স্বজন হারানো এক নারী রানা প্লাজার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছবি: সংগৃহীত
অভিসম্পাত
আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৮, ২০:১০
‘আল্লাহ রে, এইডা কী অইল রে...’ সেলিনার মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে মুহূর্তেই চারপাশের মানুষ সব ভিড় করে ফেলল।
সেলিনার মা বিধবা। বছর পাঁচেক আগে হারিয়েছে স্বামীকে। টানাটানির সংসারে তিনটা মেয়ে নিয়ে আরও বিপদে পড়ে যায় সেলিনার মা। বড় মেয়েটার বয়স সবে তের কি চৌদ্দ। অভাবের সংসারে নিজের আর তিনটা মেয়ের পেটের যোগান একা একা করতে না পেরে বড় মেয়েটাকে বাড়ির কাছেই পরিচিত একজনের বাসায় কাজে পাঠিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মা। বাড়িওয়ালার ছোট মেয়েটার দেখাশোনা ও সংসারে টুকটাক কাজ করবে। থাকা-খাওয়া ও সাথে মাসে ৫০০ টাকা বেতন।
এভাবে দেড় বছর কাজ করে সেলিনা। মা সারা দিন এর ওর বাড়িতে ফুটফরমায়েশ খেটে দিন শেষে যা নিয়ে আসে তা দিয়েই পরদিন দুপুর পর্যন্ত চালিয়ে দেয় কোনো রকমে। সাথে মাস শেষে সেলিনার ৫০০ টাকা।
তবুও কিছুতেই কিছু হয় না। ছোট বোনটাকে লেখাপড়া করানোর খুব শখ। ক্লাস সিক্সে পড়ে বোনটা। ‘লেখাপড়ার খরচ যা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে হবে না।’, ভাবে সেলিনা। বাচ্চা দেখাশোনার চাকরিটা ছেড়ে পালিয়ে চলে আসে। মেজো বোনকে সাথে নিয়ে পাড়ি জমায় ঢাকা শহরে। শুনেছে শহরে অনেক কাজ, অনেক টাকা। একটা চাকরি জুটিয়ে নিলেই হলো। মাস শেষে বেতন, খেয়ে-দেয়ে যা থাকবে মাকে পাঠিয়ে দেবে দুবোন। ছোট বোনটাকে নিয়ে আর কষ্ট করতে হবে না মায়ের।
এমন একটি সাদামাটা স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় উঠে দুবোন। এক আত্মীয়ের সহায়তায় একটা গার্মেন্টসে কাজ পেয়ে যায়।
অনেক খাটুনি গার্মেন্টসের কাজে, বেতন কম। তাতে কী? মাস শেষে একজনের ৪ হাজার টাকা। অনেক ভালো। দুবোন মাস শেষে ২ হাজার করে ৪ হাজার টাকা মাকে পাঠায়। অভাবের সংসারে একটু সুখের ছোঁয়া লাগে। ‘আহ-হারে! সেলিনার বাপ যদি থাকত। সারা জীবন কষ্ট করেছে বেচারা।’, মনে মনে ভাবে সেলিনার মা। এত কষ্ট! শেষ দিকে তো স্বামীটারে ওষুধ খাওয়ানোর সামর্থ্যও ছিল না। ওষুধতো পরের কথা দুবেলা ভাত জোটাতেই কত কষ্ট করতে হতো।
সন্ধ্যা হলেই বড় আর মেঝো মেয়েটা পাতিল নিয়ে বের হতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাত তরকারি চাইতো। দয়াপরবশ হয়ে যে যা পারত দিত। কত এঁটো-ঝুটা খেয়েছে এ জীবনে! ঘণ্টা দুয়েক গেলেই মা গিয়ে কুপি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত বাড়ির সামনে বাঁশ ঝাড়টার নিচে। উৎকণ্ঠায় কাটত এই সময়টা, কিন্তু কিছু করার ছিল না। এ দিয়ে কোনো রকমে রাত আর সকালটা কাটাতে পারলেই হলো। এমই ছিল সে দিনগুলো। আর এখন- এঁটো ঝুটা খেতে হয় না। মা মেয়ের কোন রকম পেট চলে যায়। ছোট মেয়েটা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এ বছর। ওরাও আছে- খারাপ না, ভালোই। বড় মেয়েটার বয়স হয়েছে, মেজোটার ও। বিয়ে দেয়া দরকার। কিছু টাকা জমিয়েও ফেলেছে। এ দিয়ে, সাথে মানুষের কাছে চেয়ে কোনো রকমে বিয়ে দেওয়া যাবে। ঈদে বাড়ি আসলে এ নিয়ে মেয়েদের সাথে কথা বলা যাবে। কত স্বপ্ন মায়ের মনে!
সেই মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ আজ আকাশ-বাতাসকে ভারী করে তুলেছে। একটু আগে ঢাকা থেকে কে একজন ফোন করে বলেছে মেয়ে দুইটা যেখানে কাজ করে সেই বিল্ডিংটা ধসে পড়েছে। দুজনই ভেতরে চাপা পড়েছে। মেজো মেয়েটাকে বের করে এনেছে একদিন পর তবে পা নাড়ানোর শক্তি নেই তার। থেঁতলে গেছে সব। আর বড় মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই। চাপা পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপের নিচে।
মায়ের স্বপ্নও চাপা পড়ে যায় মেয়েদের মতো। কোনো অভিযোগ না, অভিসম্পাত না। শুধু জানতে চায়-এই কী হল? তার আর্তনাদ আকাশ-বাতাস ভেদ করে যায় বিশ্বকর্তার কাছে। বিশ্বকর্তা কী শুনছেন?
প্রিয় সাহিত্য/কামরুল