কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

গত ২১ মে ঢাকা থেকে শেরপুরে ফেরার পথে খুন হন তরুণ সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। ছবিটি ফাগুনের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া

মুখ ভার দেশটার ঠোঁটে তোদেরই হাসি ফোটাতে হবে, ফাগুনকে বাবার তৃতীয় চিঠি

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ২১ আগস্ট ২০১৯, ১৮:২৬
আপডেট: ২১ আগস্ট ২০১৯, ১৮:২৬

দিনাজপুর থেকে ট্রেনে চেপে ঢাকায় যাত্রা করেছিল এক তরুণ। ঢাকায় তার কলেজ খুলে গিয়েছে। তাই ফিরতে হচ্ছিল ঈদের ছুটি শেষে। পার্বতীপুর এসে জানালো মাকে, ‘ট্রেনে ভিড়, আমি ট্রেন থেকে নেমে যাচ্ছি।’ মাকে চিন্তা করতে মানা করেছিল ওই তরুণ। তারপর থেকেই সেই তরুণের সেলফোনটি বন্ধ। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। স্রেফ হাওয়া গিয়েছিল সে। তার বাবা-মা তাকে ফিরে পেতে আকুতি জানিয়েছেন।

খবরটা যখন গণমাধ্যমে পড়ছিলাম, তখন চোখে ভাসছিল তোর ছবি। ফাগুন বাবা আমার, তোকে তো আমরা তবু পেয়েছিলাম। জীবিত পাইনি, কিন্তু পেয়েছিলাম তো। তুইও তো নিখোঁজ ছিলি। তারপর তোকে পেলাম রেললাইনের ধারে।

জানি না, সেই তরুণ ছেলেটিকে তার বাবা-মা পেয়েছেন কিনা। নাকি তাকেও তোর মতো বেওয়ারিশ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তুই নিজে গণমাধ্যমের মানুষ। তোর এই বাবাও খুব অপরিচিত নয় গণমাধ্যমে। তারপরেও তোকে পরিচয়হীন করার চেষ্টা হয়েছিল। কেন হয়েছিল, কারা করেছিল, সে সম্পর্কে এখনো অন্ধকারে আমরা।

ফাগুন বাবা, তুই তো গণমাধ্যমে ছিলি। বলতো দেখি, যে তরুণটি নিখোঁজ হয়ে গেল, তার বাবা-মা তাকে পেল কিনা, এমন খবরটা গণমাধ্যমে কেন নেই। গণমাধ্যমের দায়িত্ব তো ছিল সেটা জানানোর, ফলোআপ দেওয়ার। তন্নতন্ন করে খুঁজেছি কোথাও পাইনি ওই তরুণের কি হলো? বাবা-মার কোলে ফিরে গেল কিনা। নাকি আমাদের মতন চোখের পানি সঙ্গী হলো সেই বাবা-মার; জানা নেই, জানতে পারিনি।

তোকে তো তা-ও কিছু হৃদয়বান মানুষ মনে করেন। ফলোআপে রাখার চেষ্টা করেন। তুই চলে যাবার তিন মাস হবার পরও, তোকে নিয়ে কথা বলেন তারা। দেখ তো, তোর মতন কত তরুণ হারিয়ে যাচ্ছে, নিখোঁজ হচ্ছে, কই তাদের খোঁজ তো কেউ রাখে না। জানি, এ ব্যাপারগুলো তুই মেনে নিসনি, মেনে নিতে পারিসনি। তুই ফলোআপকে গুরুত্ব দিতি। তোর যে রিপোর্ট নিয়ে এত হুলুস্থুল। সেই ‘প্রান্ত’র নিহত হওয়ার বিষয়ে রিপোর্ট করার পরও তুই ফলোআপের চিন্তা করছিলি। আর তোকে ফলো করছিল আততায়ী।

আজকে ‘ই-সাউথ এশিয়া’র সাথে কথা হচ্ছিল তোকে নিয়ে। তোকে দূর থেকেই যিনি ভালোবাসতেন, সেই খ্যাত মানুষ মাসকাওয়াথ আহসান যখন তোকে সম্বোধন করছিলেন তরুণ সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ওরফে ফাগুন রেজা বলে, তখন বুকটা ভরে উঠছিলরে বাবা। এত কম বয়সে নিজের পরিচয় তৈরি করা খুব সহজ কথা নয়। একটা রিপোর্ট তৈরি বা ডেস্কে এডিটর হিসেবে কাজ করা, তা-ও ইংরেজিতে সত্যিই সহজ কথা নয়রে বাবা। কিন্তু তোর কাছে তো ছিল সবই পানির মতন। কঠিনতম কাজটাও হাসিমুখে করে দিতি তুই। নিজেরটা তো বটেই, কখনো অন্যেরটাও।

মাসকাওয়াথ আহসান বলছিলেন, তোর চলে যাবার শোকটাকে নাকি আমি শক্তিতে পরিণত করেছি। উনি কি জানেন, এই শক্তিটা তোর কাছ থেকেই ধার করা। তুই কখনো সততার প্রশ্নে, অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াসনি। আপোষ করিসনি। মাত্র একুশ বছরে তুই যদি পেরে থাকিস, তাহলে বাবা আমি কেন পারব না। তুই যদি মৃত্যুর ভয় না করতে পারিস, তাহলে আমি কেন ভয়ে গুটিয়ে থাকব। কেন বলতে পারব না, তরুণেরা যারা আছে তারা সবাই আমার ফাগুন! গণমাধ্যমে যারা তোর বয়সী রয়েছে তারা সবাই এক একটা ফাগুন! আমি আমার প্রতিটা ফাগুনের জন্যেই লড়ে যেতে চাই। তোর মতো সৎ-সাহসীদের বড় প্রয়োজন এই দেশটার। আপোষকামী আর ন্যুব্জদের ভিড়ে মুখ ভার দেশটার ঠোঁটে তোদেরই হাসি ফোটাতে হবে যে।

তোর মা-ও তোকে নিয়ে গর্ব করেন। আমাকে বলেন, ‘দেখো বলেছিলাম না, আমার বাবা বিখ্যাত হবে।’ তুই অবশ্যই বিখ্যাত হয়েছিস। তা না হলে দেশ-বিদেশের কত মানুষ আজ তোকে চিনে, তোর জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তুই কি জানিস, তোর ছোটেও এখন তোর মতো হতে চায়। তোকে তার আইডল মানে। অথচ কি ঝগড়াই না ছিল তোদের দুজনের। শুধু ছোটে নয়, আমিও তোকে আইডল মানি বাবা। তোর রুখে দাঁড়ানোর অদম্য সাহস আমার শিরদাঁড়াকে সোজা রাখতে ভরসা জোগায়।

আমি এবং তোর মা প্রতিদিন বিকালে তোর কাছে যাই। তোর শিয়রের পাশে বসে তোর মা প্রার্থনা করে। দীর্ঘ প্রার্থনা। আমিও করি। জানি না, তুই মাটির ঘরে শুয়ে থেকে প্রার্থনা আর কান্নার শব্দ শুনতে পাস কিনা। আমাদের কান্না তো দূরের কথা সামান্য মুখভারও তোর পছন্দ ছিল না। অথচ তোর কাছে গিয়ে প্রতিদিন আমাদের চোখের পানি ঝরে। বাবা হিসেবে হয়তো অশ্রু ঝরাটাই সঙ্গত, তবে মানুষ হিসেবে তোর কাছ থেকে ফিরি ঝরঝরে মনের এক সাহসী মানুষ হয়ে। তোর মতো সোজা শিরদাঁড়া নিয়ে। আপোষহীন থাকার মন্ত্র নিয়ে।

ভালো থাকিস বাবা, ওপারে আনন্দনগরে। দেখিস আমি-আমরা লড়ে যাচ্ছি তোর চিন্তাকে সামনে রেখে এপারের বিপন্ন ও বিষাদের জনপদে।
—তোর আব্বুজি, কাকন রেজা।