জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ছবি: সংগৃহীত
কে হচ্ছেন জাপার কান্ডারি, কারা পাচ্ছেন এরশাদের সম্পদ?
আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৯, ১২:৪৮
(প্রিয়.কম) জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবনাবসান হয়েছে। তার মৃত্যুর পর নতুন করে আলোচনায় সূত্রপাত হয়েছে, এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কান্ডারি বা চেয়ারম্যান কে হচ্ছেন। আর তার রেখে যাওয়া সম্পদই বা কারা কারা পাবেন। দলের নীতি-নির্ধারণী কমিটিতে কোনো যোগ-বিয়োগ হচ্ছে কিনা।
১৪ জুলাই, রবিবার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কে হচ্ছেন জাতীয় পার্টির কান্ডারি?
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পরে দলের হাল ধরা নিয়ে পূর্বেই কয়েকবার বিভক্ত হয়েছিল জাতীয় পার্টি। ভাই জিএম কাদের ও বর্তমান স্ত্রী রওশান এরশাদের গ্রুপিংয়ের বিষয়টি দল ছাড়িয়ে মিডিয়াতেও এসেছিল তখন। পার্টির চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান বদল নিয়েও হয়েছে তুলকালাম।
এরশাদের অবর্তমানে দলের মধ্যে নেতৃত্বে নিয়ে সংকট তৈরি হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
এদিকে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা আবার রাজনীতিতে ফেরার কথা বলছেন। বিদিশা বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টির কর্মীরা আমার সন্তানের মতো। এই মহাজোট আমার হাত দিয়েই গড়া। যার কারণে বিএনপি আমাকে থাকতে দেয়নি। জাতীয় পার্টির একটি গ্রুপ ছিল যারা তখন বিএনপির পক্ষে কাজ করত। তারা এখনো এই সরকারের সঙ্গেও সক্রিয় রয়েছে। আমি আবার জাতীয় পার্টিতে ফিরতে চাই।’
দুই কান্ডারি আগে থেকে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে এগিয়ে থাকলেও বিদিশার রাজনীতিতে ফেরার সংকেত আরও সংকট তৈরি করতে পারে জাতীয় পার্টিতে।
বর্তমানে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জিএম কাদের। কিন্তু এর আগে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে চিকিৎসা শেষে ফিরেই দলের কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে জিএম কাদেরকে সরিয়ে দেন এরশাদ। ঠিক এর পরের দিন বিরোধী দলের উপনেতার পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয় সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদেরকে। এ পদে নতুন করে এরশাদ দায়িত্ব দেন স্ত্রী রওশনকে। এ ঘটনার পর থেকেই দলে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ক্ষুব্ধ হয় নেতাকর্মীরা। রংপুর বিভাগের নেতাকর্মীরা জিএম কাদেরকে সকল দায়িত্ব ফিরিয়ে দিতে এরশাদকে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন তখন।
জিএম কাদের ওই সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। এরশাদ অব্যাহতির কারণ সম্পর্কে কিছু বলেননি। তবে বলেছেন, দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া যায়।
দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই বলছিলেন, রওশনপন্থীদের চাপের মুখেই ভাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন এরশাদ। তখন থেকেই জিএম কাদের গ্রুপ ও রওশন এরশাদ গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘসময় ধরে মনমালিন্য প্রকাশ্যে আসে।
আবার এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার খবরে জাতীয় পার্টিতে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
জিএম কাদের সম্পর্কে বিদিশা বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে এরশাদের বিকল্প কেউ নেই। তার অনুপস্থিতি কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। জাতীয় পার্টি একটি ক্লান্তি লগ্ন পার করছে। তবে তার ভাই জিএম কাদের কতটুকু তার ঘাটতি পূরণ করতে পারবে তা সময়ই বলে দিবে। রাজনীতি একটি অনেক বড় জায়গা। আমি আমার স্বামীর হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলাম। আমার তো এখনো প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন জাতীয় পার্টিতে অনেকেই আসতে চায়। আমার সাথে অনেকে যোগাযোগ করছেন। অনেকে আমাকে বলে, আপা আপনি রাজনীতিতে আসেন। আপনি সক্রিয় হোন, আমরা আপনার সঙ্গে রাজনীতি করতে চাই। আগে যখন রাজনীতিতে ছিলাম, তখন অনেক কিছু বুঝতাম না। এখন অনেক কিছুই শিখেছি।’
বিদিশা বলেন, ‘এরশাদ সাহেব যে ওনার ভাইকে তার জায়গায় বসিয়েছেন এটিকে স্বাগত জানাই। আমি আশা করবো উনিও এরশাদ সাহেবের মতো সারা দেশ ঘুরবেন, সব নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করবেন। এ ছাড়া যাদের জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদেরও ফিরিয়ে আনবেন।’
কারা পাচ্ছেন এরশাদের সম্পদ?
আলোচনায় এসেছে এরশাদের সম্পদও। তার বিপুল সম্পতির মালিকানা কে বা কারা পাচ্ছেন। তার পুত্র এরিক এরশাদ, না তার প্রথম স্ত্রী রওশান এরশাদ? নাকি অন্য কেউ? তবে এরশাদ তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি একটি ট্রাস্টের নামে দান করেছেন।
গত ৭ এপ্রিল রাজধানীর বারিধারায় তার নিজের বাসভবনে পাঁচ সদস্যের এই ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে লিখিতভাবে বোর্ডকে সম্পত্তি দান করেন এরশাদ। এই ট্রাস্টের নাম কি দেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি। এরশাদ ছাড়া ট্রাস্টি বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন, এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ, একান্ত সচিব মেজর (অব.) খালেদ আক্তার, চাচাতো ভাই মুকুল ও তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
এই ট্রাস্টের সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসা, গুলশানের দুটি ফ্ল্যাট, বাংলামোটরের টাইলসের দোকান, রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় স্থাপিত পদাগঞ্জ কোল্ড স্টোরেজ, রংপুর শহরের মডার্নের নিজ বাসা পল্লী নিবাস, পিতার নামের মকবুল হোসেন হাসপাতাল, রংপুরে জাতীয় পার্টির সুবিশাল কার্যালয়, ১০ কোটি টাকার ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিট। এরশাদকে এই ট্রাস্ট গঠনের যাবতীয় কাজ তদারকি করেছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের সময় রংপুর-৩ আসনের প্রার্থী হিসেবে এইচ এম এরশাদ ইসিতে যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন তাতে তিনি বার্ষিক এক কোটি আট লাখ টাকা আয়ের কথা জানিয়েছেন।
সম্পদের বিবরণীতে তিনি আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, অনির্ধারিত ব্যবসা, বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বেতন, সম্মানীর কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও রাজধানীর গুলশান ও বনানীতে সর্বশেষ তিনি দুটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন যার মূল্য যথাক্রমে ৬ কোটি ২০ লাখ ও ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকে এরশাদের ঋণ রয়েছে ৫৬ লাখ টাকা। তিনি নিজেও এ ব্যাংকের একজন পরিচালক। ব্যাংকটি থেকে তিনি বার্ষিক ৭৪ লাখ টাকা বেতন হিসেবে পান জানান হলফনামায়।
পার্টির কয়েকজন নেতা বলেন, গত জানুয়ারিতেও একবার এরশাদ তার সমস্ত সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়েছেন বলে তারা শুনেছিলেন। তখন তার সম্পত্তির একটি বিবরণ ও কাকে কী সম্পত্তি দেওয়া হলো, এমন কথাও জেনেছিলেন।
জাতীয় পার্টির নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এরশাদ তার বড় ছেলে আল মাহিগীর শাদ এরশাদ (রওশন এরশাদের সঙ্গে থাকেন), ছোট ছেলে শাহতা জারাব এরিক (বিদিশা এরশাদের ঘরের), পালিত কন্যা জেবিন (লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন) ও ভাই-ভাতিজার মধ্যে বড় সম্পদের বড় অংশ ভাগ করে দেন। কিছু সম্পদ এরশাদের কয়েকজন পালিত কন্যা এবং কিছু সম্পত্তি পার্টির অফিস ও এতিমদের জন্য ট্রাস্টে দেওয়া হয়েছে বলেও তখন প্রচার পায়।
এরশাদের কী পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে? জানতে চাইলে পার্টির কয়েকজন নেতা জানান, রংপুরে বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তি এবং রংপুর সদরের পদাগঞ্জে কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে। গুলশান-২-এর বাড়িটি রওশন এরশাদকে দিয়েছেন এরশাদ বহু আগেই। বারিধারার ১০ নম্বর দূতাবাস রোডের ‘প্রেসিডেন্ট পার্ক’ যেখানে তিনি নিজে বসবাস করেন সেটি তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদের একমাত্র ছেলে এরিক এরশাদের নামে দেওয়া হয়েছে।
তারা দাবি করেন, পালিত পুত্র আরমানকে দেওয়া হয়েছে গুলশানের অপর একটি ফ্ল্যাট। রংপুরের সম্পত্তি পেয়েছেন তার ভাই জি এম কাদের ও এক ভাতিজা। রংপুরের জাতীয় পার্টি অফিস দলকে দান করেছেন।
নেতারা আরও জানান, কয়েক বছর আগে চলচ্চিত্র পরিচালক শফি বিক্রমপুরির কাছ থেকে কেনা ঢাকার কাকরাইলে জাতীয় পার্টির প্রধান কার্যালয়টি এরশাদের ব্যক্তিগত নামে ছিল। এটি তিনি পার্টিকে দান করেছেন। এরশাদের গুলশান বনানী এলাকায় বিভিন্ন মার্কেটে দোকান রয়েছে। এরশাদের নগদ টাকাসহ সম্পত্তি কী কী আছে তা পরিষ্কারভাবে দলীয় নেতাকর্মীরা জানেন না।
‘তবে কী পরিমাণ সম্পত্তি এরশাদের রয়েছে, তা কেউ জানে না’, বলেন পার্টির এক প্রেসিডিয়াম মেম্বার। তিনি বলেন, ‘আমরা মুখে মুখে যেটুকু শুনি, সেটুকুই। স্যার নিজেও কোনো দিন এসব নিয়ে গল্প করেন না।’
প্রিয় সংবাদ/কামরুল