তিনি তার প্রথাভাঙা কবিতায়-গদ্যে শুধু আলো-অন্ধকারই নয় বরং আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধেরই বিনাশ ঘটিয়েছেন।


রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় কৃতি তার বিবর্তন-মানসতায়। সৃষ্টির বিভিন্ন বাঁকে তিনি বারংবার নিজের গতি বদল করেছেন। সামনে চলতে গিয়ে নিজের তৈরি বিষয়প্রকরণ গুঁড়িয়ে দিতেও ছিলেন দ্বিধাহীন। তার রাজা নাটকের নাট্যকৌশল বা ভাববস্তু আমাদের আলোচ্য নয়। আমরা বিস্ময়ে শুধু দেখি ‘আলো, এত আলো’র রবীন্দ্রনাথ কীভাবে অন্ধকারের স্থিরীকৃত বক্রমূর্তি ভেঙেচুরে নতুনতার কেতন ওড়ান।
রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরূপরতন আহরণের চিরায়ত বাণীর বদলে এখানে তার গান-

আমি রূপে তোমায় ভোলাব না,
ভালোবাসায় ভোলাব।
আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো,
গান দিয়ে দ্বার খোলাব।

হ্যাঁ, রূপসনাতন এখানে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। এখানে এক নতুন রূপের প্রজ্জ্বলন। হতে পারে তার সর্বাঙ্গ কৃষ্ণাভ। কালো যে রূপ নয় তা কি স্বতঃসিদ্ধ? পূজা কী রূপের প্রাপ্য, না ভালোবাসার? এমত বোধের কিনারে আমাদের হাত ধরে নিয়ে চলে রাজা।


রাজা নাটকের আখ্যানভাগ বৌদ্ধ জাতকের কুশজাতক থেকে গৃহীত।
রানি সুদর্শনার বিয়ে হয় শৈশবে। তবে অদ্যাবধি রাজদর্শন হয়নি তার। শুধু রাজার স্তবগানই শুনছেন দাসদাসী আর প্রজাসাধারণের মুখে। বসন্ত উৎসবে রাজাকে চেনবার পরীক্ষা রানির। রানি রূপের মোহে অপূর্বসুন্দর সুবর্ণকে রাজা মনে করে। সুবর্ণ প্রতারণা করে রানির সাথে। রানি প্রকৃত রাজার কুৎসিত রূপ দেখে রুষ্ট হয়ে পিতৃগৃহ গমন করে। সুদর্শনার গৃহত্যাগের কথা শুনে অনেকেই তাকে পেতে চায়। তার পিতৃরাজ্যের বিরুদ্ধে বহু রাজা যুদ্ধ শুরু করে। অবশেষে প্রকৃত রাজা সব রূপবান নকল রাজাদের পরাস্ত করে। ‘রূপ’ নামক ছলনার জালমুক্ত হয়ে রানি রাজার সাথে মিলিত হয়। সব আলো- মরীচিকা কেটে আপাত অন্ধকার-কুৎসিত রাজার প্রেমরূপ ধরা পড়ে রানির চোখে।
‘অন্ধকার ঘর’ নাটকের দৃশ্যে ফিরে ফিরে আসে । শুরুতেও অন্ধকার ঘর, শেষেও সেই অন্ধকার ঘর। কারণ অন্ধকার ঘরেই সুদর্শনার এই শাশ্বত অভিজ্ঞান লাভ―
তুমি সুন্দর নও, প্রভু, সুন্দর নও, তুমি অনুপম।

কারণ সুন্দরের মূল্য রূপে নয়, প্রেমে।

আর বাতায়নে কেউ গান ধরে-
এ অন্ধকার ডুবাও তোমার অতল অন্ধকারে,
ওহে অন্ধকারের স্বামী!
এসো নিবিড়, এসো গভীর, এসো জীবনপারে
আমার চিত্তে এসো নামি।
এ দেহমন মিলায়ে যাক, হইয়া যাক হারা।
ওহে অন্ধকারের স্বামী!
বাসনা মোর, বিকৃতি মোর, আমার ইচ্ছাধারা
ওই চরণে যাক থামি।
নির্বাসনে বাঁধা আছি দুর্বাসনার ডোরে
ওহে অন্ধকারের স্বামী!
সব বাঁধনে তোমার সাথে বন্দী করো মোরে,
ওহে আমি বাঁধনকামী!
আমার প্রিয়, আমার শ্রেয়, আমার হে পরম,
ওহে অন্ধকারের স্বামী!
সকল ঝ’রে সকল ভ’রে আসুক সে চরম
ওগো মরুক-না এই আমি।

বোঝা যাচ্ছে বর্তমান অন্ধকারের চেয়েও অতল অন্ধকারে নিমজ্জনের সাধ সুদর্শনার। মুক্তি থেকে ‘বাঁধনকামী’। কারণ সাদা চোখে দ্রষ্টব্য আলো আর মুক্তির চেয়ে মনোহর হতে পারে অন্ধকার এবং বাঁধন; যদি তেমন বাঁধন হয়। যদি হয় তেমন আঁধার। চাই নিবিড়ঘন পবিত্র তিমির। যে সোনাঝরা তিমিরে ঘুচে যায় রূপ-অপরূপের মেকি ভেদ।


অন্ধকার কত বিচিত্র প্রশাখায় যে এখানে নিজেকে দীপ্ত করে তুলেছে! দাসী সুরঙ্গমার কয়েকটি উক্তির পানে কান পাতি-
‘সুরঙ্গমা। আলোর ঘরে সকলেরই আনাগোনা এই অন্ধকারের কেবল একলা তোমার সঙ্গে মিলন।’
‘সুরঙ্গমা। আমার সাধ্য কী মা, যেখানে তিনি অন্ধকার রাখেন আমি সেখানে আলো জ্বালব!’

রানি সুদর্শনা তার রাজানুগত দাসী সুরঙ্গমাকে ভর্ৎসনা করে এ কারণে যে অন্ধকার ঘরের মতো তার কথাও অন্ধকারাচ্ছন্ন, প্রহেলিকাময়। এই যেমন রানি রাজার রূপ জিজ্ঞাসিলে তার উত্তর-
সুরঙ্গমা। না রানিমা। সুন্দর বললে তাঁকে ছোটো করে বলা হবে।

কী এই সুন্দর? রাজার তো প্রচল সুন্দরতা নেই। তাই তার অন্ধকারবাস। নজরুলের ভাষায় বললে তিনি আসলে ‘প্রেমঘন সুন্দর। রসঘন সুন্দর। আনন্দঘন সুন্দর।’ সুন্দরতা রূপসাপেক্ষ নয়; দৃষ্টিসাপেক্ষ। সুন্দর আবিষ্কারণের শর্ত সুনয়ন। যে নয়ন সবার থাকে না। রাজা নাটকের প্রারম্ভভাগে রানি সুদর্শনারও তা ছিল না। এই নাটকের প্রারম্ভ থেকে বিশতম অঙ্কে পৌঁছা পর্যন্ত যে বাক্ ও সংগীতবিস্তার তার মর্মে নিহিত সুন্দরতার রহস্য উদ্ঘাটনের আকাঙ্ক্ষা।
আর অন্ধকার রাজা এখানে এমন সুন্দরেরই আধার যিনি সকল শাসন-ত্রাসন-শৃঙ্খলের চুরমার সাধন করেন। যিনি সবার স্বাধিকারের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চান রাজশক্তি। তাই তার রাজত্বে এমন গানই শোনা স্বাভাবিক-

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে!
(আমরা সবাই রাজা)

আমরা যা খুশি তাই করি
তবু তার খুশিতেই চরি,
আমরা নই বাধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে―
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে!
(আমরা সবাই রাজা)

রাজা সবারে দেন মান,
সে মান আপনি ফিরে পান
মোদের খাটো করে রাখেনি কেউ কোনো অসত্যে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে!
(আমরা সবাই রাজা)

আমরা চলব আপন মতে
শেষে মিলব তাঁরি পথে
মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে―
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে!
(আমরা সবাই রাজা)

জীবনের উপান্তে অঙ্কিত চিত্রমালায় যেমন রবীন্দ্রনাথের ভেতরকার ছিন্নভিন্ন সত্তা সকল সামাজিক মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ে তেমনি রাজা নাটকেও দেখি আলো-ভুরভুর দিবসের বন্দনা ছেড়ে- আঁধারের প্রেক্ষায় জীবনের অন্যতর উন্মোচনে ব্রতী তিনি। এখানে এসে যেন রবীন্দ্রনাথ এমন অভিজ্ঞতায় উত্তীর্ণ যে-নিকষ নিশীথে আপন হাতে আলো নিভিয়ে দিতে হয় কারণ তার মাঝেই কেউ জ্বালাবে ধ্রুবতারা। রাত্রির গহন-নির্জন পথে অন্ধকার, নিষ্ঠুর আর ভয়ানকের সন্ধান তো আমাদের পেতেই হবে কেননা আপাত অন্ধকারের উৎস হতেই তো উৎসারিত অনন্ত আলোকফোয়ারা।