কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

‘আহত মেঘের ধ্বনি’ বইয়ের প্রচ্ছদ ও ফরহাদ হাসান চৌধুরী

ফরহাদের কবিতায় দর্শন ও প্রস্তাবনা

সালাহ উদ্দিন শুভ্র
লেখক, সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:২৪
আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:২৪

কবিতা ব্যক্তি কবির প্রস্তাবনা আকারে হাজির থাকে পাঠকের সামনে। কবিতা নিছক রূপের উপস্থাপনা অথবা নিসর্গের সঙ্গে মিতালি, নিজের একলা ঘরের গহীন কোণে বসে নিজের দুঃখ ও বিষাদের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার কাব্য হয়ে থাকে না শেষ পর্যন্ত। আর কবিতার ‘অর্থ’ তৈরির ক্ষমতা তাকে দুর্বল কবিতা থেকে আলাদা করে। যে প্রস্তাব কবিতায় গুপ্ত থাকে তা তাকে বাঁচিয়ে রাখে—কাউকে বেশি, কাউকে কম।

ফরহাদ হাসান চৌধুরীর ‘আহত মেঘের ধনি’ কবিতার বইটি একটি প্রস্তাবনা হিসেবে প্রতিভাত হবে পাঠকের সামনে। তার প্রস্তাবনায় থাকছে মানুষ ও কবিতা। মানুষের অন্দর এবং বাহির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও প্রায় সত্তর বছর পরের মানুষ। বিশ্বায়ন, প্রযুক্তিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ এর মধ্যে থাকা ব্যক্তি মানুষের প্রস্তাব। সেই মানুষের মধ্যে কবি নিজে কীভাবে বেঁচে আছেন সে বিষয়ে আঁচ পাওয়া যাবে। কবিতা কী, কাকে বলে কবিতা, কবিতা যে ভাব অথবা ভঙ্গি আকারে থাকে ব্যক্তির মধ্যে সেই প্রস্তাব আমরা পাব তার বইয়ের দ্বিতীয় কবিতায়। ‘কবিতার ভ্রুণ রাঙিয়ে বসে/আছি, হাজার বছরের পুরনো বিছানায়/বাইরে আমি, ভেতরেও আমি; কী মন্ত্রে/এমন বেঁধেছ সাঁই; কি অদৃষ্ট আঁধারে নিবৃত্ত/গহীনে, দেহের ভেতর আটকে রেখেছ শ্বাস’ (ভাব ধরে আছি)।

দেহের মধ্যে শ্বাস আকারে কবিতা থাকার যে দর্শন দেখিয়েছেন ফরহাদ হাসান, তা আমাদের বাংলা অঞ্চলের দেহতাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। দেহের ভেতর এক ‘অচিন পাখি’ হিসেবে কবিতার এই এক আসা-যাওয়া। কিন্তু এই আসা ও যাওয়ার কালে এক নিরন্তর ‘আমি’র উপস্থিতি। ভেতরে ও বাইরে কেবল আমি। আমি’র মধ্যে আমার এই কুরে-কুরে মরার সংকট কবিতা আকারে প্রকাশ পায়। তবে এই আমি হাজার বছরের পুরানা বিছানায় বসে থাকে। পরম্পরার সঙ্গে কবিতার সংযুক্তি আছে। অর্থাৎ সে বায়বীয় নয়, উন্মুল নয়। বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

তবে কবিতায় কাব্যিকতা থাকতে হয়। ভাবালুতায় পেয়ে বসে কবিকে। নিঃসীম এক একাকিত্ব গ্রাস করে। কবিকে হয়তো অস্তিত্বের এক সংকটময় অবস্থায় চলে যেতে হয়। ‘নিজের পাঁজর রাঙিয়ে তুলছি/ধার করা নক্ষত্রে; আলো জ্বলছে/আলো, অন্য কারও আগুনে/সময়ে-অসময়ের চাঁদ হাতড়ে/বাম আস্তিনে; পড়ে আছি ঈশ্বরের/মতো, একাকিত্বের ভান ধরে’ (ভাব ধরে আছি)।  নিজেকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। নিজের পাঁজর রাঙিয়ে ওঠে ধার করা নক্ষত্রে, অন্যের আলো, অন্যের আগুন। অগম্য এক অবস্থা ও দৃশ্যকে শব্দ ও কাব্যে ফুটিয়ে তুলতে তুলতে তা কবিতায় হয়ে ওঠে, হয়তো হঠাৎ করেই।

ঈশ্বরের বিলাপ কবিতায় আছে, ‘দেখো গোধূলির মতো/মানুষ হেলে পড়েছে হৃদয় থেকে জমিনে/দেখো ঘর হারিয়ে ঈশ্বর, বুকেই কেঁদে ওঠে নির্জনে/তুমি কবিতা পড়ো/পড়ো ঈশ্বরের বিলাপ/পড়ো পাণ্ডুলিপি, ভেবে পড়ো’—কবিতা এখানেও পরম্পরা বজায় রাখছে দেখা যায়। মানুষের কারবার হয়ে উঠছে তা। তার সঙ্গে যোগাযোগ ‘ঈশ্বরের’।

তার বাক্য গঠনে নেই শব্দের বাহুল্য। হৃদয়ের মধ্যেই ঘটে যাচ্ছে কবিতা। হৃদয়ের মানচিত্র তার সীমানা। কবিতাকে ফরহাদ হাসান অদ্ভূত অনুরণনের এক অনুভূতি করে তুলছেন। পড়তে পড়তে পাঠকের মনে এক আকুলি-বিকুলি শুরু হয়ে যাবে। মনে ডাকবে হলাহল। কারণ সেসব দৃশ্য, যা কবিতাতেই সম্ভব। শব্দের ব্যবহারে, রূপকে রূপকে। কিন্ত শেষ পর্যন্ত তার কবিতা চূড়ান্ত অর্থ ধারণ করছে না। চূড়ান্ত অবয়ব দিচ্ছে না। একটা অনুভূতিকেই উসকে দিচেছ, এক ভালো লাগাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আর বারবার অস্তিত্বকে ফেলে দিচ্ছে সংকটের মধ্যে। ‘কে’ কবিতায় সরাসরি বলা আছে, ‘শুভ্র সবুজে তেড়ে ওঠা খেয়াল, নির্লিপ্ত চোখে/অস্থির হয়ে বিড়বিড় করি, আত্মকীর্তন/দিন দুপুর থেমে থাকে/নিজেকে ভেবে কী দেখি/কাকে দেখি’।

জানা নেই কাকে দেখি। কিন্তু এই প্রশ্নের মধ্যে পাঠকে ছেড়ে দেন কবি। তারপর চলে যান অন্য কবিতায়। যদিও ফরহাদের কবিতায় ছন্দবদ্ধতা নাই। তার কবিতা দমের পরীক্ষা নেয়। দাড়িবিহীন। একটানা পড়ে যেতে হয়। অনেক উত্থান আর পতন ঘটে। পাঠককে নিয়ে যায় কোনো এক আবিষ্ট পরিবেশে। যেখানে একই সঙ্গে অস্তিত্বের ভার ভর করে আবার নিজেকে নিজে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় নিরুত্তর অথচ অমোঘ সব প্রশ্নের সামনে। খুব বেশি নাম করেননি যিনি কবিতায়, তার চিন্তার গভীরতা, কাব্যশক্তি মুগ্ধ করবে পাঠককে। তার কবিতায় রয়েছে স্থানীয় মিথের ব্যবহার। সংস্কৃতজাত শব্দের ব্যবহারেও রয়েছে পারঙ্গমতা। মিথের সঙ্গে ভাঙাগড়ার একটা খেল কবিতাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে।

আহত মেঘের ধ্বনি
প্রকাশক : চৈতন্য প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: রাজিব দত্ত 
বইমেলা স্টল নম্বর: ৬০৪-৬০৫

প্রিয় সাহিত্য/সিফাত বিনতে ওয়াহিদ