কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

বামে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশের চিত্র, ডানে একজন শিক্ষকের প্রতীকী চিত্র

বি‌শ্ববিদ্যালয়গু‌লো এখন মেরুদণ্ডহীন প্রাণীদের পুনর্বাসন কে‌ন্দ্র

শরিফুল হাসান
প্রোগ্রাম হেড, মাইগ্রেশন, ব্র্যাক ও সাবেক সংবাদকর্মী
প্রকাশিত: ০২ অক্টোবর ২০১৭, ০১:২০
আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৭, ০১:২০

বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ প্রক্রিয়া যতটা স্বচ্ছ হয়েছে, যত বেশি মেধাবীরা এখানে নিয়োগ পাচ্ছে সেই তুলনায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া দিনকে দিন অস্বচ্ছ হয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বি‌শ্ববিদ্যালয়গু‌লো এখন মেরুদণ্ডহীন প্রাণীদের পুনর্বাসন কে‌ন্দ্রে প‌রিণত হ‌য়ে‌ছে।

না, আমি শুধু ধারণা থেকে কথাগুলো বলছি না। আমি বিসিএস বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা কোনোটার জন্য চেষ্টা না করলেও আমার ১৫ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষ করে সরকারি কর্মকমিশন নিয়মিত কাভার করার অভিজ্ঞতা থেকে কথাগুলো বলছি। বাংলা‌দে‌শের নি‌য়োগ প্র‌ক্রিয়া নি‌য়ে দীর্ঘ কা‌জের অ‌ভিজ্ঞতা থে‌কে কথাগু‌লো বলা।

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি কোনো ধরনের তদবির ছাড়া যোগ্য মেধাবী একটা ছেলেমেয়ের কাছে একটা স্বপ্নের নাম বিসিএস। ‌কোটা সমস্যা, নি‌য়ো‌গের পর অান্তঃক্যাডার বৈষম্য এগু‌লো অা‌ছে কিন্তু ‌তদ‌বির ছাড়া শুধু পরিশ্রম আর লেখাপড়া দিয়ে একটা ছেলেমেয়ে এখনও বি‌সিএস দি‌য়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হতে পারে। ২৭ থেকে ৩৮ প্রতিটি বিসিএসসের নিয়োগ প্রক্রিয়া আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে সাদিক স্যার পিএসসির চেয়ারম্যান হওয়ার পর আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে তার সাথে কাজ করেছি। স্যার নিয়োগ প্রক্রিয়া এমনভাবে করছেন যাতে মেধাবী সাধারণ ছেলেমেয়েরা নিয়োগ পায়। অার সে কার‌ণেই অাজ দুই হাজার প‌দের জন্য সা‌ড়ে তিন লাখ অা‌বেদন ক‌রে।

এবার অা‌সি শিক্ষক নি‌য়ো‌গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাক‌তেই সাংবাদিকতার কারণে এবং প্রচুর বন্ধুবান্ধব ছোট ভাই বড় ভাই থাকার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া আমি কা‌ছে থে‌কে দেখেছি, শুনেছি, যাচাই করেছি। অতীতে অনকবার এ নি‌য়ে বলেছি। আজও বলি।

অামার কাছে মনে হয় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সবচেয়ে জঘন্য। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রথম যোগ্যতা আপনাকে সরকার বা প্রশাসনের পছন্দের লোক হতে হবে। হ‌তে হ‌বে মেরুদণ্ডহীন। অাচ্ছা ‌নি‌য়ো‌গের অা‌গে কা‌রও না কা‌রও কা‌ছে যাওয়া ছাড়া কে কে শিক্ষক হ‌য়ে‌ছেন ব‌লেন তো? অা‌মি তো একজন‌কেও দে‌খি না। শুধু এই প্র‌ক্রিয়ার কার‌ণে অা‌মি কখ‌নও বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের শিক্ষক হওয়ার লড়াই‌য়ে না‌মি‌নি।

আপনারা কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন তিন চারটা প্রথম শ্রেণী পাওয়া লোকজনও তো নিয়োগ পাচ্ছে। য‌ত মেধাবীই হোক, তা‌দেরও একইভা‌বে বাধ্য হ‌য়ে কিংবা স্বেচ্ছায় কা‌রও না কারও কা‌ছে যে‌তে হয়। অারও অদ্ভুত বিষয় হলো কাকে প্রথম বানাবেন, প্রথম শ্রেণী দেবেন সেটাও অনেক সময় ঠিক করা থাকে। আর সরকার বা প্রশাসন চাইলে তো রেজাল্ট কোনো বিষয়ই না।

আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় কোনো সরকারি দপ্তরের পিয়ন নিয়োগ প্রক্রিয়াও এর চেয়ে ভালো। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। যে কোনো দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারী থেকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সবচেয়ে ভালো হওয়া উচিত ছিল। কারণ একজন অযোগ্য লোক শিক্ষক হওয়া মানে তার ৩০ থেকে ৩৫ বছর শিক্ষকতা জীব‌নে হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে বঞ্চিত করা। স‌ত্যি বল‌ছি অা‌মি এমন অ‌নেক‌কে পাব‌লিক বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের শিক্ষক হ‌তে দে‌খে‌ছি অামার অবাক লে‌গে‌ছে। অাবার অ‌নেক মেধাবী যোগ্য ছে‌লে‌কে দে‌খে‌ছি শিক্ষক হ‌তে পা‌রে‌নি তদ‌বির নেই ব‌লে।

যারা যোগ্য তা‌দের প্র‌তি সম্মান রে‌খে বল‌ছি, এই যে দিনের পর দিন অযোগ্য লোকজন শিক্ষক হচ্ছেন তার ফল কিন্তু আমরা পাচ্ছি। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষক। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আঠারশ শিক্ষক। এর মধ্যে ১৮ জন শিক্ষকের নাম কী জাতি জানে, যারা গবেষণা করে দেশ জাতিকে কিছু দিয়েছেন কিংবা ছাত্রছাত্রী‌দের মন জয় কর‌তে পেরে‌ছেন দুর্দান্ত প‌ড়ি‌য়ে? অার গ‌বেষণার স‌ঙ্গে অাজকালকার শিক্ষক‌দের যোজন যোজন দূরত্ব। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে তো আমি আর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দেখি না, যারা দেশ জাতিকে কাঙ্খিত কিছু দিতে পারছেন।

আপনারা কেউ কেউ বলতে পারেন এর সমাধান কী? আমি বহু আগেই এর সমাধান দিয়েছি। শুধু নামমাত্র একটা ভাইভা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগের নাটক বন্ধ করা উচিত। এর বদলে যারা শিক্ষক হতে চায় তাদের সবার একটা নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হোক। এরপর তাদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হোক। এর পরেই শুরু করতে হবে মূল পর্ব। যারা শিক্ষক হতে আগ্রহী তাদের সবাইকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত। এবার ছাত্ররাই মূল্যায়ন করুক, নম্বর দিক কে হবে তাদের শিক্ষক।

শুধু যে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ছাত্রদের মূল্যায়নের সুযোগ রাখা উচিত তাই নয়, প্রতি বছর প্রত্যেক কোর্স শিক্ষকের মূল্যায়ন করুক ছাত্ররা। গবেষণা আর এই মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষকদের চাকরি স্থায়ী থেকে পদোন্নতি সবকিছু হোক। নয়‌তো সমস্যার সমাধান হ‌বে না।

আচ্ছা আপনারা আমাকে বলেন তো স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক জাতিকে কী দিয়েছেন? নাম জানতে চাইলে হাতে গোনা দুই চারটা নাম ছাড়া আর নাম বলতে পারবেন না। ঢাকা বাদ দিলাম চট্টগ্রাম, কু‌মিল্লা, রাজশাহীসহ দে‌শের অারও প্রায় অর্ধশত বিশ্ব‌বিদ্যালয়ে যা হয় সেটা শুন‌লে লজ্জায় কুক‌ড়ে যে‌তে হয়। এসব কারণেই ছাত্রছাত্রীরা তাদের একজন স্কুল শিক্ষককে যতটা সম্মান করে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে তার কানাকড়িও করতে পারে না।

আমার মনে হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ঠিক করতে না পারলে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে কে ভিসি হবেন, কে ডীন কে প্রভোস্ট এই লড়াইয়ের খোয়াড়ে পরিণত হবে। গবেষণা আর শিক্ষার বদলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আপনি পাবেন ক্ষমতা নিয়ে চর দখলের মতো মারামারি। শিক্ষকরা একজ‌ন‌কে নি‌য়ে অা‌রেকজন হাসাহা‌সি কর‌বেন। কিন্তু নি‌জের সমা‌লোচনা কর‌তে পার‌বেন না।

অা‌মি জা‌নি না, জাতির কর্ণধাররা ক‌বে বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন। অাচ্ছা অামা‌দের শিক্ষকরা এত কিছু নি‌য়ে কথা ব‌লেন কিন্তু কেন তা‌দের নি‌য়োগ প্র‌ক্রিয়া নি‌য়ে কথা ব‌লেন না? জা‌নি না অার ক‌তটা ধ্বংস হ‌লে সবার ম‌নে হ‌বে য‌থেষ্ট হ‌য়ে‌ছে। তবু কামনা ক‌রি সবার বি‌বেক‌বোধ জাগ্রত হোক। মেরুদণ্ডটা সোজা হোক।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]