কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

জাতিসংঘ সদর দফতর। সংগৃহীত ছবি

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা পূর্বপরিকল্পিত: জাতিসংঘ

আবু আজাদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১১ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৫৬
আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৫৬

(প্রিয়.কম) মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী সেদেশের রাখাইন রাজ্যের সব রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশ থেকে স্থায়ীভাবে তাড়ানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশ থেকে মুসলমানদের বিতারনের কৌশল হিসেবেই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম ও পরিকল্পিত হামলা চালানো হয়েছে। এ কারণেই তাদের গ্রাম ও ফসলের জমি এমনভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, যাতে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীরা আর কোনোদিন সেখানে ফিরতে না পারে।

জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা পুলিশ ফাঁড়ির ওপর হামলা চালানোর আগেই সমন্বিত রোহিঙ্গা দমন অভিযান শুরু হয়। মিয়ানমার সরকার সে বিষযটি গোপন করেছে। রাখাইন থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ৬০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন জাতিসংঘের কর্মীরা। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্যই সংকলিত হয়েছে।

প্রাণ বাঁচাতে স্রোতের মত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা ছবি: ফোকাস বাংলা

প্রাণ বাঁচাতে স্রোতের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। ছবি: ফোকাস বাংলা

এর আগে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর আগে মিয়ানমার সরকার বলে আসছিল যে, গত ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির যে হামলা, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবেই তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। কিন্তু জাতিসংঘ প্রকাশিত এই রিপোর্টের পর মিয়ানমার সরকারের দাবি পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার দফতর যে কেবল মিয়ানমার সরকারের এই দাবিকে অসত্য বলছে, শুধু তাই নয়। দফতরটি বলছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যেভাবে এই পুরো অভিযানটি পরিচালিত হয়েছে, তাতে তাদের মনে হয়েছে, এটি ছিল একেবারে পূর্বপরিকল্পিত। জাতিসংঘের ওই দাবি প্রমাণ করতে এর পক্ষে বেশ কিছু প্রমাণও তারা উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা মিয়ানমারের সেনা ক্যাম্পে হামলা চালানোর অনেক আগে থেকেই রাখাইনে সেনা মোতায়েন করা হয়। যারা ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা পুরুষদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। ওই ঘটনায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তা উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন।

খোলা আকাশের নিচে ত্রিপলের সাহায্যে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের ঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। ছবি: ফোকাস বাংলা

খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে নিজেদের ত্রিপলের সাহায্যেঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। ছবি: ফোকাস বাংলা

জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রোহিঙ্গাদের নাগরিকদের মধ্যে তাদেরই আটক করা হচ্ছিল বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়ভাবে নেতৃস্থানীয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে নির্যাতন, হয়রানি, ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে একটা চরম আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। ২৫ আগস্ট আরসার কথিত হামলার মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন বা শুদ্ধি অভিযান শুরু করে তা এত সুসংগঠিত, সমন্বিত এবং ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত তা কোনোভাবেই পরিকল্পিত না হয়ে পারে না

এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তা দেখে মনে হয়নি কোনো অভিযান পরিচালনার সময় সংঘাতের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বরং সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা (বৌদ্ধ সন্ত্রাসী) পরিকল্পনা করেই গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, রোহিঙ্গাদের সব সম্পদ ধ্বংস করেছে। যাতে তারা আর ফিরে আসতে না পারে

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৬০ শতাংশই নারী ও শিশু। ছবি: ফোকাস বাংলা

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৬০ শতাংশই নারী ও শিশু। ছবি: ফোকাস বাংলা

জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো এবং তাদের সব সম্পদ যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তার নমুনাই বলে দিচ্ছে মিয়ানমার থেকে যে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবেই বিতাড়নের চেষ্টা করা হয়েছে। শুধু যে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই নয়, তাদের গবাদি পশু, ফসলের খেত, এমনকি বসত ভিটায় যেসব গাছপালা ছিল, সেগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করা হয়েছে।

এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গারা যদি ফিরে আসে, সেখানে যেন তারা আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে না পারে। যেন তারা তাদের নিজেদের জায়গাকে পর্যন্ত আর চিনতে না পারে, জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

শত অনিশ্চয়তা নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সদ্যেজাত শিশুকে নিয়ে শাহপরীর দ্বীপে নেমেছেন এক রোহিঙ্গা মা। ছবি: ফোকাস বাংলা

শত অনিশ্চয়তা নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে শাহপরীর দ্বীপে এসেছেন এক রোহিঙ্গা মা। ছবি: ফোকাস বাংলা

রিপোর্টে আরও গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, রাখাইনে রোহিঙ্গা নামে যে একটি জনগোষ্ঠী ছিল, তার সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এজন্যে তারা টার্গেট করেছিল রোহিঙ্গা শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নেতাদেরকে। উদ্দেশ্য একটাই এবং তা খুবই স্পষ্ট, রোহিঙ্গাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য - সব কিছুকে সমূলে ধ্বংস করা।

সেনাদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া রোহিঙ্গা ভিটা। ছবি: এএফপি

সেনাদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া রোহিঙ্গা ভিটা। ছবি: এএফপি

জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন যাদের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, তারা গা শিউরে ওঠার মতো ভয়ংকর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। কীভাবে সেনাবাহিনী গ্রামগুলোতে আক্রমণ করেছে, নির্বিচারে লোকজনের ওপর গুলি চালিয়ে গণহত্যা করেছে, বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ আছে ওই প্রতিবেদনে। বেশির ভাগ রোহিঙ্গাই তাদের দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, যাদের গুলি করে মারা হয়, তাদের একেবারে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। অনেককে পালানোর সময় পেছন দিক থেকে গুলি করা হয়েছে।

সেনাদের আগুনে রাখাইন জ্বলছেই। ছবি: ফোকাস বাংলা

সেনাদের আগুনে জ্বলছে রাখাইন। ছবি: ফোকাস বাংলা

এ ছাড়া ওই প্রতিবেদনে খুবই বিশ্বাসযোগ্য একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে একজন অন্তঃসত্ত্বা রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ ও হত্যারও বিবরণও দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে কীভাবে ধর্ষণের পর ওই মহিলার পেটে ছুরি চালানো হয়, এমনকি তার স্তনও কেটে ফেলা হয়। এ ছাড়া অনেক মেয়েকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের সামনেই ধর্ষণ করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫লাখ ২৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি। এদিকে পালিয়ে আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও, তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলার সময় এখনও হয়নি বলে জানান সংস্থাটির মুখপাত্র। জাতিসংঘ আরও জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে জাতিগত নিধনে নেমেছে

অভিযানের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী খুন, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি পুরিয়ে দেওয়া, কুপিয়ে হত্যাসহ বর্বরতার চূড়ান্ত সীমাও অতিক্রম করেছে বলে অভিযোগ নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইচ ওয়াচের। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংস্থাটি বলেছে, ইতোমধ্যে প্রায় ২১৪টি রোহিঙ্গা অধুষ্যিত গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে। 

সূত্র: বিবিসি বাংলা

প্রিয় সংবাদ/শান্ত