কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন

ইংরেজি পত্রিকায় ভুল কেন, প্রশ্ন করেছিল ফাগুন

তানজিল রিমন
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৪ মে ২০১৯, ২১:৪৭
আপডেট: ২৪ মে ২০১৯, ২১:৪৭

একুশ পেরোনো টগবগে এক তরুণের নাম ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকত। নিজের মন খারাপ হলেও হাসি মুখেই কথা বলত। কিন্তু এমন হাসি মুখে আর কথা বলবে না ফাগুন। কোনো এক অজানা কারণে হত্যার শিকার হয়েছে সে।

ফাগুন তেজগাঁও কলেজে টুরিজ্যম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পড়াশোনা করছে। ইংরেজিতে খুব ভালো দখল ছিল তার। ইংরেজি পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদনের বাক্যে কেন ভুল হয়, এমন প্রশ্ন করেছিল সে। আমি বলেছিলাম, বাংলা পত্রিকাগুলোতেই প্রচুর বানান/বাক্যগঠন ভুল হয়, আর ইংরেজিতে হওয়াটা কি অস্বাভাবিক? সে হাসতে হাসতে বলল, ‘এগুলো তো সহজ, এত ভুল কীভাবে হয়?’

ওর কাছে অনেক সহজ এমন কাজটাই করতে ওর আগ্রহ, নির্ভুলভাবে ইংরেজি ভাষায় সংবাদ পাঠকের কাছে দেওয়া। তার সঙ্গে এমন কথা হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই প্রিয়.কমে চালু হলো ইংরেজি সেকশন। সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলো ফাগুন। সে আমাদের মাঝে ফাগুন রেজা নামেই পরিচিত।

ইংরেজি বিভিন্ন সংবাদ দেওয়ার পাশাপাশি প্রিয়.কমের বিশেষ প্রতিবেদনগুলো সে ইংরেজিতে তৈরির পর প্রকাশ করত।

ফাগুন যখন যোগ দেয়, প্রিয়তে সে বয়সে সবচেয়ে ছোট। আমার সঙ্গে তার বাবা কাকন রেজা ভাইয়ার আগে থেকেই সম্পর্ক থাকায় হয়তো একটু দূরত্ব বজায় রাখত। কিন্তু ভাইয়া-ভাবির সঙ্গে ফাগুনের সম্পর্কটা বাবা-মা ও ছেলের মধ্যে বন্দী ছিল না, সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। আমাকে মাঝে মাঝে আঙ্কেল ডাকত, কখনো চাচ্চু ডাকত, আবার অফিসে যেহেতু সবাই ভাই ডাকে, সেও ভাই ডাকত। তার ডেস্ক আর আমার ডেস্ক পৃথক কক্ষে ছিল। ভাবতাম, হয়তো সবার সঙ্গেই সে দূরত্ব বজায় রাখে। কিন্তু পরে দেখি, না, প্রায় সবার সঙ্গেই তার দারুণ একটা সুসম্পর্ক। কয়েকজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ‘তুই’ পর্যায়ে। তার কাজের, ব্যবহারের প্রশংসা শুনি। আমার বেশ ভালোই লাগে।

ইংরেজি সেকশনে কাজ করলেও বাংলা সেকশনের জন্য একবার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিল ফাগুন। জীবনের প্রথম প্রতিবেদনটি এত সুন্দরভাবে খুব কম সাংবাদিকই লিখতে পেরেছেন। সেই প্রতিবেদনটি করার পর যে প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে গিয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী তাকে ‘হুমকি’ও দিয়েছিল। যদিও এ ঘটনায় সেই প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছিল এবং এর সুরাহা হয়েছিল। কিন্তু ফাগুনের মনে খুব দুঃখ ছিল এই ঘটনা নিয়ে। এ কারণে সে তখনই চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিল।

সাংবাদিকতায় নীতি বা আদর্শ ফাগুন যেন তার বাবার কাছে পেয়েছে। কাকন ভাইয়ার সঙ্গে যখন থেকে পরিচয়, কোনোদিন কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে দেখিনি, শুনিনি। ঢাকায় সাংবাদিকতা হাতেখড়ি হলেও কাকন রেজা শেকড়ের টানে শেরপুরে চলে যান। শেরপুরে গিয়ে আপসহীন সাংবাদিকতা শুরু করেন। এক সময় বাবার সম্পাদিত পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক শেরপুর’-এর হাল ধরেন এবং পরবর্তীতে তিনিই এটির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। এখন নিয়মিত কলাম লিখছেন প্রিয়.কমসহ বিভিন্ন পত্রিকায়।

জীবনে পথ চলতে গিয়ে কম্প্রোমাইজ করতে হয়, এ নিয়ে ফাগুনের সঙ্গে কথা বলছিলাম সেদিন। কিন্তু তার প্রশ্ন ছিল, ‘যে কাজ করতে গেলে আমাকে কম্প্রোমাইজ করতে হবে, সেই কাজ আমি কেন করব? করলে ভালোভাবে করব, না-হলে করব না। ওই প্রতিষ্ঠানেই কাজ করব না।’ অবশ্য দিনকয়েক পরে সে স্থির হয়েছিল। স্বাভাবিক সব কাজ করছিল।

মাসছয়েক পর নতুন কিছু উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইংরেজি সেকশনটা বন্ধ রাখা হলো। ‘বিজনেস’ নামে নতুন সেকশনে সে কাজ করতে থাকল। পরবর্তীতে সে সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু কাজও করেছে। কীভাবে কী করলে সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাঙ্গেজমেন্ট বাড়বে, তা করতে থাকল। প্রিয়’র ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও তৈরি করে দিতে থাকল। ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টটি অ্যাকটিভ করল। সাবস্ক্রাইবের সংখ্যাও বাড়তে থাকল। এরই মধ্যে একদিন সে সিদ্ধান্ত নিল, প্রিয়তে আর চাকরি করবে না। সে স্বেচ্ছায় চাকরিটা ছেড়ে দিলো।

তার বেশকিছু দিন আগে আমার বুকে ব্যথা। গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা বলেই গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না। ৩/৪ দিন পর জানতে পেরে ফাগুন বলল, ‘চাচ্চু, আমার একটু ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। চলেন আজ ইন্দ্রজিৎ আঙ্কেলের কাছে যাই।’

কী সমস্যা জানতে চাইলে জানালো, অনেক সমস্যা, যেতেই হবে। ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক, তার সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে আমারও পরিচয় ছিল। অফিস শেষ করে সাড়ে আটটার দিকে আমরা গেলাম। রোগীদের প্রচুর ভিড় হয় বলে বড় কোনো সমস্যা ছাড়া খুব একটা যাওয়া হয় না।

যাই হোক, ইন্দ্রজিৎ দা’র কাছে যাওয়ার পর তিনি ফাগুনের সঙ্গে অনেক কথা বললেন। সাংবাদিকতা কেমন চলছে, জানতে চাইলেন। কিন্তু সমস্যা কী, জানতে চাইলে ফাগুন বলল, তার কোনো সমস্যাই নেই। আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, আমি অসুস্থ। আমি অবাক হলাম, প্রেসক্রিপশন নিয়ে বের হওয়ার পর জিজ্ঞাসা করতেই বলল, আপনিই তো অসুস্থ, বুকে ব্যথা, এজন্য আসছি।

সেদিনও একসঙ্গে নানান বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে করতে কল্যাণপুর পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। এখন আর তর্ক হবে না ফাগুনের সঙ্গে।

২২ মে আমার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। সেহেরি খেয়ে একবারে ভোরে ঘুমিয়েছি। আমাকে ডেকে তুললেন সহকর্মী, ফোন এসেছে। ফোন করেছে সহকর্মী মিজান। সব শুনে লাফ দিয়ে উঠলাম, ফাগুনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ২১ মে সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছে কিন্তু রাতে আর বাসায় যায়নি। ফোনও বন্ধ। 

আমার মোবাইলটা চার্জে দেওয়া, হাতে নিতেই দেখি কাকন ভাইয়ার অনেকগুলো কল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক করলাম। ভাইয়া তখন শেরপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুরের সব থানা  ও হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছেন, কোথাও ফাগুনের দেখা মিলেনি। আমিও কোনো হিসাব মেলাতে পারছিলাম না। এরইমধ্যে খবর পেলাম, ফাগুনের মরদেহ পাওয়া গেছে জামালপুরে নান্দিনা মধ্যপাড়া নামের এক এলাকায় রেল লাইনের পাশে। প্রথমে মনে হলো, ভুল শুনছি। এ-ও কী সম্ভব! আমার মাথা আর কাজ করছে না।

পরীক্ষা শেষ হওয়ায় বাড়িতেই ছিল ফাগুন। ২১ মে জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ইংরেজি সেকশনে জয়েনের ব্যাপারে সাক্ষাৎকার দিতেই ঢাকা এসেছিল। ঈদের পর যোগদানের বিষয়ে কথাবার্তাও হয়। কিন্তু আর যোগদান করা হবে না। ইংরেজি সংবাদে যে ভুলভাল লেখা, তা নিয়ে আর কথা হবে না ফাগুনের সঙ্গে।

সহকর্মীদের কেউ-ই বিষয়টা মানতে পারছেন না। প্রিয় ফাগুনের এভাবে চলে যাওয়াটা কে-ই বা মানতে পারে। আমি শেরপুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম, সঙ্গে সহকর্মী মিঠু ও মিজান। ঢাকার যানজট পেরিয়ে শেরপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়ির কাটা রাত ১২টার কাছাকাছি। তখন শেরপুরে আকাশ ভেঙে পড়েছে। প্রচুর ঝড়ো বাতাস, যেন আমাদের নিয়ে চলা বাসটি উড়িয়ে নেবে। মনে হলো, ফাগুনের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না প্রকৃতিও। মৃত্যুর স্বাদ মানুষকে নিতেই হবে। কিন্তু এমন মৃত্যু সত্যিই মেনে নেওয়া যায় না। মানুষ তো মানতে পারেই না। প্রকৃতিও পারে না। 

এ দেশে প্রতিদিন কারও না কারও মৃত্যু হচ্ছে। খুন হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে। কিন্তু বিচার ক’টারই বা হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে আমরা তদন্ত করতে দেখি কিন্তু প্রতিবেদন পাওয়া যায় না। প্রতিবেদন পেলে অনেক সময় ভুল তদন্ত প্রতিবেদনের অভিযোগ ওঠে। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে এখনো জমা পড়েনি। ফাগুন হত্যায় যারাই জড়িত, তাদের খুঁজে বের করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাই। যেন এমনভাবে আর কাউকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে না হয়।

কী এমন কারণ রয়েছে, ফাগুনকে এভাবে জীবন দিতে হলো? আমরা ফাগুনের সহকর্মীরা চাই, ওর হত্যার রহস্য দ্রুতই উদ্‌ঘাটন করবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।

২৪ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই জামালপুর রেলওয়ে পুলিশ তড়িঘড়ি করে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের যে উদ্যোগ নেয়, তার কারণ কী? স্থানীয় রেলওয়ে পুলিশের ওসির দাবি, ফাগুনকে আহত অবস্থায় দেখতে পান এলাকাবাসী, পরে তার মাথায় পানিও দেওয়া হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যায় সে। এই মৃত্যু নিশ্চিত করল কে? ডাক্তার ছাড়া কি অন্য কেউ মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারেন?

ঘটনাস্থলে কি হত্যাকারীরা কোনো আলামত রেখে গেছে, রেলওয়ে পুলিশ কি তা খুঁজেছে? নাকি ফাগুনকে নিয়ে সরাসরি মর্গে রেখেছে? ফাগুনকে আগে থেকেই কি অনুসরণ করছিল হত্যাকারীরা? হত্যার আগে ট্রেন ভর্তি মানুষের মধ্য থেকে ফাগুনকে নামানো হলো কীভাবে? এমনও হাজার প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। আশা করছি এসব প্রশ্নের উত্তর দ্রুত জানতে পারব। সাংবাদিক ফাগুন হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করছি।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]