কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার ঘটনায় নিহতদের স্মরণ করছেন স্থানীয়রা। সংগৃহীত ফাইল ছবি

ধর্মই কি সবকিছুর মূলে, আর কিছু নেই?

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ২৫ এপ্রিল ২০১৯, ২০:১৬
আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৯, ২০:১৬

শ্রীলঙ্কার হামলার পর, শুধু শ্রীলঙ্কা কেন, সব হামলার পরই কিছু লোক বলতে শুরু করেন, এমন সংঘাত-সংঘর্ষের কারণ হলো ধর্ম। ‘ধর্মই সকল অধর্মের মূল’—এমন আওয়াজ প্রবলভাবে উত্থিত হয় সামাজিক থেকে গণমাধ্যমে। ক্রাইস্ট চার্চ মসজিদে হামলার পরও তাই দেখেছি। তাদের প্রশ্ন করি, ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিং হত্যার পর আমেরিকায় দাঙ্গা হয়েছিল কি ধর্ম নিয়ে? ২০১৫ সালে ম্যারিল্যান্ডের দাঙ্গাও কি ধর্মের কারণে? না, এসব দাঙ্গার কারণ ছিল রেসিজম, বর্ণবাদ। এ না-হয় গেল বর্ণবাদের কথা। একই বর্ণের ভেতরে কি দাঙ্গা হয় না? ১৯৯৪ রুয়ান্ডার গণহত্যার কথা কি জানা আছে কারো? দুই দল কালো বর্ণের মানুষের মধ্যে সংঘটিত ইতিহাসে ভয়াবহতম ম্যাসাকার। যাতে তুতসি সম্প্রদায়েরই অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ মারা যায় হুতু সম্প্রদায়ের হাতে। দুটি সম্প্রদায়ই কিন্তু কালো মানুষের। ভারতে উচ্চবর্ণের হাতে নিহত দলিতরা কিন্তু ধর্মে হিন্দুই। তারাও যে দেব-দেবীকে মানেন, উচ্চবর্ণের দেব-দেবী তারাই। মুসলমানদের শিয়া-সুন্নি, খ্রিস্টানদের ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট।

রাজনীতিই বাদ দিবেন কেন। নিজের দেশের সর্বহারা ধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিগুলোর কথাই ধরুন না, যারা গরিব মানুষের মুক্তির কথা বলে। তারা তো দলে দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিতে লিপ্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে কী চলছে। ট্রাইবরা নিজেদের মধ্যেই উপদলে বিভক্ত। নিজেরাই ব্রাশফায়ারে নিজেদেরকে মারছে। ভারতের মাওবাদীরা। তারাও তো বোমা মেরে, গুলি করে মানুষ হত্যা করছে-করে। যারা অনগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট, তারাও তো চীনপন্থি, মস্কোপন্থিতে বিভক্ত। এসব বিভক্তির উদাহরণ দিতে গেলে তো মহাকাব্যেও ধরবে না। সুতরাং আপাতত উদাহরণ বাদ। এতক্ষণ এই যে ভূমিকা এবং প্রশ্ন, এর মূলে হলো বলার চেষ্টা করা যে, মানুষের সংঘাত আর বিভক্তির কারণ শুধু ধর্ম নয়, কারণ হলো চিন্তা। যে চিন্তা লোভের, সব গ্রাস করার।

একটু ঘেঁটে দেখুন, সারা বিশ্বের অর্ধেক সম্পদ গোটা কয়েক পরিবারের দখলে। সম্পদ আর ক্ষমতার অধিশ্বর এমন গোটা কয়েকের জন্যই সারা বিশ্বে এই ধুন্ধুমার। পৃথিবীতে সব ধর্ম নিষিদ্ধ করুন না। দেখবেন, তারপরেও দৃশ্যপট একই থেকে যাবে। এরা নিজেদের স্বার্থের জন্য সাধারণ বোকা মানুষগুলোর আবেগের জায়গাকে ব্যবহার করবে। ধর্ম না থাকলেও বর্ণ, না হলে সম্প্রদায়, না হয় গোষ্ঠী, অঞ্চল, রাজনীতি, সব আবেগের জায়গাগুলোই ব্যবহৃত হবে এমন অর্থ আর ক্ষমতালিপ্সুদের প্রয়োজনে।

কলকাতার এক লিখিয়েকে দেখলাম, প্রচণ্ড ক্রোধ নিয়ে বলেছেন, ইসলাম ধর্মকে তুলে দিলেই বিশ্বের সন্ত্রাস বন্ধ হয়ে যাবে। তাকে যদি বিনীত প্রশ্ন করা যায়, আপনার দলিত আর উচ্চবর্ণের শ্রেণিগত সন্ত্রাস কি আড়াই হাজার বছরেও বন্ধ করতে পেরেছেন? কী জবাব দেবেন তিনি? কোনো জবাব নেই। মুসলমানরা কথায় কথায় বলেন, তারা নির্যাতিত। ঠিক, তারা অনেক জায়গায় নির্যাতিত। কিন্তু খ্রিস্টানরা কি নির্যাতিত নয়? হিসাব করে দেখুন তো, খ্রিস্টানদের গির্জা কি আক্রান্ত হচ্ছে না? হচ্ছে। সবাই নির্যাতিত হচ্ছে। আর এই নির্যাতনের পেছনের কারণ ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা অঞ্চল কিছুই নয়, এর কারণ হলো কিছু দানব হয়ে ওঠা মানুষের অর্থ ও ক্ষমতার লোভ।

এই যে, অনেকে যারা নিজেদের ‘নাস্তিক’ বলেন, জাহির করেন, তারাও তো একটি গোষ্ঠী। এক অর্থে নাস্তিকতাও একটি ধর্ম। যে ধর্মে ঈশ্বর নেই। তারা যে বলেন, ‘ধর্মই সকল অধর্মের মূল’—এটাও তো ঘৃণা ছড়ানো। নাস্তিকতার বিপরীতে আস্তিকদের বিরুদ্ধে ঘৃণাময় অবস্থান। জানান দেওয়া, এই লোকগুলো ধার্মিক, এই লোকগুলো খারাপ! এই যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান, এটাকেই কাজে লাগায় লোভী চিন্তার মানুষগুলো। কখনো ধর্মের নামে, কখনো বর্ণ, কখনো সম্প্রদায় কিংবা কখনো রাজনীতির নামে। আর সাধারণ বোকা মানুষেরা ব্যবহৃত হয়। নিজেরা আত্মঘাতী হয়, অন্যদের ঘাতক হয়। এই যে, আইএস মূলত আইসিস ইসলামের নামে মানুষ হত্যা করে চলেছে, এতে কি পৃথিবীর দুইশ’ কোটি মুসলমান কোনোভাবে লাভবান হয়েছে? সিরিয়ার মতো একটি সমৃ্দ্ধ দেশ আজ ধ্বংসস্তূপ। রয়েছে ইরাক। একসময় ইরাকে কাজে যাবার জন্য মানুষ ছিল উদগ্রীব। ছিল লিবিয়া যেতেও। আজ বোমা আর গুলিতে বিধ্বস্ত ভাঙাচোরা দালানকোঠা দেখে সেই ইচ্ছাগুলোকে স্বপ্ন মনে হয়।

পশ্চিমারা আজ নিজেদের সভ্য বলছে। সেই সভ্যতাতেও বাসা বেঁধেছে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ নামের ভয়াবহ ক্ষত; যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপের শান্তিময় দেশগুলোকে টার্গেট করা হচ্ছে, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ নিউজিল্যান্ড। মূল কথা, লোভী চিন্তার মানুষগুলো বিশ্বকে শান্তিময় থাকতে এবং হতে দেবে না কোনোভাবেই। এ যেন তাদের প্রতিজ্ঞা। আমাদের সুকান্তের উল্টো কাব্য রচছে তারা। এ বিশ্বকে তারা সাধারণ বোকা মানুষগুলোর জন্য বাসযোগ্য রাখবে না। এ কথা কি বোঝে বোকা মানুষগুলো?

ফুটনোট: বাঘের পানি ঘোলাবিষয়ক গল্পটি মনে আছে? বাঘের নিয়ত গাধাকে খাবে। অজুহাত, পানি ঘোলা করলি কেন? গাধার উত্তর, আমি ঘোলা করিনি। তুই করিসনি, তোর দাদা করেছে। সুতরাং গাধা বধ। গাধা অর্থাৎ বোকারা মূলত বধই হয়।

ঘৃণা ছড়াতে ধর্ম লাগে না, উপলক্ষ লাগে।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]