লেখায় ভুল অযোগ্যতা প্রকাশ করে। প্রতীকী ছবিটি সংগৃহীত
লেখালেখিতে শুদ্ধতা কেন জরুরি
আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:২২
(প্রিয়.কম) একটা সময় ভ্রমণে বের হলে বিভিন্ন যানবাহনের গায়ে লেখা ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’ কমবেশি সবার চোখে পড়ত। বিশেষ করে বাস, ট্রেন, স্টিমার ও লঞ্চে এ লেখাটি বেশি থাকত। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, সচেতনতা সৃষ্টি করা, যেন যাত্রাপথে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে; সবাই যেন ভদ্র আচরণ প্রদর্শন করেন। কিন্তু এর যে ব্যাপক অর্থ, তা কিন্তু সত্যি ভাববার মতো। সে কেমন? একটু খোলাসা করা যাক।
ধরুন, যাত্রাপথে আপনি অমার্জিত আচরণ করে বসলেন, তখন আপনার যাত্রার সঙ্গী যারা, তারা প্রথমেই যে বিষয়টি ভাবেন সেটি হলো, আপনার পারিবারিক শিক্ষা নেই, আপনি ভালো বংশের মানুষ নন। তার মানে, আপনার আচরণ দ্বারা কেবল আপনিই নন, আপনার পরিবার, এমনকি আপনার বংশ সম্পর্কেও মানুষ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে থাকে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এই, আচরণ দ্বারা একজন মানুষকে পরিমাপ করা হয়।
এতটুকু পড়ে অনেকে হয়তো ভাবছেন শিরোনামের সঙ্গে আচরণের কী সম্পর্ক? এককথায় যদি এর উত্তর দিতে হয়, তাহলে বলব, সম্পর্কটা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো। যেমন? আচরণ দেখে একজন মানুষকে যেমন পরিমাপ করা হয়, ঠিক তেমনি কোনো একটি লেখা পড়ে সে লেখকের লেখা ও যোগ্যতা (জ্ঞান) সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। অর্থাৎ, তিনি কতটা জানেন, কতটা সমৃদ্ধ সে সম্পর্কে পাঠক লেখাটি পাঠ মাত্রই ধারণা করে নেন। কখনো কখনো ওই ব্যক্তি কোন মানসিকতার সেটিও উঠে আসে।
উদাহরণ দিই, মনে করুন, আপনি কোনো একটি লেখা পাঠ করা শেষ করেছেন। আপনার পাশে তখন একজন আছেন। আপনি কিন্তু তাৎক্ষণিক তাকে বলে বসেন, ‘লেখাটি দারুণ হয়েছে! পড়ে দ্যাখ (কিংবা পড়ে দেখুন, পড়ে দ্যাখো)।’ আর যদি লেখাটি আপনার মন ছুঁয়ে যায়, তাহলে বলে বসেন, ‘অসাধারণ! কী সুন্দর বাক্য গঠন, শব্দ চয়ন আর উপস্থাপন। বহুদিন এমন লেখা পড়িনি। আমার মন ছুঁয়ে গেছে লেখাটি।’ একজন পাঠক যখন লেখা পড়ে এমন কমেন্ট করেন কিংবা এমন ভাবনা তার মনে যখন উদয় হয়, তখনই লেখক এবং তার লেখা উভয়ই সার্থকতা অর্জন করে।
এবার বিপরীতটা দেখুন। যখন কোনো একজন খুব আগ্রহ নিয়ে একটি বিশেষ লেখা (পছন্দ করে এমন বিষয় কিংবা চলমান কোনো বিষয়ের লেখা) পাঠ শুরু করেন এবং লেখার মাঝেই বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘কী লিখছে এসব! না জানে বাক্য গঠন, না বানান। শব্দ চয়ন তো বহু দূর। এত সুন্দর একটা বিষয় (শখ করে শিরোনাম দেখে বই কেনাও হতে পারে, কিংবা কোনো একটি সংবাদ) অথচ কী বাজে উপস্থাপন! ব্যাটা লিখতেই জানে না।’ আপনি নিজে কিংবা আপনার পরিচিত জনরা কি এমন কমেন্ট করেন না?
উপরে লেখা নিয়ে ভালো ও মন্দ—দুটি দিকই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি; যা সাধারণত হয়ে থাকে।
এবার মনস্থির করে ভাবুন তো, প্রথম উদাহরণটি পাঠ করে আপনার ভাবনায় কোন বিষয়টি ভর করেছে? নিশ্চয় যিনি ভালো লেখেন তার লেখার প্রতি আপনার একধরনের ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। তার মানে আপনি ওই লেখকের পরবর্তী লেখার জন্য অপেক্ষা করবেন। কিংবা ওই লেখকের লেখা পাঠ করার জন্য আপনার ভেতরে একটা আগ্রহ কাজ করবে। সেই সঙ্গে আপনি তার লেখালেখি সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণ লালন করতে থাকবেন এবং অন্যকে তার লেখা পাঠ করার জন্য বলবেন।
দ্বিতীয় উদাহরণটির বেলায় কী বলবেন? প্রথমটির ঠিক বিপরীতটাই তো, নাকি?
পাঠক খেয়াল করে থাকবেন, আমি শিরোনামে ‘লেখায়’ না লিখে ‘লেখালেখিতে’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। এর কারণ, ‘লেখায়’ বলতে শুধু নির্দিষ্ট লেখাটিকে (যেটি লেখা হয়েছে) বোঝাত, আর ‘লেখালেখিতে’ বলতে আমি লেখালেখিসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়কে বোঝাতে চেয়েছি। যেহেতু এখন লেখা প্রকাশের মাধ্যম অনেক। আর সেসব মাধ্যমে প্রতিদিনই নানা জনের নানা লেখা প্রকাশ পায়। বিশেষ করে ফেসবুকে। ফেসবুকে সব শ্রেণির মানুষের লেখা থাকে। যেসব লেখা ছাপা হয়, তা আবার চেনা-অচেনা সবাই মোটামুটি পাঠ করেন। পাঠ করতে গিয়েই কিন্তু নানা অসংগতি চোখে পড়ে, যা অনেকটা দৃষ্টিকটু। আবার বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালেও অনেকে নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও সাহিত্য নিয়ে লেখেন। সেখানেও অনেকের লেখায় দেখা যায় অসংগতি। সব মিলিয়ে লেখায় অসংগতি নিশ্চয় ভালো কোনো বিষয় নয়। তাই বিষয়টির প্রতি যারা লেখালেখি করেন তাদের যত্ন নেওয়া ্উচিত বলে মনে করছি।
এবার লেখালেখিতে সাধারণত কী ধরনের অসংগতি হয় তা তুলে ধরছি।
ধরুন, কোনো একজন আপনার একটি পোস্ট পড়ে নিচে কমেন্ট লিখেছেন, ‘সুন্দর হইসে। বাল লাগসে। লেখে জান।’ এ কমেন্টটিতে কী দাঁড়াল? অন্যরা যখন এ কমেন্টটি পড়বে, তখন তার সম্পর্কে কী ভাববে? আসলে হওয়া উচিত ছিল এ রকম—‘সুন্দর হয়েছে। ভালো লেগেছে। লিখে যান।’ কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে উল্টো।
আবার আপনি একজনের পোস্টে মন্তব্য লিখলেন এ রকম—‘এই কাজ টি টিক হয়নি। তাদের কে সব থেকে আলাদা ভাবছিলাম। লেখাটি পরে বুঝলাম এর জন্য তাড়াই দায়ি চিল।’ তিনটি বাক্যের এ মন্তব্য পড়লে কী বোঝা যায়? মন্তব্যকারী কি তার এমন ভারী মন্তব্যের সঙ্গে নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে পেরেছেন? বাক্যগুলো আসলে কেমন হওয়া উচিত? এ রকম সরল কি—‘এই কাজটি ঠিক হয়নি। তাদেরকে সবথেকে আলাদা ভাবতাম। লেখাটি পড়ে বুঝলাম এর জন্য তারাই দায়ী।’
কখনো কখনো ইংরেজি অক্ষরে বাংলা উচ্চারণে কমেন্ট লিখতে দেখা যায়। সেসব আরও জগাখিচুড়ি পাকানো। দুয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
একজন একটি ছবির নিচে মন্তব্য করেছেন, তার উত্তরে যিনি ছবি পোস্ট করেছেন তিনি লিখেছেন—mayatar anak gan doia kores dos oka jano manus korta pare. ইংরেজি অক্ষরের এ বাক্য পড়ে ভাব বোঝা গেলেও, তা যে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইংরেজি উচ্চারণে লেখাটি পড়লে এ রকম দাঁড়ায়—‘মায়াটার আনাক গান দোইয়া করেস দোস ওকা জানো মানুস করতা পারে।’ আসলে লিখতে চেয়েছে—meyetar anek gayan. Doya koris dost, oke jeno manush korte pari (মেয়েটার অনেক জ্ঞান। দোয়া কোরিস দোস্ত, ওকে যেন মানুষ করতে পারি।)
আরেকজন লিখেছেন, tor chalata daron smart oka balo schoola vorte koris. sisudar soto taka garte hoi. কমেন্টটি পড়লে দাঁড়ায়, ‘তোর ছালাটা দারোন স্মর্ট ওকা বালো স্কুলা ভরতে করিস। সিসুদার সোটো টাকা গারতে হই।’ আসলে লিখতে চেয়েছে—tor cheleta darun smart. Oke valo schoole vorti koris. Shishuder chhoto thakte gorte hoy. (তোর ছেলেটা দারুণ স্মার্ট। ওকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিস। শিশুদের ছোট থাকতে গড়তে হয়।)
এগুলো খুবই ছোট ছোট উদাহরণ। উদাহরণ হিসেবে ক্ষুদ্র হলেও, বৃহৎ পরিসরে, অর্থাৎ প্রবন্ধ কিংবা সাহিত্যের লেখা যদি দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে, তাহলে যে পাঠকের উদ্দেশে লেখা, সে পাঠক লেখককে কীভাবে গ্রহণ করবেন তা কিন্তু সত্যি ভেবে দেখার বিষয়। কারণ লেখা ভালো-মন্দের ওপর নির্ভর করে লেখকের আগামীর লেখালেখি। আর সেই সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে যায় লেখক-সত্তার পরিমাপও।
ব্যক্তিজীবনে আমি বছরজুড়ে নানা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করি। সংখ্যায় সেগুলো কম নয়। নবীন-প্রবীণ সব লেখকেরই লেখা থাকে তাতে। তার সবই একুশে বইমেলায় প্রকাশ পায়। সেসব পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে যেমন বিস্মিত হই, তেমনি হই বিরক্ত। কারণ আর কিছু নয়, অসংগতি। খেয়াল করে দেখেছি, এর ভেতরে এমন অনেকে আছেন, যারা না জেনেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেছেন, আবার অনেকে অসচেতন কিংবা সাহিত্য নিয়ে সংকল্পবদ্ধ নন। অবশ্য সেগুলো ঠিক করে তবেই বই আকারে ছাপা হয়। কিন্তু অসংগতি যদি দূর না হয়ে ওভাবেই বই আকারে প্রকাশ পায়, তাহলে ভাবুন তো পাঠক আপনাকে কীভাবে গ্রহণ করবে? যেহেতু লেখাটির সঙ্গে আপনার নামটি জুড়ে থাকে।
আশা করছি লেখালেখিতে শুদ্ধতা কেন জরুরি তা বোঝাতে পেরেছি। তারপরও, কারো যদি কোনো মন্তব্য থাকে, কিংবা কোনো পরামর্শ থাকে তাহলে তা কমেন্টে লিখতে পারেন। আর লেখাটি যে উদ্দেশ্যে লেখা, তা যদি সার্থক হয়, তাহলে এ সংক্রান্ত আরও লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রিয়.কমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হবে; যেখানে লেখালেখি বিষয়ে থাকবে ধাপে ধাপে আলোচনা।
প্রিয় সাহিত্য
- ট্যাগ:
- সাহিত্য
- লাইফ
- প্রবন্ধ
- জীবন চর্চা
- লেখালেখি