ছবি সংগৃহীত

একাধিক পীরের মুরিদ হওয়া যাবে কি না?

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০১৬, ০৪:৪২
আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০১৬, ০৪:৪২

ইসলাহে বাতেন বা আত্মশুদ্ধির জন্য কোনো কামেল পীরের মুরিদ হওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মুরিদ হওয়ার এ ধারা নতুন কোনো বিষয় নয়, এটি সুন্নত। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলভি [রহ.] ‘আল কওলুল জামিল’ কিতাবে বলেন, ‘জেনে রেখো, বায়াত গ্রহণ করা সুন্নত, ওয়াজিব নয়।’ (শিফাউল আলিল তরজমায়ে আল কওলুল জামিল : ২১) আল্লামা ফকিরুল্লাহ হানাফি ‘কুতবুল ইরশাদ’ কিতাবের ৫৪৩ পৃষ্ঠায় বায়াত গ্রহণ সুন্নত হওয়ার কথা প্রমাণসহ উল্লেখ করেছেন। প্রায় একই রকম কথা বর্ণিত হয়েছে ‘আনোয়ারুল কুদসিয়া’ কিতাবের ৯নং পৃষ্ঠায়। মূলত বায়াতের উদ্দেশ্য হলো আত্মশুদ্ধি বা ইসলাহে বাতেন- যা কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ফরজ। কেউ যদি পীরের হাতে বায়াত না হয়েও আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পারে, তাহলে তার জন্য বায়াত হওয়া জরুরি নয়। যেমন ইলমে দীন শিক্ষা করা ফরজ। কেউ যদি তা কোনো শিক্ষক ছাড়া অর্জন করতে পারে তাহলে কোনো শিক্ষকের ছাত্র হওয়া জরুরি নয়। এখানে ছাত্র হওয়টা মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় হলো ইলমে দীন অর্জন করা। বায়াতের বিষয়টিও একই রকম। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস পর্যলোচনা করলে যে বাস্তবতা আমাদের সামনে ফুটে ওঠে তা হলো, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ নিয়ম এটাই যে, কাউকে ইলমে দীন হাতে বায়াত হওয়া অপরিহার্য। তাই শরিয়তের বিধান অনুযায়ী বায়াত সুন্নত হলেও বাস্তবতার আলোকে এটা অপরিহার্য এবং অত্যাবশ্যক। তবে ওস্তাদের কাছে ইলমে দীন শিক্ষা করা আর কোনো পীরের হাতে মুরিদ হওয়ার হকিকত এক নয়। ইলমে দীনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শাখার জন্য বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে পাঠ নিতে হয়। কিন্তু ইলমে মারেফতের জন্য একাধিক পীরের হাতে বায়াত হওয়া যায় না। কারও সোহবত হাসিল করা, কারও নসিহত অনুযায়ী আমল করা বা অন্য কোনো কায়দা গ্রহণ করা আর বায়াত হওয়া এক নয়। সুতরাং অনেক অলি-আল্লাহর জীবনী পড়ে আমরা জানতে পারি তারা একাধিক বুজুর্গের সান্নিধ্যে সময় কাটিয়েছেন সেটা দোষণীয় নয়; দোষণীয় হলো একই সঙ্গে একাধিক পীরের হাতে বায়াত হওয়া। কোনো অলি আল্লাহর জীবনীতে এরকম উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, ইলমে শরিয়তের ক্ষেত্রে একই সঙ্গে একাধিক শিক্ষকের কাছে দরস নেয়া যাবে; কিন্তু ইলমে মারেফতের জন্য একত্রে একাধিক পীরের হাতে বায়াত হওয়া যাবে না কেন? আসলে বায়াত হওয়ার তাৎপর্যটা কী তা বুঝতে সক্ষম হলে আমরা এ প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবো। শাহ আবদুল আজিজ মোহাদ্দেসে দেহলবি [রহ.] তার লিখিত ‘ফতোয়ায়ে আজিজি’ এর ১৫২ পৃষ্ঠায় বায়াত প্রত্যাহার করা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, ‘মুরিদ হওয়ার জন্যে কারও হাতে বায়াত হওয়ার পরে ওই বায়াত প্রত্যাহার করা হারাম এবং কবিরা গোনাহ। এর কারণ হলো, পীরের হাতে বায়াত হওয়ার মানে হলো তার সঙ্গে অঙ্গীকার করা। আর পীর হলেন একাধিক মধ্যস্থতায় রাসুলে পাক [সা.]-এর প্রতিনিধি এবং রাসুলে পাক [সা.] আল্লাহ তায়ালার প্রতিনিধি। সুতরাং পীরের হাতে বায়াতের মাধ্যমে প্রকারান্তরে সে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো। এ বায়াত প্রত্যাহার করলে তা মূলত আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গের শামিল হবে। এ কথার পক্ষে প্রমাণ হলো কোরআন শরিফের আয়াত ‘(হে রাসুল) যারা আপনার হাতে বায়াত হয় তারা মূলত আল্লাহর নিকটেই বায়াত হলো। আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর। সুতরাং যে তা ভঙ্গ করল সে নিজেরই ক্ষতি করল।’ (সূরা আল ফাতহ ) অনুরূপ আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর অঙ্গীকারকে দৃঢ় ও পাকাপোক্ত করার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে সম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, তারা ওইসব লোক যাদের জন্য রয়েছে অভিসম্পাত এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আজাব।’ (সূরা রাদ : ২৫) সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার ও প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রয় করে, আখেরাতে তাদের কোনো অংশ নেই, আর তাদের সঙ্গে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা কথা বলবেন না, তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিও দেবেন না, আর তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না; বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব।’ ( সূরা আলে ইমরান : ৭৭) এছাড়া সহিহ হাদিসে রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, মোনাফেকের আলামত ৩টি। ১. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে ২. যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং ৩. যখন অঙ্গীকার করে তা রক্ষা করে না।’ (ফতোয়ায়ে আজিজি : ১৫৩-১৫৪) এখানে স্পষ্ট বোঝা গেল, পীরের হাতে বায়াত হয়ে তা পরে প্রত্যাখ্যান করা নাজায়েজ। এবারে আমরা আমাদের প্রশ্নের জবাবে ফিরে আসি। ‘একই সঙ্গে একাধিক পীরের হাতে বায়াত হওয়া যাবে কিনা?’ আসলে এক পীরের হাতে বায়াত হওয়ার পরে অন্য পীরের হাতে বায়াত হওয়া প্রথম বায়াতকে প্রত্যাহার করারই নামান্তর। কারণ একত্রে দুই বায়াতকে রক্ষা করা সম্ভব হয় না। বায়াতের মাধ্যমে মুরিদ মূলত নিজেকে নিঃশর্তে পীরের হাতে সঁপে দেয়। সে যেন তার গোলামে পরিণত হয়ে যায়। তাই দুই পীরের হাতে একত্রে বায়াত হওয়া এক গোলামের দুই মনিব হওয়ার মতোই, যা কিনা একেবারেই অসম্ভব। এ জন্য রাসুলে পাক [সা.] গোলামদের বায়াত করতেন না। কারণ, সে মনিবের হক আদায় করতে গিয়ে বায়াত রক্ষা করতে পারবে না। হজরত জাবের [রা.] থেকে এ মর্মে নাসায়ি শরিফে বর্ণিত আছে, একবার এক গোলাম এসে রাসূলে পাক [সা.] এর হাতে হিজরতের বায়াত হলো। হুজুর জানতেন না যে, সে গোলাম। এর পর তার মনিব এসে তাকে নিয়ে যেতে চাইল। হুজুর (সা.) তখন তাকে দুটি কালো গোলামের বিনিময়ে তার মনিবের কাছ থেকে কিনে রাখলেন। পরে হুজুর [সা.] কখনও বায়াত করলে জিজ্ঞাসা করে নিতেন সে গোলাম কি না? (নাসায়ি শরিফ : ৪১৮৪) তাছাড়া পীরের থেকে পূর্ণ ফায়দা হাসিল করতে হলে তার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও নির্ভরশীলতা থাকতে হবে। দ্বিতীয় পীরের হাতে বায়াত হওয়া প্রথম পীরের প্রতি তার আস্থা ও নির্ভরশীলতার ঘাটতি প্রমাণ করে। এ জন্যই শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলবি (রহ.) আল কওলুল জামিল কিতাবের ৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘বিনা কারণে একাধিক পীরের হাতে বায়াত হওয়া বায়াতকে খেল-তামাশার বস্তু মনে করার শামিল। এতে বরকত উঠে যায় এবং পীরেরও এ ধরনের মুরিদকে পরিচর্যা করা থেকে মন উঠে যায়।’ তানকিহুল ফাতাওয়াল হামিদিয়া কিতাবের ২য় খণ্ড ৩৬৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘এ ধরনের বায়াত মূলত বায়াতই নয়।’ কিফায়াতুল মুফতি ২য় খণ্ড ১০৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘কোনো পীরের হাতে বায়াত হওয়ার পর তার কাছ থেকে ফায়দা পাওয়া সত্ত্বেও অন্য পীরের হাতে বায়াত হওয়া উচিত নয়।’ আশরাফ আলী থানবি [রহ.] শরিয়ত ও তরিকত কিতাবের ৪৯০ পৃষ্ঠায় বলেন, ‘একাধিক পীরের কাছে বায়াত হলে পীরের অন্তরও তার প্রতি স্বচ্ছ থাকে না, পীরের সঙ্গে নেসবাত টুটে যাওয়ার আশঙ্কা হয় এবং এ ধরনের মুরদি সুবিধাবাদী বলে পরিচিত হয়।’ তবে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে এক পীরের হাতে বায়াত হওয়া সত্ত্বেও অন্য পীরের হাতে বায়াত হওয়া জায়জে আছে। এ ক্ষেত্রে মূলত প্রথম বায়াত কার্যকর থাকে না। এ ধরনের কিছু কারণ, যেমন- ১. পূর্ণ আত্মশুদ্ধির আগে প্রথম পীর যদি ইন্তেকাল করেন। ২. মুরিদ প্রথম পীর থেকে এত দূরে অবস্থান করে যে, তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়। ৩. প্রথম পীর যদি গোমরাহ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তো বায়াত প্রত্যাখ্যান করা জরুরি হয়ে পড়ে। মোজাদ্দেদে আলফেসানি [রহ.] বলেন, এ ধরনের পীরের হাতে বায়াত হওয়া প্রাণনাশক বিষ এবং জীবন হরণকারী ব্যাধির মতো। (মাকতুবাত ১ম খ- : ১৪৪) ৪. পীরের আমল ঠিক থাকা সত্ত্বেও অনেক সাধনার পরও যদি কোনো ফায়দা হাসিল না হয়। এসব কারণ না থাকলে প্রথম বায়াত প্রত্যাহার করা অথবা প্রথম বায়াতকে ঠিক রেখে আবার অন্য কারও কাছে বায়াত হওয়া জায়েজ নয়। তবে হ্যাঁ, নিজের পীর ছাড়া অন্য কোনো পীর বুজুর্গের সান্নিধ্যে গিয়ে তাদের দোয়া নেয়া, নসিহত শ্রবণ করা না জায়েজ নয়। (ফতোয়ায়ে দারুল উলুম জাকারিয়া ২য় খণ্ড : ৪২৩; ফতোয়ায়ে হক্কানিয়া ৩য় খণ্ড : ২৪৭-২৪৮; ফতোয়ায়ে রাশিদিয়া : ৭২; ফতোয়ায়ে আজিজি : ১৫৩; ফতোয়ায়ে আমজাদিয়া ১ম খণ্ড : ৩৫২ ও ৩৪৭) লেখক : মাওলানা মুহাম্মাদ সিরাজুম মুনীর (তাওহীদ) গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান