মাদক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট আলোচনায় ‘চায়না হোয়াইট’
মাদক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে তরুণরা। এক্সপেরিমেন্টে রয়েছে এখন চায়না হোয়াইট। শুধু তাই নয়, নতুন কোনো মাদকের সন্ধান পেলেই লুফে নিচ্ছে তরুণরা। তা নিয়ে চলে সেই এক্সপেরিমেন্ট। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে দেশে আসতে শুরু করে হেরোইন। অনেক আগে থেকে প্রচলন ছিল গাঁজার। হেরোইন আসার পর মাদকসেবীরা আসক্ত হতে থাকেন এতে। এরপর ’৯০-এর দশকে ভারত থেকে আসা শুরু হয় ফেনসিডিল। ফেনসিডিলের রমরমা ব্যবসাকে ডুবিয়ে দিয়ে নতুন সহস্রাব্দে থাবা দেয় ‘ইয়াবা’। প্রায় দেড় দশক ধরে চলছে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আসা ইয়াবা নামের ভয়ঙ্কর এই মাদকের ব্যবসা। মাদকাসক্তদের মধ্যে বেশীর ভাগই তরুণ । আর এ তরুনদের টার্গেট করে তাদের কাছে পৌছে দিচ্ছে নতুন নতুন মাদক। কথা হয় কয়েকজন মাদকসেবী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সাথে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, আমরা যারা নিয়মিত ইয়াবা গ্রহন করি ,তারা এর চেয়ে ভালো কিছু এবং পিনিক (নেশা) হয় এমন কিছু পেলে সবাই অভিজ্ঞতার জন্য গ্রহন করি। বলতে পারেন এক ধরনের এক্সপিরিমিয়েন্ট করি। তবে ভালো লাগলে নিয়মিত নেই। পাশে থাকা তার বন্ধু একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলেন, দেশে নতুন কিছু আসলে বা বের হলে আমাদের কাছে খবর চলে আসে। আমরা সবাই একসাথে গ্রুপে নতুন জিনিস সেলিব্রেট করি। নতুন মাদক ‘ফেন্টানিল’। চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যথানাশক এবং চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা এই ওষুধটি এখন বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে হেরোইনের বিকল্প হিসেবে। অতিমাত্রায় ওষুধটি অপব্যবহারের কারণে ৩০ থেকে ৩৫ টাকার ২০ মিলিগ্রামের এই ইনজেকশনটি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। মাদক কারবারিরা ইনজেকশন হিসেবে এবং পাউডার হিসেবে ফেন্টানিল সংগ্রহ করে হেরোইনের সঙ্গে মিশিয়ে ‘চায়না হোয়াইট’ হিসেবে সরবরাহ করছে । আবার ফেন্টানিল অল্পমাত্রার হেরোইনের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে চায়না হোয়াইট পাউডার। এই চায়না হোয়াইট ব্যবহার হচ্ছে সিসা বারে। অনেক সেবনকারী বিভিন্ন ওষুধের দোকান থেকে ২০ এমএল ফেন্টানিল ইনজেকশন সংগ্রহ করে সিরিঞ্জের মাধ্যমে শরীরে নিচ্ছে।আরেকটি নতুন নিউ সাইকোট্রফিক সাবস্ট্যানসেস ‘এনপিএস’ । দেখতে অনেকটা ‘চা’ পাতার গুঁড়োর মতো। পানির সঙ্গে মিশিয়ে তরল করে সেবন করতে হয় এটি। এনপিএস মানবদেহে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। অনেকটা ইয়াবার মতো প্রতিক্রিয়া হয় এতে। জানা গেছে, এক ধরনের গাছ থেকে তৈরি হয়ে থাকে নতুন এই মাদক।অন্যদিকে, গতবছর আইস ও এমডিএমএ নামের নতুন দুটি মাদকের সন্ধান পেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ‘আইস’ লবণের মতো দানাদার জাতীয় এবং এমডিএমএ ট্যাবলেট জাতীয় মাদক।প্রত্যেতটিই উচ্চমাত্রার ?মাদক যা সেবনের পর মানবদেহে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। গতবছর বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো এ মাদক জব্দ করা হয়েছে। আইস খুব ভয়াবহ মাদক। জানা যায়, ইয়াবার চেয়ে ১০০ গুণ মারাত্মক মাদক ‘আইস’। এটি সেবনে মস্তিস্ক বিকৃতিসহ মৃত্যুও ঘটতে পারে। এই মাদকের মূল উপাদান মেথা ফেটামিন বিষন্নতা থেকে মুক্তি ও প্রাণসঞ্চারে উজ্জীবিত হতে ১৯৫০ সালে ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরে তা বিবর্তিত হয়ে ভয়ংকর মাদকে রূপ নেয়। ইন্দ্রিয় অনুভূতি, সাহস ও শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি যৌন উত্তেজনা বাড়াতে এই মাদক পরিচিতি পেলেও এর ক্ষতিকর দিকই বেশি বলে জানা গেছে। এই মাদক সেবনে অনিদ্রা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, শরীরে চুলকানিসহ নানা রোগ দেখা দেয়। ধোঁয়ার মাধ্যমের চেয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে এ মাদক নিলে মাত্র ১৫-৩০ সেকেন্ডের মধ্যে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো কর্মকাণ্ড ঘটাতে দ্বিধা করে না এই মাদক গ্রহণকারীরা।কয়েকজন মাদকসেবীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা নিয়মিত যেসব মাদক গ্রহন করে সেসব মাদক যদি সংকটে পড়ে তখন তারা নতুন মাদকের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠে। অন্যদিকে নিয়মিত মাদকের আড্ডায়ও তারা নতুন মাদকের প্রতি আগ্রহ দেখায়। যা শুধুমাত্র ভিন্নতার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, তরুনরা অনেক সময় ইট পাথরের শহরে হতাশায় ভুগে। তখন তারই আরেকজন বন্ধু নতুন কোনো মাদক আসলে তাকে অফার করে। মূলত, এভাবেই শুরুটা হয়। আবার যখন মাদকে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন তারা নিজেরাও নানান মেডিসিন মিশিয়ে নতুন মাদক তৈরী করে গ্রহন করে। তবে সেটা যারা করে তারা বেশীর ভাগই পুরনো মাদকাসক্ত। এসব মাদকাসক্তরা নতুন নতুন স্বাদ গ্রহনের জন্য এসব করে থাকে। তারা কিন্তু অনেকটা মানসিক যন্ত্রনায়ও ভুগে। মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) বলেছে, তরুণরা নতুন কিছু সবময়ই আগ্রহ নিয়ে গ্রহন করে। সেক্ষেত্রে মাদকের বিষয়টি সবার আগে থাকে। তারা তখন প্রথম এটাকে টেস্ট করে এবং ভালো লাগলে নিয়মিত গ্রহন করে। তারা এসব মাদক গ্রহণের ফলে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া গেলেও এই ক্ষণস্থায়ী স্বস্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকে ভয়ঙ্কর ফাঁদ। ফাঁদে একবার জড়ালে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, সৃজনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। ‘স্বাস্থ্যহানি’ বলতে কেবল দৈহিক স্বাস্থ্যের কথা বলা হচ্ছে না। দেহের পাশাপাশি বিশৃঙ্খল ও বিধ্বস্ত হয়ে যায় মনের স্বাস্থ্য, পুড়ে যায় আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক চিত্রে নেমে আসে দুর্যোগ।মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৭ লাখ। যার মধ্যে ৯০ শতাংশ কিশোর ও তরুন। মাদকাসক্তদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। পথশিশুদের একটি বড় অংশ মাদকে আসক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন বলেন , নতুন মাদক হয়তো বাংলাদেশের জন্য নতুন। কিন্তু আমাদের আশেপাশে বা সারা বিশ্বে কিন্তু নতুন নয়। সে জায়গা থেকে এসব মাদক চিনতে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। আমাদের একটি টিম আছে যারা এসব নিয়ে কাজ করে। মাদকাসক্তরা মাদকের মধ্যে ভিন্নতা আনার জন্যও অনেক সময় নতুন মাদক নিজেরাই বানিয়ে ফেলে।
- ট্যাগ:
- অন্যান্য সংবাদ
- মাদক
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- ঢাকা