কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া

মানবজমিন প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

উপমহাদেশের মানুষের ঐতিহ্য ও শেকড়ের সুতোয় গাঁথা ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। অনেকে আবার আদর করে এটাকে বলেন জীবনমুখী নিরাময়ের মাধ্যম। পৌনে দু’শো বছর বৃটিশ আধিপত্যবাদী অপশাসনে ধীরে ধীরে সংকুচিত করে ফেলা হয় ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে। উনিশ শতকের শেষভাগ। শুরু হয় বিদেশি পণ্য বর্জনের সর্বাত্মক আন্দোলন। ভারতের প্রখ্যাত ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানী হাকিম আবদুল মজিদ স্বদেশি চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের অংশ হিসেবে শুরু করেন হামদর্দ নামের ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এরপর পেরিয়ে গেছে এক শতাব্দীরও বেশি সময়। নিজস্ব ওষুধের মাধ্যমে মানুষের রোগমুক্তি ও প্রগতিশীল জীবনের অনুঘটক হিসেবে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও হামদর্দ পরিণত হয়েছে প্রাচ্য চিকিৎসার পথিকৃতে। মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তরুণদের প্রতি দেশ বিনির্মাণের অমোঘ ডাক দেন। এ ডাকে সাড়া দিয়ে তরুণ ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজি, প্রায় তিন লাখ টাকা দেনা, ১১ কাঠা জমি, ৩১ জন কর্মচারী এবং ওষুধ তৈরির কিছু সংখ্যক হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হামদর্দকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। ডাক্তার ভিজিট, আউটলেটে ওষুধ পৌঁছে দেয়া এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ছিল মাত্র একটি ফনিক্স সাইকেল। সাইকেলটিতে চড়ে হামদর্দকে গড়ে তুলবার স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াতেন ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া।তরুণ ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া’র এই স্বপ্ন ও উদ্যোগই যে, বাংলাদেশে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা খাতের জন্য মাইলফলক হবে তা কে জানতো। সময়ের ডানায় চড়ে শুধু হামদর্দ এর ৫০ হাজার টাকা পরিণত হয়েছে ১২ হাজার কোটিতে, ১১ কাঠা জমি থেকে হয়েছে ৭০০ বিঘা এবং ৩১ জন লোক থেকে ৮ হাজার উদ্যমী মানুষের বিশাল কর্মীবাহিনী। গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক কলেজ, মেডিকেল কলেজ, মাদ্রাসা, এতিমখানাসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। ওয়াক্‌ফ লিল্লাহ প্রতিষ্ঠান হওয়ায় হামদর্দের স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পদ থেকে অর্জিত মুনাফা ব্যয় হচ্ছে মানবকল্যাণে।বাংলাদেশে হামদর্দ শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা খাতে যুগান্তকারী বিপ্লব সূচিত হয়। গড়ে ওঠে এই চিকিৎসা ব্যবস্থার অসংখ্য ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত ডা. নুরুল ইসলাম, তৎকালীন ওষুধ প্রশাসনের পরিচালক ড. হুমায়ুন কে এম এ হাই, ইউনানী-আয়ুর্বেদিক বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রয়াত হাকীম আজিজুল ইসলাম এবং ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়ার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ড্রাগ পলিসিতে ইউনানী আয়ুর্বেদিক ও হারবাল চিকিৎসাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত করা হয়। ফলে সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগপ্রাপ্ত হন ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা। ইউনানী আয়ুর্বেদিক ওষুধ উৎপাদন ব্যবস্থা সরাসরি তদারকি করা শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রণয়ন করা হয় ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারি। এমনকি এই খাতে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা আইনের খসড়া। বাস্তবতার নিরিখে চিকিৎসা সেবার সাংবিধানিক অধিকার সর্বত্র পৌঁছে দিতে জাতির পিতার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবার  উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিকল্প ওষুধ হিসেবে ইউনানীসহ ভেষজ ওষুধকে গুরুত্ব দিতে হবে। সারা বিশ্বেই এখন ভেষজ ওষুধের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে। এ চিকিৎসাগুলো যেন মানুষ সহজভাবে নিতে পারে সেদিকে সরকারের লক্ষ্য রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাস্তবে রূপ দিতে প্রথম উদ্যোগী হন ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং বাংলাদেশ বোর্ড অব ইউনানী অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক সিস্টেমস অব মেডিসিন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-এর ব্যাচেলর অব ইউনানী মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (বিইউএমএস) এবং ব্যাচেলর অব আয়ুর্বেদিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (বিএএমএস) প্রোগ্রাম দুটিকে অনুমোদন প্রদান করে। শুধু তাই নয়, প্রোগ্রাম দুটির সিলেবাস ও কোর্স কারিকুলামও ইউজিসি কর্তৃক অনুমোদিত। পাশাপাশি উক্ত অনুষদে শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে তারা। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একমাত্র হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ই সরাসরি বিইউএমএস ও বিএএমএস প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। শুধু রাজধানী কেন্দ্রিক নয়, বরং তৃণমূল পর্যায়ে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখতেন ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। বাংলাদেশে ৩টি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মধ্যে একটি সরকারি। অপর দুটি প্রতিষ্ঠান ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। একটি লক্ষ্মীপুরে অবস্থিত রওশন জাহান ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত। অন্যটি বগুড়ায় অবস্থিত হামদর্দ ইউনানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হিসেবে বিইউএমএস প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। যার ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষও ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষার সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়ে শিক্ষাদানের এই সুযোগটি কেবলমাত্র হামদর্দ পরিচালিত দুটি ইউনানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালই পেয়েছে।ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া’র নির্দেশনায় বাংলাদেশের ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চশিক্ষার আঙিনায় পা রেখেছে। অত্যাধুনিক ল্যাবের মাধ্যমে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে নিরন্তর গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচ্ছে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে রয়েছে উচ্চতর এমপিএইচ ডিগ্রিও।হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিইউএমএস ও বিএএমএস প্রোগ্রাম দুটি প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির এমবিবিএস’র সমমান মর্যাদার। প্রোগ্রাম দুটি সম্পন্ন করলে বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি রয়েছে সরকারি চাকরির সুযোগ। হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ; ভারত, শ্রীলঙ্কা ও তুরস্কের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেছে। ইতিমধ্যে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ক্যাম্পাসে শ্রীলঙ্কা থেকে আসা বিশেষজ্ঞ শিক্ষক পাঠদান করেছেন। ভারত থেকেও বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদ আসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কারণে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিইউএমএস ও বিএএমএস প্রোগ্রামের যেকোনো শিক্ষার্থী ভারত ও তুরস্কে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে চাকরি করারও সুযোগ নিতে পারেন। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি ও এমডি ডিগ্রি চালু করার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার লেখেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে এলোপ্যাথিক ওষুধের পাশাপাশি ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি অল্টারনেটিভ এই পদ্ধতিও চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিরাট ভূমিকা রাখছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে ইউনানি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৭২ এবং সেখানে নিবন্ধিত ওষুধের সংখ্যা রয়েছে ৬ হাজার ৬৩০, আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০১ এবং নিবন্ধিত ওষুধের সংখ্যা ৪ হাজার ১১০, হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪২টি এবং নিবন্ধিত ওষুধের সংখ্যা ২ হাজার ৪১৭। আর হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩২ এবং সেখানে নিবন্ধিত ওষুধের সংখ্যা রয়েছে ৫৫০। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার প্রচেষ্টা রয়েছে অল্টারনেটিভ এই চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতি সাধন করা।ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়ার আন্তরিক ও একক প্রচেষ্টায় ভ্যাটমুক্ত করা হয় ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্পকে। ফলে দিন যত যাচ্ছে মানুষের কল্যাণে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে এই খাত। সরকারও ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সুতরাং এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, আগামী দিনের নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা শিক্ষা হিসেবে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক বিজ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। এভাবেই ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়ার হাত ধরে দুর্দমনীয় গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। সময়ের চড়াই-উতরাই আর গিরিখাদ পেরিয়ে এই ব্যবস্থা এখন পরিণত হয়েছে মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার আলোঘরে।    লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত