কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

‘পঙ্গু’ হাসপাতাল অনিয়মের দুষ্টচক্র

মানবজমিন প্রকাশিত: ০১ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

নজিরবিহীন অনিয়মের বেড়াজালে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল)। বছরের পর বছর এমনকি দুই দশক ধরে পদ আঁকড়ে ধরে বসে আছেন একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। কিন্তু এ অনিয়ম যেন দেখার কেউ নেই। প্রশাসন থেকে শুরু করে ওয়ার্ডবয় পর্যন্ত কেউ-ই তোয়াক্কা করছে না সরকারি নিয়মনীতি। ফলে এসব অনিয়মে জড়িতরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রোগীদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা আদায়, সাধারণ রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত ওষুধ খোলা মার্কেটে বিক্রি, দালালদের সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন অখ্যাত বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী পাঠানো- এমন অভিযোগে হরহামেশাই ওঠে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে। মাঝে মাঝে লোক দেখানো ব্যবস্থাও নেয়া হয়। কিন্তু সমস্যার নেপথ্যে কখনোই হাত দেয়নি পঙ্গুর প্রশাসন। বরং পেলেপুষে তাদেরকে দুর্নীতির মহীরুহে পরিণত করেছে। আর এদের বিরুদ্ধে কথা বললেই বলির পাঁঠা হতে হচ্ছে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব সমস্যার সিংহভাগ নেপথ্যে রয়েছেন দীর্ঘদিন বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিরা। দুই বছর পরপর এ দায়িত্ব পরিবর্তনের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এমনকি কেউ কেউ প্রায় দুই দশক ধরে পদে বহাল রয়েছেন। দুর্নীতিকে আশ্রয় করে অনেকেই ঢাকায় গড়ে তুলেছেন একাধিক ফ্ল্যাট। রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিলাসবহুল গাড়ি। অনুসন্ধানে জানা যায়, অধিকাংশ ওয়ার্ডের ইনচার্জ বেসরকারি ধোপা বাসেতের মাধ্যমে ওষুধ পাচার করে থাকেন। বাসেত প্রতিদিন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে ময়লা বেড সিট/ড্রসিট নেয়। ওই ড্রসিটের পুঁটলার ভেতরে করে হাসপাতালের রোগীদের জন্য সরবরাহকৃত উচ্চমূল্যের ইনজেকশনসহ নানা ধরনের ওষুধ বাইরে নিয়ে যায়। এর আগে, ২০১৫ সালে হাসপাতালের চিকিৎসক প্রফেসর শহিদুল ইসলাম ধোপা বাসেতকে ওষুধসহ হাতে-নাতে ধরে ফেলেন। পরে তাকে পুলিশে দেয়া হয়। সে সময় ৬ মাস জেলখাটার পর আবারো আগের কাজে ফিরে আসেন বাসেত। কিন্তু নিজেকে না শোধরিয়ে তিনি আবারো ওয়ার্ড ইনচার্জদের যোগসাজশে ওষুধ পাচার অব্যাহত রাখেন। এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ২০১৬ সালে হাসপাতালের তৎকালীন যুগ্ম পরিচালক ডা. আবদুর রাজ্জাক মিয়া অধিকাংশ ইনচার্জ পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। উল্টো নানা ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয় তার। হাসপাতালটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঝামেলা এড়ানোর জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের তোয়াজ করে চলেন। ২০১৭ সালে আবারো ধোপা বাসেত বিপুল পরিমাণ ওষুধসহ জনতার হাতে ধরা পড়েন। ওই সময় তিনি সবার সামনে ইওটি ইনচার্জ শাহিদা পারভীন, ডিআর ইনচার্জ মোর্শেদা বেগম, এ-ওয়ার্ড ইনচার্জ শিউলি, প্যারা ওয়ার্ড ইনচার্জ রাশিদা বেগমের নাম বলেন। কর্তৃপক্ষ তিনজনকে চার্জ ছাড়তে বাধ্য করলেও ডিওটি ইনচার্জ অজ্ঞাত কারণে পার পেয়ে যান। এমনকি তাকে শোকজও করা হয়নি। এ ছাড়া ইনচার্জরা ইনডেক্স খাতায় চাহিদা দেন একরকম আর স্টোর থেকে মালামাল রিসিভ করেন আরেক রকম। কম মালামাল সরবরাহ করেও লেজার খাতা মেইনটেইন করে থাকেন ঠিকঠাক। ফলে ধরার কোনো উপায় থাকে না। এসব ইনচার্জদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায় করেন কথিত নার্স নেতা আলমগীর, সুধন বৈদ্য, নার্সিং সুপারভাইজার মোমেনা খাতুন ও তন্দ্রা মজুমদার। আর প্রশাসনকে ম্যানেজ করার দায়িত্বে রয়েছেন সাবিত্রী রানী চক্রবর্তী।  খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের ইনচার্জের মধ্যে জরুরি বিভাগে আঁখি বেগম ৬ বছর এবং প্যারা ওয়ার্ডে ৪ বছরসহ মোট ১০ বছর দায়িত্বে আছেন। ডিআর ওয়ার্ডে রহিমা খাতুন ২ বছর, ডিওটিতে শাহিদা বেগম ১৫ বছর, রেজিনা ব্যাপারী ডিআর ওয়ার্ড ও সিডি ওয়ার্ড মিলে ১৬ বছর, ২য় তলা পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে আনোয়ারা বেগম ৫ বছর ধরে ইনচার্জে আছেন। কেবিন ব্লক, ই-এফ মিলে ২০ বছর ধরে ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করছেন শামীমা বেগম। এছাড়া ইনচার্জ হিসেবে ইসিজি রুমে ফরিদা পারভীন ১০ বছর, বি-ওয়ার্ডে মাজেদা বেগম ৬ বছর, আইজে ওয়ার্ডে সেলিনা পারভীন ১৩ বছর, ৪র্থ তলা ওটি-তে কনিকা হালদার ১১ বছর, ৪র্থ পোস্ট অপারেটিভে রিনা আক্তার ৫ বছর, আইসিইউতে শাহনাজ বেগম ৯ বছর, এক্স-রে বিভাগে মঞ্জুরুল ইসলাম ১৭ বছর, প্যাথলজি বিভাগে দেলোয়ার হোসেন ১৪ বছর, ব্লাড ব্যাংকে খালেদ কায়সার ২১ বছর, খাদ্য বিভাগে রবিউল হাসান ১৯ বছর, মেডিসিন স্টোরে তপন সরকার ১৯ বছর, জেনারেল স্টোরে সিদ্দিক মিয়া ১০ বছর, অর্থবিভাগে নজরুল ইসলাম ১৭ বছর, আইসিটি বিভাগে লতিফ সরকার ২১ বছর ধরে একই দায়িত্বে আছেন। অফিস ইনচার্জের দায়িত্বে মাহফুজুল হক তালুকদার রয়েছেন ৮ বছর। এদিকে, একই ব্যক্তি একই স্থানে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বে থাকার সুবাদে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছেন। অধিক অবৈধ আর্থিক সুবিধাসম্পন্ন স্থানে ডিউটি পেতে সাধারণ নার্সরা বিশেষ করে পুরুষ নার্সরা প্রতিযোগিতা করে থাকেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ এবং ডাটি রিকোভারী- এই তিন জায়গায় রোস্টার পেতে পুরুষ নার্সরা প্রতিযোগিতা করেন। এসব জায়গায় দায়িত্বপালন করে তারা রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। সংশ্লিষ্ট ইনচার্জদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে তারা এসব বিভাগে কাজ করে থাকেন।  খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, বহির্বিভাগে আতিয়ার রহমান, আমিনুল ইসলাম, আলমগীর, পংকজ, সুধন বৈদ্য ৭-৮ বছর ধরে কাজ করছেন। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে জরুরি বিভাগে কাজ করছেন আবদুল মান্নান, গোলাম মোস্তফা, বাবুল মিয়া। সিডি ওয়ার্ডে ১৫ বছর ধরে আছেন হেলাল উদ্দীন, আবু সাঈদ। বাতেন মিয়া, শামসুল ইসলাম, নূরনবী ১৮ বছর ধরে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কাজ করে যাচ্ছেন ডাটি রিকোভারি ওয়ার্ডে। বি-ওয়ার্ডে ১০ বছর ধরে আছেন হারুনুর রশীদ, এমএ কাইয়ুম, জনাব আলী, ফয়সাল মিয়া ও কবির হোসেন। এদিকে বছরের পর বছর ইনচার্জ হিসেবে একই ব্যক্তি দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নজরে এসেছে খোদ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের। তাদেরকে সরিয়ে সিরিয়াল অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন করতে বিভিন্ন হাসপাতালকে চিঠি দিয়েছে তারা। চলতি বছরের ১৬ই জুন দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়- স্টাফ নার্স, সিনিয়র নার্স, নার্সিং সুপারভাইজার ও অন্যান্য নার্সিং কর্মকর্তাদের প্রতি দুই বছর অন্তর ওয়ার্ড ইনচার্জের দায়িত্ব পরিবর্তন করে যারা ইতিপূর্বে দায়িত্ব পালন করেননি তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের নিমিত্তে দায়িত্ব অর্পণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলো। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কোনো কোনো হাসপাতালে এ নিয়ম সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে না। এমনকি কোনো কোনো নার্স দুই-এর অধিক বছর ধরে ওয়ার্ড ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করে আসছেন, যা আদৌ কাম্য নয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ওয়ার্ড ইনচার্জের মেয়াদ দুই বছর পূর্ণ হলে আবশ্যিকভাবে তাকে এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। এক ওয়ার্ডের দায়িত্ব পরিবর্তন করে অন্য ওয়ার্ডে দেয়া যাবে না। ওয়ার্ড ইনচার্জের দায়িত্ব প্রদানকালে সিনিয়রিটি প্রাধান্য দিতে হবে এবং সিনিয়র নার্স থাকাকালে কোনো জুনিয়র নার্সকে দায়িত্ব দেয়া যাবে না। কর্মরত সকল নার্স পর্যায়ক্রমে ওয়ার্ড ইনচার্জের দায়িত্ব পালন না করা পর্যন্ত ইতিপূর্বে দায়িত্বপালন করা কোনো নার্সকে পুনঃদায়িত্ব দেয়া যাবে না। একই হাসপাতালে দুই মেয়াদের বেশি ওয়ার্ড ইনচার্জের দায়িত্ব দেয়া যাবে না। প্রতিবছর শেষে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ার্ড ইনচার্জের তালিকা ডিজিএনএম-এ প্রেরণ করতে হবে।  চিঠিতে আরো বলা হয়, কেউ দায়িত্ব হস্তান্তরে অনীহা প্রকাশ করলে বা দুই মেয়াদের বেশি থাকলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন, যা ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গৃহীত হবে।    এ নির্দেশনার কিছুদিন পর নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন, শিক্ষা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ আবদুল হাই স্বাক্ষরিত আরেক চিঠিতে দুই বছরের অধিক দায়িত্ব পালন করা নার্সদের তালিকা চাওয়া হয়। তবে এসব নির্দেশনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে, এ নির্দেশনা জারির পর নার্সিং সুপারভাইজার মোমেনা খাতুন, তন্ত্রা মজুমদার ও সাবিত্রী চক্রবর্তীর (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ও কথিত নার্স নেতা আলমগীর এবং সুধন বৈদ্য পঙ্গু হাসপাতাল প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলতি দায়িত্বে বহাল রয়েছেন। সিন্ডিকেটটি আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ডিআর, সিআর, জরুরি বিভাগ, ডিওটি, সিওটিতে চার্জ বণ্টন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। চার্জ বণ্টনে সিনিয়র-জুনিয়র বাছ-বিচার করা হয়নি বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। আর এসব কিছুর দেখভাল করেন অফিস ইনচার্জ মাহফুজুল হক তালুকদার। দীর্ঘদিন ধরে ইনচার্জের পদে বহাল থাকার কারণ জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক আবদুল গণি মোল্লা বলেন, ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বিভাগে ইনচার্জ পরিবর্তন করা হয়েছে। কবে নাগাদ পরিবর্তন করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা মেট্রনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করুন। এ ব্যাপারে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। এও বলেন, চাইলেই ফটাফট পরিবর্তন করা যায় না। অনেকে ইনচার্জের দায়িত্ব নিতে চায় না, বিশেষ করে অপারেশন থিয়েটারের। এদিকে পরিচালক কিছু কিছু বিভাগে পরিবর্তন করা হয়েছে দাবি করলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তা করা হয়নি। বরং ফাইল গেলে তিনি স্বাক্ষর করেননি এমন অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনেকেই ইনচার্জের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘদিন ধরে একই ব্যক্তি ইনচার্জ পদে বহাল থাকার কারণ জানতে চাইলে হাসপাতালের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট (মেট্রন) হাসনে আরা আক্তার বলেন, কারণ কিছুই না, প্রশাসনিক জটিলতা। সব স্যারের টেবিলে দেয়া আছে। স্যার স্বাক্ষর করলেই হয়ে যাবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে