কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

দুর্জয়ের মায়ের কান্না থামাবে কে?

মানবজমিন প্রকাশিত: ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

অঝোর ধারায় চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল রাশেদা বেগমের। মুখে হতাশার ছাপ। শরীরে ভর করেছে ক্লান্তি। কখনো হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন। কখনো আবার মূর্ছা যাচ্ছেন। নিজের ঘরে তালা দিয়েছেন। বড় মেয়ের ঘরের সামনে বসা সোমবার রাত থেকে। স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু না রাশেদা তার মনকে কিছুতেই বুঝাতে পারছিলেন না। আদরের ছেলে দুর্জয় বাস চাপায় পিষ্ট হয়েছে। লাশকাটা ঘর হয়ে মরদেহ বাসায় আসবে। জানাজার পর দাফন করা হবে গ্রামের বাড়িতে। এ বিষয়টি কিছুতেই মানতে পারছিলেন না রাশেদা। তিনি আশায় বুক বেঁধে আছেন ছেলে বাসায় ফিরবে, খাবার খেতে চাইবে। তবেই তিনি ঘরের তালা খুলবেন। একই অবস্থা বাবা আব্দুর রহমানের। রাত থেকে কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে পরের দিনের দুপুরও গড়িয়ে যাচ্ছে। এক ফোঁটা পানিও মুখে দেননি। স্বজনরা অনেক জোরাজুরি করছিল। কে শুনে কার কথা। আব্দুর রহমানের একই কথা। আমার ছেলে ফিরে আসুক। সে পানি দিলে তবেই আমি খাবো। ঢাকার রামপুরার টিভি রোডের পলাশবাগ এলাকায় অনাবিল পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে পড়ে নিহত হয়েছেন একরামুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি’র ফল প্রত্যাশী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। গত সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাটি ঘটে। ভগ্নিপতি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে রাস্তা পার হচ্ছিলেন দুর্জয়। বাসের চাপায় দুর্জয় ঘটনাস্থলে মারা যান। তার মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ১০টি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ ছাড়া ঘটনাস্থলেই বাসের চালককে জনতা আটক করে পুলিশে দেয়। এ ছাড়া বাসের হেলপার চান মিয়াকে আটক করেছে র‌্যাব। এ ঘটনায় দুর্জয়ের মা রাশেদা বেগম বাদী হয়ে গতকাল রামপুরা থানায় নিরাপদ সড়ক আইনে মামলা করেছেন। এ ছাড়া বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে আরেকটি মামলা করেছে। রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, নিহত শিক্ষার্থীর মায়ের করা মামলায় অনাবিল পরিবহনের বাসের চালক সোহেলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গণপিটুনির শিকার সেই চালক বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুলিশি পাহারায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদিকে একই ঘটনার জেরে রামপুরা এলাকায় ৮টি বাসে আগুন এবং চারটি বাস ভাঙচুর করায় পৃথক একটি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে ওই মামলাটি করেছে। এই মামলায় অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।এদিকে মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের ময়নাতদন্ত গতকাল বেলা ১২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্ত করেন ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাত নাঈম। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ গ্রহণ করেন তার বড় ভাই মনির হোসেন। ১২টার কিছুক্ষণ পরে একটি এম্বুলেন্সে করে দুর্জয়ের মরদেহ নেয়া হয় রামপুরা তিতাস রোডের গনিবাগ জামে মসজিদ মাঠে। সেখানে তার প্রথম জানাজা হয়। পরে সেখান থেকে মরদেহ নেয়া হয় তাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা হালুয়াপাড়া গ্রামে। সেখানেই তার মরদেহ দাফন করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রহমান ও রাশেদা বেগমের ছোট ছেলে মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। আব্দুর রহমান ১৫ বছর আগে ঢাকায় আসেন। পেশায় চা বিক্রেতা রহমানের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে দুর্জয় সবার ছোট। বড় ছেলে মনির হোসেন একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রাইভেটকারের চালক। আর মেয়ে ঝুমার বিয়ে হয়েছে। তারা সবাই মিলে রামপুরার পলাশবাগ এলাকায় থাকতেন। দুর্র্জয় ঢাকার একরামুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষা করছেন। তার স্বপ্ন ছিল পরীক্ষায় পাস করলে ভালো একটি কলেজে ভর্তি হবে। এজন্য পরীক্ষা দিয়েই বাবা-মাকে বলেছে শুধু ভালো কলেজে ভর্তি করালে হবে না। প্রাইভেটও পড়াতে হবে। বাবা-মা তাকে আশ্বাসও দিয়েছিলেন তার স্বপ্নপূরণ করা হবে। পলাশবাগ পাড়ায় দুর্জয়দের চায়ের দোকান থেকে আসা আয়ই তাদের পরিবারের মূল ভরসা ছিল। তাইতো তার বাবা-মা ও সে নিজে দোকান চালাতেন। স্বজনরা জানিয়েছেন, মৃত্যুর সময় দুর্জয়ের পকেটে ছিল ৪ টাকা। মায়ের কাছে আরও ৫ টাকা চাইলে তিনি ১০ টাকার একটা নোট হাতে দেন। তারপর খুশি মনে ঘর থেকে বের হয় দুর্জয়। তার ঠিক আধা ঘণ্টা পরে দুনিয়া ছেড়ে চলে যায় সে। গতকাল দুর্জয়দের বাসা খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল অন্যরকম এক পরিবেশ। তার শোকাতর মা রাশেদা বেগম বড় মেয়ে ঝুমার ঘরের সামনে বসে কাঁদছিলেন। স্বজনরা তাকে সান্ত্বতা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তার কাছে যে যাচ্ছে তাকে একই কথা বলছেন রাশেদা। আমার ছেলেটারে এনে দিতে পারবা। আমার ছেলেটারে এনে দাও। হায় আল্লাহ আমি আমার ছেলেটারে ছাড়া কি নিয়ে বাঁচবো। এসব বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন রাশেদা। এ ছাড়া দুর্জয়ের বাবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলের অপেক্ষা করছেন। দুর্জয়ের বড় ভাই মনির হোসেন বলেন, টানাটানির সংসার আমাদের। তবুও বাবা-মা চাইতেন দুর্জয় লেখাপড়া করুক। পড়ালেখার খরচ চালাতে গিয়ে চায়ের দোকানের পাশাপাশি আমার মা হালিম তৈরি করে দিতেন। আর সেই হালিম বিক্রি করতো দুর্জয় নিজে। সেখান থেকে যে আয় আসতো তা দিয়েই তার লেখাপড়ার খরচ যোগানো হতো। আমার ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল একসময় সে সংসারের হাল ধরবে। একটা ব্যবসার জন্য আমি দুই লাখ টাকা ধার করেছিলাম। সেই টাকা পরিশোধের জন্য বাবা-মাকে চাপ দিতো দুর্জয়। প্রায়ই বলতো গ্রামের বাড়ির জায়গা বিক্রি করে সেই টাকা পরিশোধ করার জন্য। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মনির বলেন, আমাদের পরিবারের সবার চেয়ে সে ছিল লম্বা। এটা নিয়ে প্রায় আমার সঙ্গে মজা করতো। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ দুর্জয়ের বড় বোন ঝুমা। কথা বলতে পারেন না তিনি। তবুও ভাইয়ের মৃত্যুতে তার চাপাকষ্ট ফুটে উঠছিল। বুকে হাত দিয়ে তার কষ্টগুলো বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন। লাশকাটা ঘরে ভাইয়ের অপেক্ষা: ছোট ভাই দুর্জয়ের মরদেহ লাশকাটা ঘরে। কখন ময়নাতদন্ত হবে জানেন না মনির হোসেন। তার সঙ্গে ভিড় করছেন দুর্জয়ের বন্ধু, পাড়া প্রতিবেশী ও অন্য স্বজনরা।  মনিরের চোখ বেয়ে একটু পর পর জল পড়ছিল। হঠাৎ কেঁদে ওঠেন আর বলেন, আমার ভাইটারে শেষ করে দিলো। সে আর কখনো আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলবে না দেখ আমি কত বড় হয়েছি। দুর্জয় আমাকে বলতো লেখাপড়া শেষ করে কাজকর্ম করে আমাকে সাহায্য করবে যাতে সুন্দর করে আমাদের পরিবারটা চলে।পাড়া প্রতিবেশীরা শোকাহত: শুধু পরিবারেই নয় পাড়া প্রতিবেশীর কাছেও অনেক প্রিয় ছিল দুর্জয়। পাড়ার সকল পরিবারে যাওয়া আসা থেকে শুরু করে খাওয়ার আড্ডা দিতো। সকলের সুখে দুঃখে এগিয়ে যেতো। বড়দের সম্মান করা, ছোটদের প্রতি ভালোবাসাও ছিল। তাইতো বয়সে অনেক ছোটরাও তার সঙ্গে চলাফেরা করতো। দুর্জয়ের প্রতিবেশী হুমায়ুন কবীর বলেন, ছেলেটা শুধু লেখাপড়াই করতো না। প্রতিদিন দুপুর বেলা দোকানে বসে চা বিক্রি করতো। পাড়ার অনেকেই তাদের দোকানে যেতো। কখনো কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। পরিবারের সবার প্রিয় ছিল যেমন তেমনি পাড়া প্রতিবেশীরা তাকে অনেক আদর করতো।  সালেহা বেগম নামের এক নারী বলেন, আমার ছেলের সঙ্গেই খেলাধুলা করতো। তারা একই স্কুলে পড়েছে। কোনদিন তাকে খারাপ কোনো কাজে লিপ্ত বা কারও সঙ্গে বেয়াদবি করতে দেখিনি। জহির আহমেদ নামের আরেক প্রতিবেশী বলেন, এই যুগে এমন ছেলে খুবই কম হয়। যেমন ভদ্র, লেখাপড়ায় ভালো তেমনি পরিবারের প্রতি তার অন্যরকম টান ছিল। সে চেয়েছিল লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করবে। পরিবারের দায়িত্ব নিবে কিন্তু তার এই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।বন্ধু মহলে শোকের ছায়া: দুর্জয়ের মৃত্যুতে তার বন্ধু মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ঘটনার পরপরই তার বন্ধুরা ঘটনাস্থলে আসেন। তারপর মেডিকেল, পোস্টমর্টেম থেকে শুরু করে দাফন পর্যন্ত ছিলেন। দুর্জয়ের এমন অকালে ঝরে পড়াকে বন্ধুরা মেনে নিতে পারছেন না। দুর্জয়ের সহপাঠী আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা একই স্কুলে পড়ালেখা করেছি। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে মিশেছি। আমার এক ব্যাচ সিনিয়র হলেও আমরা বন্ধুর মতো মিশতাম। শুধু আমার সঙ্গে না সবার সঙ্গে দুর্জয়ের ভালো সম্পর্ক ছিল। সবাই তাকে আইকন ভাবতো। পড়ালেখায়ও ভালো ছিল। ঘটনার দিন রাতে আমাকে ফোন করে একজন জানায় দুর্জয় মারা গেছে। আমি বিশ্বাস করিনি। পরে আশপাশের সবাই বলাবলি করছিল। তখন বিশ্বাস হয়েছে। ভাবিনি কখনো এভাবে লাশ হিসেবে তাকে দেখতে হবে। তার মৃত্যুতে আমাদের বন্ধু মহলে শোকের ছায়া চলে এসেছে। আরেক সহপাঠী আলমগীর হোসেন বলেন, পরিচয়ের পর থেকে তার সঙ্গে আমার কখনো ঝগড়া লাগেনি। পড়ালেখা থেকে শুরু করে আড্ডাবাজি, খেলাধুলা সবই করতাম। পাড়ার সবাই তাকে খুব পছন্দ করতো। সবার আপদে বিপদে এগিয়ে যেতো। মিশুক টাইপের ছেলে ছিল। রুবেল নামের আরেক সহপাঠী বলেন, আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না দুর্জয় নাই। এমনটা হবে কখনো ভাবিনি। আমাদের সব বন্ধুরা এখন শোকাহত। একজন ভালো খেলার সাথী ভালো পড়ার সাথীকে হারালাম। বন্ধু সবাই হতে পারে তবে দুর্জয়ের মতো বন্ধু কম হয়। দুর্জয়ের আরেক বন্ধু বলেন, কয়েক মাস আগে নিজের ফেসবুকে দুর্জয় লিখেছিল ‘ঠিক ততটা আঁধারে হারিয়ে যাব, যতটা অন্ধকারে হারালে কেউ সন্ধান পাবে না।’ এই স্ট্যাটাস দেয়ার পর তার সঙ্গে অনেক মশকরা করেছি। কিন্তু এভাবে সত্যি সত্যি আঁধারে হারিয়ে যাবে সেটি ভাবিনি।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত