
ছবি সংগৃহীত
অনন্য স্বাদের ‘কুমড়া বড়ি’
আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:১৬
কুমড়া বড়ি তৈরি শেষে তা রোদে শুকাতে হয়। ছবি: প্রিয়.কম
(পবিত্র তালুকদার, চাটমোহর, পাবনা) চাল-কুমড়ার মিশ্রণ থাকায় সম্ভবত এর নাম হয়েছে ‘কুমড়া বড়ি’। শীত মৌসুমের শুরুতে চলনবিল অঞ্চলে কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম লেগেছে। তবে পাবনার চাটমোহরের কথা একটু আলাদা। এখানে পৌর শহরে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার কুমড়া বড়ি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এ ছাড়াও উপজেলার বেশ কিছু জায়গায় তৈরি হয় অনন্য স্বাদের এই কুমড়া বড়ি।
চলনবিলের দেশি প্রজাতির কৈ, মাগুর, শিং, শৈল, আইড়, গজারসহ মাছের তরকারি রান্নায় স্বাদে বৈচিত্র আনতে ব্যবহার করা হয় এই কুমড়া বড়ি। গ্রাম এমন-কি শহর এলাকার মানুষের নিত্যদিনের ব্যঞ্জনের অতিপ্রিয় অনুষঙ্গ এই কুমড়া বড়ি। আবহমান গ্রামবাংলার তৈরি সুস্বাদু এই খাবারের নাম শুনলেই বাঙালিদের জিহবায় পানি আসে।
সুস্বাদু ও মজাদার তরকারির এ উপাদানটি তৈরি করতে অবশ্য বেশ পরিশ্রম করতে হয়। বিশেষ করে বাড়ির গৃহিণীরা এই কাজে পারদর্শী এবং কুমড়া বড়িগুলো মূলত তারাই তৈরি করে থাকেন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু হয় কুমড়া বড়ি দেওয়ার কাজ। মূলত আশ্বিন মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত কুমড়া বড়ি দেওয়ার উপযুক্ত সময়। এই কয়েকমাস ওই এলাকায় বড়ি তৈরির ধুম লেগে যায়।
পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ডাল ভিজিয়ে মেশিনে গুঁড়ো করে বাড়িতে আনেন। পরে বড় গামলা বা বালতিতে ডালের গুঁড়ো, পাকা চালকুমড়া, কালোজিরা, গোল মরিচ এবং আরও কিছু মশলা মিশিয়ে সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়। এরপর টিনের বা কাঠের পিঁড়িতে সরিষার তেল মাখিয়ে বড়ি করে সাজিয়ে শুকাতে দেওয়া হয়। ৩/৪ দিন কড়া রোদে শুকিয়ে প্রস্তুত করা হয় সুস্বাদু অনন্য স্বাদের কুমড়া বড়ি।
বাড়িতে চলছে কুমড়া বড়ি তৈরির কাজ, ছবি: প্রিয়.কম
এ কাজে নারীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। তবে অনেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রতি কেজি ৭ টাকা দরে কুমড়া বড়ি দিয়ে দেন। একজন নারী গড়ে প্রতিদিন ২০ কেজি ডালের বড়ি দিতে পারেন। এতে করে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। বাড়ির দৈনন্দিন কাজেও কোনো অসুবিধা হয় না, কারণ ভোর থেকে শুরু করে সকাল নয়টার মধ্যে বড়ি দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়। ৩/৪ দিন রোদে শুকানোর পর সেগুলো বাজারজাত করা হয়।
চাটমোহর পৌর এলাকার দোলং মহল্লার কুমড়া বড়ি প্রস্তুতকারী ঊষা রানী ভৌমিক জানান, ‘প্রায় ৫০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। একটা সময় অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে আমাদের। আগে সারাদিন ডাল ভিজিয়ে রেখে শিলপাটা দিয়ে বেটে বড়ি দিতে হতো। এতে করে সময় লাগতো অনেক বেশি। এখন শিলপাটার বদলে ডালগুলো মেশিন দিয়ে ভাঙানো হয়। এতে করে আমাদের খাটুনি কমেছে ও সময় বেঁচে যাওয়ার কারণে বড়ি দিতে পারছি বেশি। শীত মৌসুমে এই বড়ি তৈরি করে সংসারে বাড়তি কিছু আয় করাও সম্ভব হচ্ছে।’
কুমড়া বড়ি বিক্রেতা সুনীল সরকার ও প্রদীপ ভৌমিক জানান, ‘আকারভেদে প্রতিটি বুড়ো চালকুমড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে কিনতে হয়। এ ছাড়াও ৭৫ টাকা কেজি খেসারি ডাল, অ্যাংকর ডাল ৪০ এবং ১০৫ টাকা কেজি দরে মাশকলাই ডাল কিনে কুমড়া বড়ি তৈরি করে থাকি। প্রতি কেজি ডাল থেকে সাড়ে ৭শ’ থেকে ৮শ’ গ্রাম বড়ি তৈরি হয়। বাজারে খেসারি ডালের বড়ি ৯০ থেকে ১০০ টাকা, অ্যাংকর ডালের বড়ি ১০০ থেকে ১২০ টাকা এবং মাসকলাই ডালের বড়ি ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকি। তবে অ্যাংকর ও মাসকলাইয়ের ডালের বড়ির চাহিদা একটু বেশি থাকে।’
শুকানোর অপেক্ষায় কুমড়া বড়ি। ছবি: প্রিয়.কম
প্রদীপ ভৌমিক জানান, ‘কুমড়া বড়ি তৈরি এবং বিক্রি করে শীতকালে আমাদের ঘরে মোটামুটি একটা আয় আসে। আর এ সময়জুড়ে বাজারে কুমড়া বড়ির যথেষ্ট চাহিদাও থাকে। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা আসেন কুমড়া বড়ি কিনতে। তবে পাইকারি দাম কিছুটা কম নেওয়া হয়। এ ছাড়া অর্ডার দিয়ে বানালে খরচটা আরও বেশি পড়ে। তবে পাটায় বাটা ডালের বড়ির কদর সবসময় একটু বেশি থাকে।’
শুধু গ্রামাঞ্চলেই নয়, শহরের মানুষও আজকাল কুমড়া বড়ি পছন্দ করতে শুরু করেছে। চাটমোহরের উৎপাদিত কুমড়া বড়ি স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে জেলা শহর হয়ে এখন রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের কাঁচা বাজারগুলোতে স্থান করে নিয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের হাতঘুরে কুমড়া বড়ি এখন প্রবাসী বাঙালিদের রসনা তৃপ্ত করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় অনন্য স্বাদের এই কুমড়া বড়ি বিক্রি করে স্বচ্ছলতা এসেছে অনেক পরিবারে।
প্রিয় সংবাদ/জাহিদুল ইসলাম জন/তানজিল রিমন