কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গা নারীদের এই ছবিটি প্রকাশ করেছে এপি।

স্বামীর সামনেই ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গা নারীরা

জাহিদুল ইসলাম জন
জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, নিউজ এন্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স
প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:১৯
আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:১৯

(প্রিয়.কম) মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করেছে। বার্তা সংস্থা এপি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ২৯ জন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাৎকারে এই তথ্য পেয়েছে। ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সী এসব নারীর অনেককেই তাদের স্বামীর সামনেই ধর্ষণ করা হয়েছে।

ধর্ষণের শিকার এসব নারী বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে রয়েছেন। সেখানেই আলাদা আলাদা করে সাক্ষাৎকার নেয় এপি। নারীরা তাদের বিস্তারিত পরিচয় দিয়েছেন। তবে মিয়ানমারে রেখে আসা স্বজনদের নিরাপত্তা বিবেচনায় শুধু নিজেদের নামের আদ্যাক্ষর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা এসব রোহিঙ্গা নারী জানিয়েছেন, ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তারা।

এদের প্রায় প্রত্যেকের গল্পই প্রায় এক। ধর্ষণ আর আক্রমণকারীদের ইউনিফর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তারা।

এসব নারীর এই স্বীকারোক্তি জাতিসংঘের দাবিকেই জোরালো করেছে। সংস্থাটি বলেছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধর্ষণকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবাহার করেছে।

এসব নারীর অভিযোগের বিষয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বক্তব্য জানতে কয়েক দফায় এপি চেষ্টা চালালেও তাতে সাড়া পায়নি। তবে গত মাসে সেনাবাহিনীর একটি অভ্যন্তরীন রিপোর্টে এই ধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করা হয়।

গত সেপ্টেম্বরে সাংবাদিকেদের রাখাইনে নিয়ে যায় মিয়ানমার সরকার। ওই সফরে ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মিয়ানমারের সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রী ফোনে টিন্ট উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এই নারীরা ধর্ষণের অভিযোগ করছে, তাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আপনাদের কি মনে হয় ধর্ষণ করার মতো যথেষ্ট সুন্দরী তারা?’

চিকিৎসক আর সাহায্যকর্মীরা বলছেন, যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে অল্পই সামনে এসেছে। ডক্টর উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) এর স্বেচ্ছাসেবকরা গত আগস্ট থেকে ১১৩ জন ধর্ষণের শিকার নারীকে চিকিৎসা দিয়েছে। এদের এক তৃতীয়াংশের বয়স ১৮এর নিচে। সবচেয়ে ছোটজনের বয়স ছিলো নয় বছর।

এপির সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রত্যেক নারী আক্রমণের বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, একদল লোক এই কাজে জড়িত ছিলো। বেশিরভাগ সময় অন্য ভয়ঙ্কর সহিংস নির্যাতনের সঙ্গে ধর্ষণও করা হয়েছে।

একজন ছাড়া বাকি প্রত্যেক নারীই জানিয়েছেন, ধর্ষণকারীরা সামরিক বাহিনীর আদলে ইউনিফর্ম পরিহিত ছিলেন। সাধারণত গাঢ় সবুজ পোশাকধারীরা তাদের ধর্ষণ করেছে।

শুধু এক নারী জানিয়েছেন, তাকে ধর্ষণ করেছে সাদা পোশাকের এক ব্যক্তি। তবে ওই ব্যক্তিকে কাছের সেনাচৌকিতে দেখেছেন তার এক প্রতিবেশি।

অনেক নারী বলেছেন, ইউনিফর্মগুলোতে অনেক সময় তারা অঙ্কিত দেখেছেন তারা। দুয়েকটি ক্ষেত্রে তীরচিহ্নও ছিলো। এসব চিহ্ন মিয়নমারের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ব্যবহার করে থাকে।

নির্যাতনের এই ব্যাপকতা নতুন হলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংস ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়। মিয়ানমার সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা হওয়ার আগে অং সান সু চি নিজেও বলেছেন, মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জাতিগত নিপীড়নের জন্য ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তবে এখন সু চির সরকার সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ধর্ষণের ঘটনার নিন্দা জানাতে শুধু ব্যর্থ হয়নি, বরং ‘মিথ্যা’ বলে তা খারিজ করে দিয়েছে।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোহিঙ্গা নারীরা যেসব যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করছেন তা ‘মিথ্যা ধর্ষণ’।

জবানবন্দি

পশ্চিম মিয়ানমারে নিজেদের বাড়িতে ঘুমিয় ছিলেন নববিবাহিত দম্পত্তি। গত জুনে সেরকম এক রাতে ঘরে প্রবেশ করে সাত সৈন্য। ‘এফ’ আদ্যাক্ষরের ওই রোহিঙ্গা মুসলিম নারীর এর পরের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। তিনি জানতেন, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে আক্রমণ করছে। ওই আক্রমণকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ বলে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ। এই তথ্য জানা না থাকলেও ওই রোহিঙ্গা নারী জানতেন তারা বাবা-মাকে দিনকয়েক আগেই হত্যা করেছে সেনারা। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তার ভাইকে।

আর এখন এই মধ্যরাতে তারা ঢুকে পড়েছে নিজের ঘরে। ওই লোকগুলো দড়ি দিয়ে তার স্বামীকে বেঁধে ফেলে আর ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেলা হয় তার মুখ। টেনে খুলে ফেলা হয় তার শরীরের অলঙ্কার, ছিড়ে দেওয়া হয় পোশাক। ছুড়ে ফেলা দেওয়া হয় মেঝেতে। আর তারপরই প্রথম সৈন্য তাকে ধর্ষণ করা শুরু করে।

তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অপর চার ব্যক্তি তাকে ধরে রেখেছিলেন। পেটানো হচ্ছিলো লাঠি দিয়ে। পরে অবশ্য তার স্বামী মুখের বাধন খুলে চিৎকার করে উঠতে পেরেছিলেন। আর তখনই ওই নারী দেখলেন, এক সৈন্য তার স্বামীর বুক লক্ষ্য করে গুলি করলো। একমাসে আগে বিয়ে হয়েছিলো তাদের। অবশ্য তা ভাবারও সময় পেলেন না তিনি। বুকের ওপর উঠে বসেছে আরেকজন। চেতনা হারিয়ে ফেলেন তিনি। সৈন্যরা যখন শেষ করে তাকে টেনে ঘরের বাইরে ফেলে দিয়ে বাঁশের তৈরি বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

দুই মাস পরে এসে বুঝলেন দুঃখের দিন শেষ হয়নি তার। পেটে এসেছে বাচ্চা।

বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার পরের তিন মাস এক প্রতিবেশির বাড়িতে থাকতেন ওই নারী। প্রতিবেশি ওই দম্পত্তির ছিলো পাঁচ বছর বয়সী এক ছেলে। ওই বাড়িতে থাকতেই তার সন্দেহ হতে শুরু করে নিজের পেটে বেড়ে ওঠা সন্তান আসলে কার? কোন সময়ে গর্ভে এসেছে তার সন্তান?

আসলে প্রার্থনা ছিলো আর যেন খারাপ কিছু না ঘটে। মধ্য-সেপ্টেম্বরের এক রাতে তাও ঘটে গেল। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়লো আরেক দল মানুষ। এবারে তারা ছিলো পাঁচজন। ছোট ছেলেটিকে চড় দিয়ে বাইরে বের করে দিলো। মেরে ফেললো ওই বাড়ির কর্তাকে।

এরপরই ওই ব্যক্তির স্ত্রী আর ‘এফ’ আদ্যাক্ষরের ওই নারীর শুরু হলো দুঃস্বপ্ন। কাপড় খুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলো মেঝেতে। এফের বন্ধু নারীটি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু লোকগুলো তাকে এমনভাবে পেটালো যে তার থাইয়ের থেকে চামড়া উঠে যাওয়া শুরু করলো।

আর বাধা দেওয়ার সাহস পেলেন না ‘এফ’। একসময় বুঝতে পারলেন দুই পায়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্তের স্রোত। এই অবস্থায় দুইজন ধর্ষণ করে তাকে। আর অপর তিনজন তার বান্ধবীকে।

ওই লোকগুলো চলে গেলে এই দুই নারী সারাদিন পড়ে থাকলেন মেঝেতে। অবশেষে উঠে দাড়ালেন ‘এফ’। টেনে ওঠালেন তার বান্ধবীকে। হাত ধরাধরি করে তাকে নিয়ে চলে গেলেন পাশের গ্রামে। আর পরের দশদিন ধরে পথ চলে অবশেষে পৌঁছান বাংলাদেশে।

‘এফ’ এখন বাস করেন দুই টয়লেটের মাঝখানে বাঁশের এক ছোট্ট এক তাঁবুতে। আর প্রার্থনা করেন পেটের সন্তানটি যেন একটি ছেলে হয়- কারণ মেয়েদের জন্য দুনিয়ায় কোনও জায়গা নেই।

আর অনাগত ওই সন্তানটিই হবে এফের পরিবারের একমাত্র সদস্য। ‘সবাই মরে গেছে, আমার আর কেউ নেই। সন্তানটিকে যদি ফেলে দেই তাহলে কাকে নিয়ে বাঁচবো? কার জন্যে বেঁচে থাকবো?’ বলেন ওই নারী।